List

ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মাত্র নয় মাস সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি এত তাজা প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণহত্যা অত্যন্ত স্মরণীয় একটি ঘটনা। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মানুষের উপর গণহত্যা চালায়। তাদের সেই নিষ্ঠুর গণহত্যা পৃথিবীর সকল গণহত্যাকে ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও সময়ের ব্যবধানে তা তলিয়ে যায়। আজ সময় এসেছে বাংলাদেশের গণহত্যার পুনর্মূল্যায়নের। বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা পৃথিবীবাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলে প্রকারান্তরে তা পৃথিবীর দেশে দেশে সংঘটিত গণহত্যাগুলোও বিশ্ববিবেক আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের গণহত্যার বিপক্ষে প্রথম যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়ান- তার নাম পদগোর্নি। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতবর্ষের ঋণ মনে রেখেও বলা যায়Ñ তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিমান নেতা যখন পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে বললেন- ÔStop GenosideÕ তখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশের গণহত্যাকে সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে দেখতে শুরু করে। ‘জেনোসাইড’ বলতে যে ভয়ংকর নৃশংসতা বোঝায়, তা মোকাবিলায় বিশ্বসমাজের অবস্থান প্রকাশ পায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের কঠোরতায়। গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণ ও গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ২০১৫ সালে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জেনেভায় জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল, সেই দিনটিকে তাই জাতিসংঘ বেছে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধের দিন হিসেবে। পাশাপাশি জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন করছে গণহত্যার শিকার কয়েকটি জাতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্ট, আর্মেনিয়া কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যা স্মরণে রয়েছে আলাদা জাতীয় দিবস।
২০১৭ সালে জাতীয় গণহত্যা দিবস বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পালিত হয়। এখন বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহলে। বিংশ শতাব্দীর ¯œায়ুযুদ্ধ বাংলাদেশের গণহত্যায় ভূমিকা রাখে। আমেরিকার সঙ্গে চীনও সুর মেলায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে। শক্তিশালী ওই দুই দেশ যদি পাকিস্তানিদের অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে, বন্ধুত্বের খাতিরে পাকিস্তানিদের এত আস্কারা না দিত তাহলে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের বুকে এভাবে গণহত্যা চালাতে পারতো না। আমেরিকার সপ্তম নৌবহর যদি রাশিয়ার হুমকির মুখে না ফিরে যেতোÑ তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা কত ভয়াবহ হতো তা চিন্তা করতেও শরীর শিউরে ওঠে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা বাঙালি জাতি ও হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। গণহত্যার একেবারে সূচনায়, যখন এর লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, সেই সময় ২৮ মার্চ ঢাকায় মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাড ওয়াশিংটনে প্রেরিত তাঁর গোপন বার্তার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ বা ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। বাংলাদেশের গণহত্যার সংবাদ ও ছবি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য ওয়াশিংটন পোস্টের যে সাংবাদিককে ধন্যবাদ দিতেই হয়, তার নাম সাইমন ড্রিংক। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার কথা বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচার করেছেন এবং জনমত সৃষ্টি করতে সহযোগিতা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। বাঙালি জাতি তার কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে। মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল ঘুরে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ভয়াবহতার যে ছবি মেলে ধরেছিলেন বিলেতের সানডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় সেই লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘জেনোসাইড’, সে প্রতিবেদন আলোড়ন তুলেছিল দুনিয়াব্যাপী। নয় মাসজুড়ে আরও অনেক প্রতিবেদনে গণহত্যার মর্মস্পর্শী বহু বিবরণ প্রকাশ পেয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সংবাদের প্রাক্কালে পাওয়া গেল বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের মতো নিষ্ঠুরতার বিবরণ, যা ছিল জাতি ধ্বংসের লক্ষ্যে চূড়ান্ত আঘাত।
