List

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সীমাহীন অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এমন কোনোদিন নেই যেদিন পত্র-পত্রিকায় ও টেলিভিশনের টক-শোগুলোতে আমাদের শিক্ষার অব্যবস্থাপনা কিংবা শিক্ষার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা না হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষামন্ত্রক বা শিক্ষা-বিষয়ক নীতি-নির্ধারকরা তাতে কর্ণপাত করছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একটি অসুস্থ ধারার বিকলাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর করে পুরো জাতি আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে এখনই পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করা দরকার। বাংলাদেশে মোটামুটি চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তর (বিশ্ববিদ্যালয়)। এই হলো আমাদের শিক্ষার প্রচলিত কাঠামো। এই চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে আছে আরো নানা উপস্তর (মক্তব, গ্রামভিত্তিক শিক্ষা, কওমি শিক্ষা, তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি)। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে এবং পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, এমনটিই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।
কিন্তু ভেতরের খবর খুবই হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের অবুঝ শৈশবে আমরা যে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষাকে যদি বর্তমান দৃষ্টিকোণে ত্রুটিপূর্ণ বলে ধরা হয়, তাহলে এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয় যে, সেই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা নিয়েই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শিক্ষার সমস্ত-সুযোগ পেয়েও, পরীক্ষায় সোনালি প্রতীক (গোল্ডেন এ+) পেয়েও কেন এ যুগের শিক্ষার্থীরা দুই জনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না তা পুরো জাতিকে চিন্তিত করে তুলেছে। তাহলে কি প্রশ্ন উঠতে পারে নাÑ কোন শিক্ষা ভালো ছিল আগের কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা পদ্ধতি নাকি আধুনিক সৃজনশীল পদ্ধতি?
৭ অক্টোবর, ২০১৬ দৈনিক ইত্তেফাকে ড. জাফর ইকবাল ‘আমার ভাঙা রেকর্ড’ কলামে দেখিয়েছেন কোনো রকম লেখাপড়া না করেও বর্তমান পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থায় ৬০-৭০ শতাংশ নম্বর পাওয়া সম্ভব। আর কেউ যদি একটু খাটাখাটুনি করে ১০-২০ নম্বর পায়, তাহলে গোল্ডেন এ+ পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। তার মানে হলো আমাদের সময়ের সনাতন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার মানদ-ের বিবেচনায় এখন যারা জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে, তারা মূলত ফেল করা শিক্ষার্থীর কাতারেই পড়ে। অর্থাৎ এখনকার ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়া ছাত্র এক হিসেবে অকৃতকার্য ছাত্রই বটে।
এই অকৃতকার্যকে কৃতকার্য করে তোলা এটা এক হিসেবে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মনে করেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার। অবশ্য তাদের এসব কথার পেছনে অকাট্য যুক্তিও রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আসলেই ঢেলে সাজানো দরকার কিনা সে বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার অধিকার আমরা কেউই রাখি না, যদি না সরকার সে কথা স্বীকার না করেন। কেননা প্রতিষ্ঠিত সরকারি পলিসির বিরুদ্ধে কথা বলা এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু কথা হলো সমাজে যেহেতু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও শুভঙ্করের ফাঁকি ধরা পড়েছে সেই বিষয়ে অবশ্যই সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। যদি জনগণের পর্যবেক্ষণই ঠিক হয় তাহলে সরকারের উচিত জনপ্রত্যাশা ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলিত সমস্যা সমাধান করা। আর তা না হলে সরকারের উচিত সরকারে শিক্ষা পলিসি যে ঠিক তা যুক্তি দিয়ে জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া।
পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে পঞ্চম শ্রেণির কোনো শিশুর পরীক্ষা এত সমারোহে হয় নাÑ সেটা হয় বাংলাদেশের মতো একটা গরিব দেশে। এখনকার পিএসসি পরীক্ষা (প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট) যেভাবে হয়, সেইভাবে হতো আমাদের সময়ের এসএসসি (ম্যাট্রিকুলেশন) পরীক্ষা। আমাদের আমলে ম্যাট্রিক পাশ করলে একটা ছোটখাটো চাকরি পাওয়া যেত। আমার পরিচিত অনেক লোকই ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করেছে। অথচ আজকের দিনে পিএসসি নামের যে অদ্ভুত ও শিশু নির্যাতনকারী পরীক্ষা চালু হয়েছে তার ফলাফল ও সার্টিফিকেট কোনো কাজেই লাগে না। মাঝখান থেকে কিছু অপ্রত্যাশিত দুর্বৃত্তপনা যুক্ত হয়েছে। আমাদের সময়ে স্কুলে স্কুলে প্রাইমারি পরীক্ষা হতো, যে পাস করতো সে হাইস্কুলে যেত এবং হাইস্কুলের গ-ি পেরুতে পারলে যেত কলেজে। উচ্চ শিক্ষা নিত খুবই অল্প লোকে। যাদের মেধা ও সচ্ছলতা ও অটুট ধৈর্য ছিল তারাই উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতো। এখনকার