List

কয়েকদিন আগে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন কোন পক্ষে যাবেন’Ñ শিরোনামে। যেখানে আমি নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি কিভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আমার সে লেখায় এটাও বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার মাটিতে বিএনপি নামক ঘাতক দলের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এবং কারা প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীকে হত্যা করেছে, যে বিএনপি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংস গ্রেনেড হামলায় প্রত্যক্ষ মদদ জুগিয়েছে, সেই বিএনপির আসলেই কি কোনো অধিকার থাকতে পারে বাংলাদেশে রাজনীতি করার? জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নানামুখী চক্রান্ত করে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে। জিয়াউর রহমান দল গঠন করে দেশদ্রোহী-রাজাকারদের বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করেছিলেন, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমান জিয়া নির্দেশিত পথেই এগিয়ে গেছেন।
জিয়া পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই করেছেন। খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু আপন কন্যার মতোই ¯েœহ করতেন। খালেদা জিয়ার ভাঙ্গা সংসার বঙ্গবন্ধুই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এত আদর-¯েœহের মূল্য জিয়া দিয়েছেন ‘বুলেট’ দিয়ে, আর তার স্ত্রী-পুত্র দিয়েছেন ‘গ্রেনেড’ দিয়ে। মানুষ একটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে, ক্ষমতা ও স্বার্থের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে, জিয়া পরিবারকে না দেখলে বাংলাদেশের মানুষ কিছুতেই তা বুঝতে পারতেন না।
কথায় বলেÑ ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। আসলেই ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির রায়ের কল নড়েছিল ২৩ বছর ২ মাস পরে আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয় ১৪ বছর ২ মাস ১৯ দিনের মাথায়। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আদালতের রায়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুখোশ খুলে গেছে ষড়যন্ত্রকারীদের। আজ শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, পৃথিবীর নানান দেশের মানুষই বুঝতে পারছে বিএনপি স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, বিএনপির বিশ্বাস হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল, তাই জামায়াত তাদের বন্ধু।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বিকেল ৫.৪০ মিনিটে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ জন নিরপরাধ নেতাকর্মী। এর মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানও আছেন। আহত হন পাঁচশ’র অধিক নেতাকর্মী। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিবালোকে এমন নৃশংস ঘটনার আর কোনো নজির নেই। সবশেষে শেখ হাসিনাকে বহন করা গাড়িতেও কয়েকটি গুলি করেছিল তাকে হত্যার জন্য। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মূলত শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হলেও, এর পেছনে ছিল আরও গভীর চক্রান্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য বানাতে চেয়েছিল, বিপথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তমূল্যে কেনা সমস্ত অর্জন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চায়নি বিএনপি ও তার দোসররা। এই হামলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সমস্ত আলামত নষ্ট করা হয়। আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপানো হয়, সাজানো হয় জজ মিয়া নাটক। নোয়াখালীর সেনবাগের শ্রমজীবী যুবক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন ওরফে জজ মিয়া নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ৪ বছর ২৬ দিন জেলখানায় কাটাতে হয়। রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয় জজ মিয়ার উপর। ক্রসফায়ারের হুমকি ও জজ মিয়ার পরিবারকে টাকা দেওয়ার শর্তে শেখানো জবানবন্দি রেকর্ড করা হয় জজ মিয়ার। তবু শেষ রক্ষা হয় না। একে একে বের হতে থাকে আসল ঘটনা। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১০ অক্টোবর, ২০১৮ সালে ঘোষিত হয় আদালতের রায়। ৪৯ জন আসামির মধ্যে ১৯ জন মৃত্যুদ-ে দ-িত হয়, যাবজ্জীবন সাজা হয় ১৯ জনের, বাকি এগারো জন পায় বিভিন্ন মেয়াদের দ-।
আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ার পরে নানাজন নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ভুক্তভোগী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ। এখানে আমি রায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না, আমি শুধু বলতে চাইÑ এই ঐতিহাসিক রায়ে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেটা হলোÑ বিএনপি একটি সন্ত্রাসী ও ঘাতক দল। হত্যা, খুন, লুটপাট ও জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। এরা চায় না বাংলাদেশ সুখে-শান্তিতে থাকুক, নিরাপদে বসবাস করুক বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। এরা ষড়যন্ত্র করে কিংবা মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহায়তা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন দেশে দুর্নীতি বেড়ে যায়, বোমাবাজি বেড়ে যায়, রাষ্ট্র খেতাব পায় অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে। বিএনপি স্পষ্টত রাষ্ট্র চালনায় ব্যর্থ এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ের আড়ালে এরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা মুখোশ পরে থাকে, কিন্তু মুখোশের আড়ালে এদের যে মুখটা আছে সেটা খুবই ভয়ঙ্কর।
একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির মামলায় দ-িত হয়ে জেলবন্দী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন পূর্বে দশ বছর সাজাপ্রাপ্ত বর্তমানে হত্যা চেষ্টার দায়ে যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। এদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি কোনো দিনই সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হবে না। আজ সময় এসেছে এদের প্রত্যাখ্যান করার। বাংলাদেশের জনগণ যত তাড়াতাড়ি বিএনপি ও তার জোটভুক্ত দলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ততই তা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। বিএনপি পদে পদে ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে। যারা নৃশংস, সন্ত্রাসী, ব্যর্থ এবং অযোগ্য তাদের হাতে দেশ ও দেশের মানুষ কিছুতেই নিরাপদ থাকতে পারে না।
আমি প্রথমেই বলেছিলাম আমার পূর্ববর্তী একটি নিবন্ধের কথাÑ ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন কোন্ পক্ষে যাবেন।’ আজ আবার এই প্রশ্ন উত্থাপন করে বলতে চাইÑ বাংলাদেশের মানুষ কোন্ পক্ষে যেতে চায়? তারা কি হত্যায় বিশ্বাসী, মৌলবাদে উস্কানিদাতা, দুর্নীতিবাজ বিএনপির সঙ্গে যাবে? বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবী, দল এবং যারা জোট করতে চান তাদেরও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবে? বাংলাদেশের মানুষ খুবই আবেগপ্রবণ, তাদের মনও অত্যন্ত কোমল। বাঙালি আবেগপ্রবণ আর কোমল মনের বলে অনেক সহজেই এরা ক্ষমাশীল। ক্ষমা মহৎ গুণ বটে। তবে ঘাতককে, দেশদ্রোহীকে ক্ষমা করার কোনো মানে নেই। এদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে বয়কট করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাদের হাত শক্তিশালী করতে হবে। নির্দ্বিধায় গণরায় দিতে হবে দেশপ্রেমিক, উন্নয়নমুখী, পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক দলকে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে, বিদেশেও মর্যাদা বাড়ছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বিএনপি নয়Ñ আওয়ামী লীগই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১৩ অক্টোবর, ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 9 10 11 12
May 7th, 2016