অজ¯্র তথ্য-প্রমাণ-সংবাদ রয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা ঘিরে, নানাভাবে আলোচিত হয়েছে এর নৃশংসতা। এই গণহত্যা অস্বীকারের কোনো উপায় ছিল না, তারপরও অস্বীকারের চেষ্টা নানাভাবে দেখা গিয়েছিল এবং এখনো তার দেখা মেলে। একাত্তরের বাংলাদেশ তৎকালীন বিশ্ব গণমাধ্যমে, সিনেটে পার্লামেন্টে, সভা-সমাবেশ-মিছিলে বড়ভাবে জায়গা পেলেও বিজয়ের পর খুব দ্রুতই আলোচনা থেকে হারিয়ে যায় বাংলাদেশ, গণহত্যা তলিয়ে যায় বিস্মৃতিতে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একাত্তরের গণহত্যার পুনঃপ্রতিষ্ঠা খুব জরুরি। তবে তার চেয়ে গুরুত্ববহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমাদের মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের আরেকটি ঐতিহাসিক ক্ষণ, যখন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট’। গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য প্রথম বিধিবদ্ধ আইন। সেদিন সংসদে প্রদত্ত সমাপনী ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব তুলে ধরে আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বলেছিলেন, ‘আমরা এদের (যুদ্ধাপরাধীদের) মনে করি শুধু বাংলাদেশের শত্রু নয়, মানবতার শত্রু। সেই হিসেবে আমরা তাদের বিচার করতে যাচ্ছি। সেই দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের সভ্য মানবসমাজের কর্তব্য এদের নিন্দা করা, ঘৃণা করা, ধিক্কার দেওয়া।’
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অ্যাডহক ভিত্তিতে গঠিত দুই বিচারশালা, নুরেমবার্গ ও টোকিও আদালত ছিল মানবজাতি ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ভয়াবহ ও ব্যাপক পাশবিকতার বিচারে অভিনব পদক্ষেপ। এই অভিজ্ঞতার নির্যাস মেলে ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে, যেখানে অপরাধসমূহ সংজ্ঞায়িত হয় জেনোসাইড, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি বিধি অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠা পাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতÑ এমনটাই ছিল প্রত্যাশা। তবে নানা কারণে সেই প্রত্যাশা-পূরণ আর ঘটেনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে বিশ্বসমাজের করার কিছু ছিল না। সেই সময় গণহত্যা বিচারে না ছিল আইন, না ছিল আদালত, না ছিল গণহত্যা প্রতিরোধে জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগ। তাই বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল বিতর্ক হয়েছে, শরণার্থী দুর্গতির মানবিক দিক নিয়ে ছিল আলোচনা ও উদ্যোগ, কিন্তু গণহত্যা ও তা প্রতিরোধ নিয়ে জাতিসংঘ ছিল নিশ্চুপ। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে গণহত্যা অধ্যয়নে অগ্রণী অধ্যাপক অ্যাডাম জোন্সের উক্তি, যিনি দ্য স্কোর্জ অব জেনোসাইডসহ আরও বহু বইয়ের প্রণেতা। যা দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৪ সালে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গুরুত্ব মেলে ধরে বলেন, ‘এটা (আইসিটি-বিডি) ছিল গণহত্যার বিচারের বিধিবদ্ধ প্রয়াসে অগ্রগণ্য, ইতিহাসের প্রথম পদক্ষেপ যেখানে ‘জেনোসাইড’ শব্দবন্ধ মুখ্য ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে জোন্স বলেন, ‘যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া ও সিয়েরা লিওনে প্রতিষ্ঠিত অ্যাডহক ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর আগে নয়, কয়েক যুগ আগে বাংলাদেশ এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আইসিটি (বাংলাদেশ) খুব স্বল্পই পরিচিতি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের গণহত্যা তুলনামূলক গণহত্যা অধ্যয়ন বিশেষজ্ঞ, বিশেষভাবে আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা খুব সামান্যই বিবেচিত হয়েছে।’
বাংলাদেশের গণহত্যা যে বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পায়নি, সেটা নিয়ে গণহত্যার শিকার জাতি হিসেবে আমাদের খেদ থাকাটা স্বাভাবিক। এখানে স্মরণ করতে হবে এই সমস্যা যতটা না বাংলাদেশের তার চেয়ে বেশি মানবসভ্যতার। গণহত্যার শিকার মানুষদের প্রতি বিশ্বসমাজ দায়বদ্ধ, এই দায়মোচনে বিশ্বসমাজের ব্যর্থতার বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি। তবে কোনো উচ্চ মহল বা সংস্থায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দেন-দরবারের চেয়েও বড় দিক হলো বিশ্বসমাজকে তাদের দায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতার অবসান ঘটেছে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে। ট্রাইব্যুনালে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিধিবদ্ধভাবে একের পর এক বিচার সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর হচ্ছে। প্রায় চার দশক পরে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের বিচারে বাংলাদেশ তৈরি করল উদাহরণ।