সিস্টেমটা এতই অদ্ভুত যে, বাংলাদেশে প্রাইমারি স্কুলে ফেলের সংখ্যা নেই বললেই চলে (বেশিরভাগ পাস করে বা করানো হয়)। তাহলে কি আমাদের শিক্ষা অনেক এগিয়ে গেছে বলবো? সংখ্যায় এগিয়ে থাকলেও আসলে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে গেছি। অনেকখানি ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। এখন সবাই পাস চায়, জ্ঞান চায় না। পাস এখন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এক নম্বর চাওয়া। শিক্ষার গুণগত মান যাই হোক না কেন সংখ্যাগত মান বৃদ্ধিতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকার সদা তৎপর। এখন একটা ফাইভের শিশুকে আঠারো ঘণ্টা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় (শুধু ঘুমানো ও প্রাতঃকৃত্য ছাড়া)। তার অবশ্যই কোচিং করানোর অর্থ জোগান দিতে হয়। একজন লোক (বাবা/মা, কাজের ছেলে বা মেয়ে) তার দেখাশোনার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়, প্রশ্ন ফাঁস হলে সেই ফাঁস করানো প্রশ্ন জোগাড় করার অনৈতিক কাজে জড়িত থাকতে হয়। রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পাওয়ার জন্য প্রশ্ন ফাঁস করানোর চেষ্টা করতে হয়। সব মিলিয়ে একটা বাজে বিষয়ের চর্চা আর কি। সরকারি ব্যয়ে একটি পরীক্ষা চালাতে রাষ্ট্রের সব স্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ব্যবহার করতে হয় (প্রয়োজন অনুযায়ী)। এটা একটা দক্ষযজ্ঞই বটে। অথচ মজার বিষয় হলো এই পরীক্ষার কিছুই কোনো কাজে লাগে না। আগের দিনে ফাইভ পাস কোনো কাজে লাগতো না, এখনকার দিনের ফাইভ পাসও কোনো কাজে লাগে না, অথচ আগের দিনে ফাইভ পাস করাতে সরকারের এক টাকাও অপচয় হতো না। এখন ফাইভ করাতে সরকারের শত শত কোটি টাকা বিনা কারণে অপচয় হচ্ছে। মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। পরিবারের টাকা ব্যয় হচ্ছে। কোচিং ব্যবসায়ীরা ধনী হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে অভিভাবকের মূল্যবান কর্মঘণ্টা।
আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানো দরকার, পাঠ্যক্রম বদলানো দরকার, শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। বদলানো দরকার শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ। খোলা আকাশের নিচে আর যাই হোক ডিজিটাল কন্টেন্ট কিংবা সৃজনশীল পদ্ধতি হয় না। পৃথিবীর যারা বিখ্যাত মানুষ তারা কেউই সৃজনশীল পদ্ধতির পাস নয়। বহু জ্ঞানী-গুণী যেমন লালন-হাসন-গগন-রবীন্দ্র-নজরুল সৃজনশীল পাস নয়, তারা নিজেরাই সৃজনশীলতার উদাহরণ। বাংলাদেশে কোনোদিনই শিক্ষার উন্নয়ন আশা করা ঠিক হবে না যদি নাÑ (১) শিক্ষাক্ষেত্র সরাসরি সৎ-জ্ঞানী-গবেষক ও সৃজনশীল শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া না হয়। (২) সবখাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়া না হয় (বর্তমানে আমাদের দেশে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে ভারতে এর পরিমাণ ৪ শতাংশের উপরে)। (৩) শিক্ষার পরিবেশ তথা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সুস্থ-সুন্দর নিরাপদ করা না হয়, (৪) শিক্ষকদের মর্যাদা-সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা না দেওয়া হয়, (৫) পাঠ্য পুস্তকে বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা না হয় (৬) সমাজে বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে জ্ঞানের প্রতি আকাক্সক্ষা তৈরি করা না হয়।
পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ কাজ করতে চায় না। যে চায় এক সময় সেও কাজ করা থেকে বিরত হয়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পাঁচ বছরেই একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব। এই জন্য লাগবে জনগণের যৌক্তিক পরামর্শ শোনার উদারতা আর সেই অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা। বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের একজন মানুষও খুশি কিনা সন্দেহ। তবু আমাদের শিক্ষা চলছে এবং ভালো করেই চলছে। এই চলাকে বিজ্ঞাপনের জোরে চলা বলাই ভালো। বাজারে নতুন পণ্য এলে বিজ্ঞাপনের জোরে কিছু দিন তা চলেÑ তারপর ভালো না হলে আমজনতা সেই পণ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেও মানুষ এখন মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের কোনো স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের চিত্র দেখলে যে কোনো বিবেকবান মানুষই আঁতকে উঠবেন। এ দেশের কোনো স্কুলে-কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হরে ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। একজন এমএলএসএস বা নৈশ প্রহরী নিয়োগের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো শিক্ষক যখন শিক্ষাদানের মতো পবিত্র পেশায় ঢোকার আগেই মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেন তখন তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিবেন? ৭ সেপ্টেম্বর (২০১৬) দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন বের হয়Ñ যার শিরোনামÑ ‘টাকার কাছে হার মানছে মেধা।’ যারা সেই প্রতিবেদন পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কিছুদিন আগেও শিক্ষাখাতের দুর্নীতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এখন সেই দুর্নীতি যাও কমেছে তা উল্লেখ করার মতো নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে দুর্নীতির ও অব্যবস্থাপনার এমন এক কঠিন জালে আটকা পড়েছে যা থেকে মুক্তি পেতে হলে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। তার হস্তক্ষেপ ছাড়া শিক্ষা খাতের এই অচলায়তন ভাঙ্গা মোটেই সম্ভব নয়। অবশ্য তিনিও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে একবার কিছু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এসে আমাকে বলেছিলেনÑ স্যার, আমাদের কোর্স যদি তিন বছরের পরিবর্তে চার বছর করা হতো, তাহলে বিদেশে গিয়ে আমরা ইঞ্জিনিয়ারের মর্যাদা পেতাম। দেশেও রেমিটেন্স আসতো। এ সম্পর্কে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কোর্স চার বছর করার ঘোষণা দেন। তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত এস.এইচ.কে সাদেক সাহেব। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের তিন বছরের কোর্স চার বছর হতে সময় লেগেছিল সাড়ে তিন বছর। একদিন আমি আমার একটি নিবন্ধে লিখিÑ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি ডিপ্লোমা কোর্সের ব্যাপারটা এনজয় করছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও কেন এটা কার্যকর হচ্ছে না? ঘটনার উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ কার্যকর হতে সাড়ে তিন বছর লাগে সেদেশের শিক্ষা রাতারাতি বদলাবে না।
বলা হয়ে থাকে প্রকৃতিই মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় প্রকৃতির কাছে যাবার সুযোগই পায় না ছোট ছোট শিশু-কিশোরেরা। পিএসসি, জেএসসি’র মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে শিশুরা তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে ফেলছে, নষ্ট করে ফেলছে তাদের সৃজনশীলতা। সারাক্ষণ চার দেয়ালে বন্দী থেকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হচ্ছে আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন। শিশুদের উপর থেকে যতটা সম্ভব লেখাপড়ার চাপ কমাতে হবে। এ জন্য সময়ের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবই থেকে আবোল-তাবোল বিষয় বাদ দিয়ে যুগোপযোগী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে উদাসীন হওয়া মোটেই চলবে না। বর্তমান শিক্ষা আইনে শিক্ষকদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে কিন্তু গবেষণার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়নিÑ এটাও একটু ভেবে দেখা দরকার। আরো ভেবে দেখাÑ একজন এসি ল্যান্ডের চেয়ে একজন অধ্যাপক পদ-পদবিতে অনেক মর্যাদাবানÑ অথচ এসি ল্যান্ডের জন্য সত্তর লক্ষ টাকা দামের গাড়ি কেনার, উন্নত আবাসনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে কিন্তু অধ্যাপকদের জন্য ন্যূনতম জীবনমানের নিশ্চয়তা নেই। এ বিষয়গুলোও সুনজরে আনা দরকার। কিছুদিন আগে বিবিসি-র একটি সাক্ষাৎকারমুলক অনুষ্ঠানে শুনছিলাম। সেখানে তরুণ প্রজন্মকে তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কেউই শিক্ষক হতে আগ্রহ দেখায়নি। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেÑ শিক্ষকতা পেশায় কোনো জৌলুস নেইÑ সচ্ছলতা নেই, জীবন উপভোগের কোনো ব্যবস্থাই নেই। সুতরাং সর্বস্ব ত্যাগ করে মেধা দিতে এখনকার প্রজন্ম আগ্রহী নয়। কথাটা শুনতে যতই খারাপ শোনাক আসলে এটাই বাস্তবতা।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছেÑ আমেরিকা তার সামরিক খাতে বছরে ব্যয় করে ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর শিক্ষা খাতে ব্যয় করে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃত শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সামরিক খাতে এ অর্থ অপচয় আমেরিকাকে তো আজ সর্বস্বান্ত করছেই সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীকেও ফেলেছে চরম হুমকির মধ্যে। এই হুমকি আরো প্রকট হবে যদি ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের মতো বদ্ধ পাগল প্রেসিডেন্ট হয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ যেভাবে চলছে, এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে আমরাও ট্রাম্পের মতো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য প্রেসিডেন্ট হয়তো পাবো।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-৭৪) সাহেবের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেনÑ ‘জ্ঞানার্জন ধনাজনের চেয়ে মহত্তর’Ñ এ কথা যদি সত্যি সত্যি আমরা বিশ্বাস করি, তাহলে অবশ্যই জ্ঞানার্জনের পথ সহজ, সুন্দর ও নান্দনিক করতে হবে। সংখ্যাগত পাস না বাড়িয়ে গুণগত পাস বাড়াতে হবে। কোচিং, গাইড বই, প্রশ্ন ফাঁসের মতো ব্যবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে, যাতে টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা যায়। শিক্ষা সংক্রান্ত সকল প্রতিষ্ঠানের অবাধ দুর্নীতি নির্মূল করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে দেশের কোনো উন্নয়ন ফলপ্রসূ হবে না। আগে মানুষকে মানুষ বানাতে হবে। মানুষ যদি সত্যিকারের মানুষ হয়, উন্নয়ন অবশ্যই সম্ভব।
১১ অক্টোবর, ২০১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 9 10 11 12
May 7th, 2016