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনোস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি মোনায়েম সরকার রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু পণ্ডিত সম্মান পায় […]

May 6th, 2016

যুগে যুগে সমাজ বিবর্তনের ধারায় শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা

পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রীদের যখন সোনালি দিন ছিল, তখন মে দিবস উদযাপিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আর […]

June 25th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয় অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহ্‌মদ ভূগোল ও ইতিহাস বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্রভূমি […]

June 25th, 2015

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০, ২৭ জানুয়ারি

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে  পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০ ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দিন বদলের অঙ্গীকারের […]

June 25th, 2015

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture

Shah A M S Kibria 6th Memorial Lecture 25 January 2011 Bangladesh National Museum MICROCREDIT: A PANACEA OR A VILLAIN Introduction […]

June 24th, 2015

International Terrorism: Bangladesh Context

  Seminar Paper 8 December 2004 at CIRDAP auditorium International Terrorism: Bangladesh Context C M Shafi Sami   Introduction Historically […]

June 24th, 2015

কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা-২০০৯-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ড· মো· আনোয়ার হোসেন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ […]

June 24th, 2015

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্মারক বক্তৃতা বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সমবেত সুধীমন্ডলী, […]

June 24th, 2015

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা-২৫ আগস্ট ২০১২-বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

বাংলাদেশে সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারা – মইনুল ইসলাম সুধীমণ্ডলী, বক্তৃতার শুরুতেই আমি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা […]

June 20th, 2015

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি

১৯৯৭-১৯৯৮ সালে পি·এন· হাকসারের লেখা কয়েকটি চিঠি                           […]