বাংলাদেশ বহু বাধা পেরিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে বহু পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বিচার গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বিচারের আওতামুক্ত রয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা। পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগনামা তৈরি হয়েছিল তাদের ছাড়িয়ে নিতে প্রবল চাপ তৈরি করেছিল পশ্চিমা ক্ষমতাবান মহল, চীনা নেতৃত্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল রাজন্যবর্গ। বস্তুত তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অশুভ আঁতাত। আর এর ফলে পার পেয়ে যায় গণহত্যাকারীরা। আজ তাই তলিয়ে দেখতে হবে কেন নয় মাসজুড়ে বাংলাদেশে অবাধে গণহত্যা পরিচালনা করতে পারল পাকিস্তানিরা, কেন পরাজিত হয়ে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণের পরও গণহত্যাকারীদের বিচার করা গেল না। গণহত্যার বিচার যদি হয় বিশ্বসমাজের অঙ্গীকার তবে এ ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা ও নতুন পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
গণহত্যার সূত্র ধরে জেগে উঠছে মার্কিন প্রশাসন তথা নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভূমিকা। আমরা যদি অতীত থেকে শিক্ষা নিতে চাই তবে এই ভূমিকার আরও গভীর বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন হবে। দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে ক্রিস্টোফার হিচেন্স দেখিয়েছেন কিসিঞ্জারের হাতে কেবল বাংলাদেশের গণহত্যার রক্ত লেগে নেই, পূর্ব তিমুর, চিলি, আর্জেন্টিনাসহ কয়েকটি দেশের মানবতাবিরোধী নৃশংসতার পেছনেও কাজ করেছে তাঁর অমানবিক ইন্ধন ও মদদ।
গণহত্যার শিকার মানুষদের স্মরণে কোটি দীপ প্রজ্বলিত হয়েছে বাংলাদেশে। এই অগ্নিশিখা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়। আমাদের প্রত্যাশা, গণহত্যাকারীরা যেন পার পেয়ে না যায়, বিশ্ব সম্প্রদায় যেন তাদের নিন্দাবাদে মুখর হয়, তাদের ঘৃণা করতে শেখে, তাদের প্রতি ধিক্কার জানাতে পারে। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বইপত্র গবেষণাকর্মে আবার ফিরে আসছে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি, কেন কীভাবে এই গণহত্যা সংঘটিত হতে পারল, সেটা নিয়ে উঠছে বিতর্ক এবং মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নানাভাবে।
বিশ্বের অনেকেই যেমনÑ গ্যারি জে ব্যাস, শ্রীনাথ রাঘবন, সলিল ত্রিপাঠী, বীণা দি কস্তা, নয়নিকা মুখার্জি প্রমুখ বাংলাদেশের গণহত্যা উপজীব্য করে তথ্যসমৃদ্ধ বই আমাদের উপহার দিয়েছেন। এর আগে লিও কুপার, আর. জে. রামেল, স্যামুয়েল টোটেন প্রমুখের বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার সবিস্তার উল্লেখ আমরা দেখতে পেয়েছি। তবে সেসব ছিল ব্যতিক্রম। গণহত্যা-বিষয়ক বহু তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশনায় বাংলাদেশের গণহত্যা হয় একেবারে উপেক্ষিত হয়েছিল, কিংবা সামান্যই উল্লিখিত হয়েছিল। সে অবস্থার অবসান ঘটিয়ে গবেষক-মহলে একাত্তরের গণহত্যা ক্রমে স্বীকৃতি অর্জন করছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বেশ কয়েক বছর যাবৎ তিন-চারটি গবেষণাপত্রে উদ্দিষ্ট হয়েছে একাত্তরের গণহত্যা। ইয়েল ল’ স্কুলের হিউম্যান রাইটস ক্লিনিক ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচার আয়োজনের আইনগত বৈধতার প্রশ্নে অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবস্থান বিশ্লেষণ করে তাদের ইতিবাচক পর্যবেক্ষণ মেলে ধরেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির আইন বিভাগ নারী নির্যাতনের বিচারকালে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে মেলে ধরেছিল। এ মুহূর্তে কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানির খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী বাংলাদেশের গণহত্যা ও বিচার বিষয়ে গবেষণার কাজ করছেন। একাত্তরের গণহত্যা আবার নতুন করে বিশ্বসমাজের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হচ্ছে। ইতিহাসের এই স্বীকৃতি অর্থময় করে তুলতে আমাদের অনেক কাজ রয়েছে। বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে নিবিড় অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ, গবেষণা, পর্যালোচনা থেকে এর মূল শিক্ষা অনুধাবন এবং তার ভিত্তিতে গণহত্যার মতো নিষ্ঠুরতার চির-অবসান ঘটিয়ে সভ্যতার অগ্রগমনে আমাদেরও যোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে জীবন-জীবিকা-জলবায়ু। জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীবাসীকে এই মুহূর্তে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষের এখন উচিত মারণাস্ত্র না বানিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে কিন্তু জমি বাড়ছে না। কিভাবে মানুষের জন্য গুণগত মান সমৃদ্ধ উন্নত খাদ্য উৎপদন করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এ বিষয়ে নভোচারীদের জন্য ব্যবহৃত খাদ্য দ্রব্যের কথাও স্মরণে রাখা যেতে পারে। পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ওয়ারহেড মিসাইলÑ এগুলো না বানিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণায়ন এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদার দিকে নজর দেওয়াই এখন মঙ্গল হবে।
পরিশেষে বলতে চাই ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইত্যাদি। আমরা দাবি করছি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাক। এটি এখন সময়ের দাবি। এই দাবি পূরণ হলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সংঘটিত গণহত্যাও ঐতিহাসিক মূল্য পাবে।
০২ ডিসেম্বর, ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 9 10 11 12
May 7th, 2016