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি মোনায়েম সরকার রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু পণ্ডিত সম্মান পায় […]

May 6th, 2016

যুগে যুগে সমাজ বিবর্তনের ধারায় শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা

পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রীদের যখন সোনালি দিন ছিল, তখন মে দিবস উদযাপিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আর […]

June 25th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয় অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহ্‌মদ ভূগোল ও ইতিহাস বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্রভূমি […]

June 25th, 2015

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০, ২৭ জানুয়ারি

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে  পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০ ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দিন বদলের অঙ্গীকারের […]

June 25th, 2015

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture 25 January 2011 Bangladesh National Museum MICROCREDIT: A PANACEA OR A VILLAIN Introduction […]

June 24th, 2015

International Terrorism: Bangladesh Context

  Seminar Paper 8 December 2004 at CIRDAP auditorium International Terrorism: Bangladesh Context C M Shafi Sami   Introduction Historically […]

June 24th, 2015

কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা-২০০৯-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ড· মো· আনোয়ার হোসেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ […]

June 24th, 2015

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সমবেত সুধীমন্ডলী, […]

June 24th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা-২৫ আগস্ট ২০১২-বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

বাংলাদেশে সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারা – মইনুল ইসলাম সুধীমণ্ডলী, বক্তৃতার শুরুতেই আমি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা […]

June 20th, 2015

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি                           […]