List

বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান ও শোষিতের জেগে ওঠা

মোনায়েম সরকার

আমার বিগত দিনের একটি লেখায় বলেছিলামÑ সারা পৃথিবীর মানুষকে ইতিহাস, ‘অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই। এমন কি এক বিশ্ব শক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না।এ কথা ক্রমে ক্রমে প্রমাণ হতে চলেছে। পৃথিবীর মানুষ আজ ব্যক্তিগত-গোষ্ঠীগত ও জাতিগত স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। যারাই মনে করছে আমরা পরাধীন কিংবা অধিকার বঞ্চিত তারাই আন্দোলন শুরু করেছে স্বাধীনতা ও অধিকারের আশায়। ভারত অধিকৃত কাশ্মীর ও পাকিস্তান শাসিত বেলুচিস্তানে গণমানুষের যে লড়াই শুরু হয়েছে শেষ পর্যন্ত এই লড়াইয়ের পরিণাম কি হয় বিশ্ববাসী আজ এই দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এক দুই বছরে রচিত হয় না, একটি দুটি জীবন দানের মধ্যেও তা সীমাবদ্ধ থাকে না। তার জন্য বহু বছর নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়Ñ অনেক জীবন উৎসর্গ করতে হয়। কাশ্মীর ও বেলুচিস্তান এখন সেই পথেই হাঁটছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। সে ঘটনাটি ঘটেছিল লায়লা কবিরের বাসায়। একদিন অল পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খানের সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে আমি তাকে বলেছিলামÑ ‘আপনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যতই বৈঠক করেন না কেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি আর কিছুই মানবে না। তখন ওয়ালী খান আমার হাত ধরে বলেছিলেন, জানো গভর্নর (আমার নামের সঙ্গে তৎকালীন গভর্নরের নামের মিল ছিল বলে তিনি আমাকে গভর্নর বলেই ডাকতেন।) আমিও এই কথাটাই মুজিব ও মোজাফফরকে বুঝাতে চাই কিন্তু বুঝাতে পারছি না। মুজিব আর মোজাফফর কি বুঝতে পারছে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশের অবস্থা কত ভয়াবহ হবে। পাক-ভারত বিভক্তির সময় আমার বাবাকে (খান আবদুল গাফফার খানকে) পাকিস্তানিরা বলেছেন ট্রেটর। আমি এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বললে আমাকে বলে দালাল। কিন্তু আমি তাদের বুঝাতে পারি না এ রকম একটি আনসায়েন্সটেফিক স্টেটকিছুতেই হতে পারে না, হওয়া সম্ভবও নয়। ওয়ালী খান আরো বলেছিলেন, তোমরা যে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলছো সেটা পাওয়া খুব একটা সহজ হবে না। তোমরা এতদিন পাকিস্তানি পুলিশের সঙ্গে মারামারি করেছো কিন্তু পাঞ্জাবি আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করোনিÑ পাঞ্জাবি আর্মির সঙ্গে লড়াই করলেই বুঝতে পারবে তারা কত ভয়ঙ্কর। তারা নির্বিচারে পাখির মতো মানুষ মারতে পারে। আমি তখন বললামÑ পরিস্থিতি যা হোক সর্ট অফ ইন্ডিপেন্ডেন্সবাঙালি আর কিছুই মানবে না। খাবার টেবিলে একটি পতাকা রাখা ছিল। আমি সেই পতাকা দেখিয়ে বললাম, এই দেখেন আমি সাত টাকা দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা কিনে এনেছি। এই পতাকা ছাড়া আপনার গাড়ি রাস্তায় বের হলে বাঙালিরা গাড়ি ভেঙে খান খান করে ফেলবে। আমার কথা শেষ না হতে বেলুচিস্তানের নেতা ও পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপের প্রসিডেন্ট গাউস বক্স বেজিনজো বললেন, তোমরা যদি পূর্ণ স্বাধীনতা চাও, তাহলে পাঞ্জাবিরা আমাদের উপরও অত্যাচার চালাবে। ÔThey will crush us like sugarcane.Õ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ওয়ালি খান বলেছিলেন, পাঞ্জাবি আর্মির আগাম বর্বরতার কথা। আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাঞ্জাবি আর্মির বীভৎসতা দেখেছি বটে কিন্তু তারা আমাদের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি কথা প্রমাণ হয়েছে যে, মুক্তিকামী জনগণ কায়মনোবাক্যে মুক্তি আকাক্সক্ষা করলে তারা তা পায়।

পৃথিবীতে এক সময় ৭০টির মতো দেশে মার্শাল লছিল। মানুষ সেই অমানবিক মার্শাল ল’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মার্শাল লহটিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে। এখনো যেখানে যেখানে মার্শাল লবা ছদ্মবেশী মার্শাল লচলছে সেসব দেশেও চলছে শোষণ মুক্তির লড়াই। একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পৃথিবীর যে প্রান্তেই সামরিক শাসন থাকুক না কেনÑ সামরিক শাসনের পক্ষে থাকে পুঁজিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের সরাসরি কিংবা অপ্রকাশ্য মদদ। পুঁজিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল কারণ। পুঁজিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদীরা পুঁজির বিকাশ ও বৃদ্ধি এবং সা¤্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য এমন কোনো ফন্দি-ফিকির নেই যে না করতে পারেন। তারা নিজেদের স্বার্থে দিনকে রাত করতে পারেন, বন্ধুকে শত্রু বানিয়ে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারেন, ধার্মিকের গায়ে পরিয়ে দিতে পারেন জঙ্গির আলখেল্লা। যদি আমরা নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে এই সময়ের পৃথিবীকে এক পলক অবলোকন করি, তাহলে দেখবো বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষমতাধর পুঁজিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো এখন এই কাজগুলোই অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে করে বেড়াচ্ছে।

