বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা
মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, ঠিক মতো এর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। কোন দল ভাঙবে আর কোন দল গড়বে এটা অনুমান করে বলার উপায় নেই। এমনকি সমমনা দলের সঙ্গে জোট গঠন করেও ভোটের আগে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিশ্বের সবদেশেই রাজনীতি এখন হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও চলছে অস্থিরতা, উন্মাদনা, দল থেকে পদত্যাগ ও নতুন দল গঠনের সরব গুঞ্জন। পত্র-পত্রিকায় এসব খবর প্রচার পেয়ে মানুষ এখন চায়ের কাপে ঝড় তোলার সুযোগ পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ এতদিন যা ভেবেছে, সেই ভাবনার বৃত্তে কিছুটা নতুন ভাবনা সংযোজন-বিয়োজন হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে গণমানুষের রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগকেই বোঝায়। আওয়ামী লীগের আগে ছিল মুসলিম লীগÑ সেটাও গণমানুষের দলই ছিল। আওয়ামী লীগ উঠে এসেছে মানুষের অন্তর আর মাটির গভীর থেকে। ইচ্ছে করলেই এই দল বিনষ্ট করা সম্ভব নয়। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই দলের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। বাংলাদেশ পেয়েছে লাল সবুজের পতাকা। আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ আছে, আছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সাংগঠনিক শক্তি। যার ফলে অনেক ষড়যন্ত্রের মুখে পড়েও এই দল ধ্বংস হয়নি। একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। সাময়িক বিপদে আওয়ামী লীগ বহুবারই পড়েছে কিন্তু কখনোই চিরতরে মুছে যায়নি।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তির মতো শক্তিশালী আর কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে নেই। বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টিÑ এই দুটি দলই ভূঁইফোড় রাজনৈতিক দল। এ দুটো দলই বন্দুকের নল সামনে রেখে জনগণকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে বাংলার জমিনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। আজো বসে আছে। সামনে আরো কতদিন এদের পেতাত্মাদের দেখতে হবেÑ সে কথা এখনই বলা যাবে না। কেননা রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে এক সময় বাম রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তির তুলনা করা হতো। বামরা বাংলাদেশে নিজের স্বার্থ নিয়ে অতিরিক্ত টানাটানি করলে, সবাই দলীয় প্রধান হওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির করলে বাম দলগুলো তীব্র ভাঙনের মুখে পড়ে। বামদের নীতি-আদর্শ বইয়ের পাতায় যতটা দেখা যায়, বাংলাদেশের বাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মাঝে বিশেষ করে দলীয় প্রধানদের মাঝে সেসবের ঘাটতি আছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তা নাহলে আজকের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শক্তির সঙ্গে একমাত্র বাম শক্তিরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার কথা ছিলÑ অথচ বামদের দুরবিন দিয়ে সংসদে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন যে সব কথিত বাম সংসদ ভবনের ঝলমলে পরিবেশে বসে আইন প্রণয়ন করছেনÑ তাদের অন্তরে যা কিছু থাকÑ পারাপার হচ্ছে ‘নৌকা’য় চেপেই।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে তুমুল বিতর্ক উঠেছে বাংলাদেশে। এই বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তার আকস্মিক পদত্যাগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছিল বহুদিন ধরেই, সে কথা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু সেই দ্বন্দ্ব যে এত চরমে পৌঁছে গেছেÑ এটা এখন জানা যাচ্ছে নানান রকম ঘটনা-দুর্ঘটনার মাধ্যমে।
জামায়াত নেতা ব্যরিস্টার আবদুর রাজ্জাককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, ব্যারিস্টার রাজ্জাককে না চিনলেও তার একটি বিশেষ ঘটনার কথা আমার মনে দাগ কেটে আছে। অনেক দিন আগের অর্থাৎ ১৯৯১ সালের কথা। আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টশিয়াল প্রার্থী ছিলেন বদরুল হায়দার চৌধুরী। তাকে আমি মামা বলে ডাকতাম। তিনিও আমাকে মামা বলেই সম্বোধন করতেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কাজে বদরুল মামার বাসায় আমি ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ যখনই যেতামÑ তখনই দেখতাম বদরুল মামার বারান্দায় চেয়ার পেতে একজন যুবক বসে আছেন। আমি একদিন বদরুল মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা বারান্দায় বসা লোকটি কে?’ মামা বললেন, ‘উনি একজন ব্যারিস্টার। নাম আবদুর রাজ্জাক। পরে জেনেছি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা সমঝোতা করার জন্য আবদুর রাজ্জাক দল থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। সেদিন আবদুর রাজ্জাকের নিজ দলের প্রতি আনুগত্য দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। একজন ব্যারিস্টার তার নিজ দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি সমঝোতা বা ওরকম কিছু একটা করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বারান্দায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করা সাধারণ ব্যাপার নয়। পরে জেনেছি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক তার দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছিলেন। অর্থাৎ জামায়াতের তৎকালীন আমীর গোলাম আযমের সঙ্গে তিনি গোলাম আযমের বাসায় বদরুল হায়দারের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও দলীয় সিনিয়র নেতাদের তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে মুক্ত করতে পারেন নি।
আজকের প্রেক্ষাপটে আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ কতটা যৌক্তিক বা আদৌ যৌক্তিক কিনা সে বিষয়ে আলোচনায় যাবো না। এখনো শুধু একটা কথা বলতে চাইÑ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলাতে শুরু করেছে। যে কারণেই হোক বাংলাদেশের মানুষ এখন সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মানসিক শক্তি অর্জন করছে। আজকে যখন শুনি জামায়াতে ইসলামের ভেতরে একাত্তরের কর্মকা- নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে দলীয় কোন্দল চরমে পৌঁছেছে, দলের নাম ও নীতি-আদর্শে পরিবর্তন আসছে কিংবা পরিবর্তন আনার জন্য জামায়াতে ইসলামের লোকজন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন বুঝতে পারি, বাংলাদেশে শুধু উন্নয়ন হচ্ছে না, রাজনৈতিক নেতারাও পুরনো রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক চিন্তার সমন্বয় ঘটাতে চাইছেন এবং এই উপলব্ধিটা দেরিতে হলেও শুভ উদ্যোগ বলেই আমি মনে করি। তবে এখানে আরেকটি কথাও না বলে পারছি নাÑ ব্যারিস্টার রাজ্জাকরা যখন অতীত ভুল বুঝতে পেরে দল ছেড়ে আসতে শুরু করেছেন, তখনও ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস ও কতিপয় প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদকরা কিভাবে জামায়াতের সঙ্গে এবং বাংলাদেশবিরোধী তথা সা¤্রাজ্যবাদী চক্রের সঙ্গে রাজনীতি করতে যান বুঝে উঠতে পারি না। এদেরও বোধোদয় হওয়া দরকার।
জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি এতদিন বাংলাদেশের নীতি-আদর্শের পরিপন্থী ছিল বলেই মনে করেছে বাংলাদেশের মানুষ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের অপকর্মের কথা সে সময়ের পত্র-পত্রিকায় লিপিবদ্ধ আছে। ইচ্ছে করলেই কেউ সেই অপকর্ম ও মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো আড়াল করতে পারবে না, সুতরাং কেবল মৌখিক ক্ষমা নয়, আন্তরিকভাবেও জামায়াতে ইসলামকে শুদ্ধ হতে হবে এবং পাকিস্তানি ভাবধারা ত্যাগ করে সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। সারা পৃথিবীতেই এখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক পৃথিবীতে ধর্ম নয়Ñ পারস্পরিক সম্প্রীতিই রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি। সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করতে না পারলে সেই দল নিয়ে বেশি দূর এগুনো সম্ভব হবে না।
দেশের সব মানুষ একই রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক হবেন এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু সেই বিরোধী মতটাও যেন দেশের সংবিধানের সঙ্গে কোনো ভাবে সাংঘর্ষিক না হয়, সেই বিষয়ে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সামাজিক সাম্যে আস্থাবান দেশ। এ দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাময়িক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে কিন্তু পরিণাম হবে ভয়াবহ। সুতরাং ধর্মীয় খোলসে রাজনীতি করে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আগামী দিনের বাংলাদেশে কেউ ফায়দা লুটতে পারবে না।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। যারা বাংলাদেশের উত্থানে বিঘœ সৃষ্টি করবে এদেশের সাধারণ মানুষ কিছুতেই তাদের সহ্য করবে না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অতীতে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তারা ধ্বংস হয়েছে। ভবিষ্যতে যারা ষড়যন্ত্র করবে, তারাও ধ্বংস হবে।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
Leave a Reply