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি মোনায়েম সরকার রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু পণ্ডিত সম্মান পায় […]

May 6th, 2016

যুগে যুগে সমাজ বিবর্তনের ধারায় শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা

পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রীদের যখন সোনালি দিন ছিল, তখন মে দিবস উদযাপিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আর […]

June 25th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয় অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহ্‌মদ ভূগোল ও ইতিহাস বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্রভূমি […]

June 25th, 2015

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০, ২৭ জানুয়ারি

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে  পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০ ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দিন বদলের অঙ্গীকারের […]

June 25th, 2015

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture 25 January 2011 Bangladesh National Museum MICROCREDIT: A PANACEA OR A VILLAIN Introduction […]

June 24th, 2015

International Terrorism: Bangladesh Context

  Seminar Paper 8 December 2004 at CIRDAP auditorium International Terrorism: Bangladesh Context C M Shafi Sami   Introduction Historically […]

June 24th, 2015

কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা-২০০৯-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ড· মো· আনোয়ার হোসেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ […]

June 24th, 2015

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সমবেত সুধীমন্ডলী, […]

June 24th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা-২৫ আগস্ট ২০১২-বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

বাংলাদেশে সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারা – মইনুল ইসলাম সুধীমণ্ডলী, বক্তৃতার শুরুতেই আমি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা […]

June 20th, 2015

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি                           […]