একটি বিষয় বিশ্ব রাজনীতিবিদদের মনে রাখা দরকারÑজোর করে কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যায় না। এক সময় বার্লিন ওয়ালছিল এখন তা নেই। জার্মান জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজের প্রয়োজনেই সেই বার্লিন ওয়াল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আজ কাঁটাতার সীমান্তে সীমান্তে যে বিভেদ সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই কাঁটাতারও একদিন সীমান্ত থেকে উপড়ে ফেলা হবে। সবই সময়ের ব্যাপার। পানিকে যেমন ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় না নিলে বাষ্প হয় না, তেমনি শোষণমুক্তি আন্দোলনের জন্যও দরকার হয় কিছু প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানে সে অনুষঙ্গগুলো অনেকদিন আগে থেকেই হাজির হয়ে আছে। এখন এই দুটি দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ জনযুদ্ধ করে, অত্যন্ত ঠা-া মাথায় বিজয়ের ফসল ঘরে তুলতে পারলেই তাদের স্বপ্ন সার্থক হবে।

যার সঙ্গে যার বনিবনা হয় না, তার সঙ্গে তার না থাকাই সমীচীন। আমরা এক সময় পাকিস্তানের সঙ্গে ছিলাম কিন্তু তাদের সঙ্গ আমাদের সর্বস্বান্ত করে ফেলেছিল, তাই আমরা তাদের থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথক হই এবং পৃথক হয়ে ভালোই আছি। এক সময় সোভিয়েট ইউনিয়ন বৃহৎ একক রাষ্ট্র ছিল, সেই সোভিয়েট ইউনিয়নে লাগে ভাঙনের হাওয়া। এক অখ- সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নেয় দশটি খ- রাষ্ট্র। যুগোস্লাভাকিয়ার অবস্থাও তাই। ভাঙনের কবলে পড়ে সেটাও তিন টুকরো হয়। অনেক দিন ধরেই অখ- ভারত ও পাকিস্তানে গোষ্ঠীগত চেতনা তাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে। ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেই দাবিগুলোকে সমাধান করে আসছে। এভাবে আর কতদিন তারা নিজেদের অখ-তা রক্ষা করতে পারবেন তা আগামী দিনের ইতিহাসই বলতে পারবে।

বেলুচিস্তান দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১ জুলাই, ১৯৭০ সালে। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের বৃহত্তম এই প্রদেশটির আয়তন ৩,৪৭,১৯০ বর্গকিলোমিটার। বলা হয়ে থাকে বেলুচিস্তান পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট আয়তনের ৪৮ শতাংশ গঠন করেছে। বেলুচ জাতির লোকদের নামে এই প্রদেশের নামকরণ হয় বেলুচিস্তান। এর পশ্চিমে আছে ইরান (ইরানি বেলুচিস্তান), উত্তরে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল, পূর্বে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ এবং দক্ষিণে আরব সাগর। বেলুচিস্তানের অতীত দিনের রাজনৈতিক ইতিহাস বড় নির্মম ও রক্তাক্ত। যুগে যুগে নানা ধরনের মানুষ বেলুচিস্তানকে শাসন ও শোষণ করেছে। পারস্য, মোঘল, ব্রিটিশ থেকে শুরু করে কে না বেলুচিস্তানের দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছে? ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে গেলেও ধীরে ধীরে বেলুচদের মধ্যে তৈরি হয় স্বাধীনতার স্বপ্ন।

পাকিস্তান বাঙালিদের দমন করার জন্য যেমন আক্রমণ করেছিল, তেমনি ভারত কাশ্মীরকে এবং পাকিস্তান বেলুচিস্তানকে দমন করার জন্য রক্ত উৎসবে মেতেছে। শাসক শ্রেণি যতই প্রবল হোক ন্যায্য দাবি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া পরাধীন জাতিকে কেউই দাবিয়ে রাখতে পারে না। ভারত ও পাকিস্তানও তাদের দুই বঞ্চিত ও স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। আজ হোক আর কাল হোক স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য কাশ্মীর আর বেলুচিস্তানের আকাশে হাসবেই।

০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 9 10 11 12
May 7th, 2016

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি মোনায়েম সরকার রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু পণ্ডিত সম্মান পায় […]

May 6th, 2016

যুগে যুগে সমাজ বিবর্তনের ধারায় শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা

পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রীদের যখন সোনালি দিন ছিল, তখন মে দিবস উদযাপিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আর […]

June 25th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয় অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহ্‌মদ ভূগোল ও ইতিহাস বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্রভূমি […]

June 25th, 2015

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০, ২৭ জানুয়ারি

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে  পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০ ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দিন বদলের অঙ্গীকারের […]

June 25th, 2015

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture 25 January 2011 Bangladesh National Museum MICROCREDIT: A PANACEA OR A VILLAIN Introduction […]

June 24th, 2015

International Terrorism: Bangladesh Context

  Seminar Paper 8 December 2004 at CIRDAP auditorium International Terrorism: Bangladesh Context C M Shafi Sami   Introduction Historically […]

June 24th, 2015

কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা-২০০৯-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ড· মো· আনোয়ার হোসেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ […]

June 24th, 2015

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সমবেত সুধীমন্ডলী, […]

June 24th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা-২৫ আগস্ট ২০১২-বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

বাংলাদেশে সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারা – মইনুল ইসলাম সুধীমণ্ডলী, বক্তৃতার শুরুতেই আমি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা […]

June 20th, 2015

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি                           […]