List

ঢাকার বাইরে অবস্থান করে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় লিপ্ত এবং যাদের লেখা পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় এদের মধ্যে সিলেটের ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, চট্টগ্রামের আবুল মোমেন, রাজশাহীর হাসান আজিজুল হকের লেখা আমি মনোযোগের সঙ্গে পড়ি। তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেসব জ্ঞানগর্ভ লেখা লেখেন আমি সেসবের প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করি না। ঢাকা শহরে যেসব বুদ্ধিজীবী রয়েছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার উঠাবসা হয়, কিন্তু ঢাকার বাইরে যারা থাকেন তাদের সঙ্গে টেলিফোন বা মোবাইল ফোন ছাড়া কথা হয় না। তাই এদের লেখা পড়ে এদের সঙ্গে যুক্ত থাকার চেষ্টা করি।
১৬ জুন, ২০১৭ তারিখে আমাদেরসময় পত্রিকায় ড. জাফর ইকবাল চমৎকার একটি কলাম লিখেছেন। ওই কলাম আরো কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমি খুব মনোযোগ দিয়েই লেখাটি পড়েছি। লেখার মান ও বিষয় নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। ড. জাফর ইকবাল বিষয় নির্বাচনে যেমন পটু। তেমনি তার লেখাও মনোগ্রাহী। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় নিয়ে তিনি যা লিখেছেন আসলেই তা মর্মস্পর্শী। আমার বক্তব্য ড. জাফর ইকবালের লেখার বিষয় নিয়ে নয়, বিষয়ের শিরোনাম নিয়ে। তিনি তার লেখার শিরোনাম দিয়েছেন ‘পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে’।
কেন তিনি এমন একটি সুন্দর লেখার শিরোনামে স্বপ্নের পদ্মা ব্রিজের প্রসঙ্গ টানলেন আমার বোধগম্য হয়নি। তার লেখা পড়ে মনে হলো পদ্মা ব্রিজ হলে এদেশের কোনো লাভ নেই। দেশের কোনোই কাজে আসবে না বিশাল বাজেটের পদ্মা সেতু। এমন একটি আবেগস্পর্শী লেখার শিরোনামে কেন ড. জাফর ইকবাল পদ্মা ব্রিজের প্রসঙ্গ টানলেন তা নিয়ে আমি বেশ কিছুক্ষণ ভেবেছি। ভেবে ভেবে কিছু একটা লেখার তাগিদ বোধ করেছি। সেই জন্যই আজকের এই লেখার অবতারণা।
কিছু কিছু লেখক আছেন যারা তাদের লেখা নিয়ে পাবলিকের সঙ্গে ‘খেলেন’। যারা নতুন লেখক, যারা জনপ্রিয়তা পাওয়ার প্রত্যাশী তারাই চটকদারি শিরোনাম দিয়ে জনগণের সঙ্গে ‘খেলে’ থাকেন। ড. জাফর ইকবাল বাংলাদেশে এখন একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। তার জনপ্রিয়তাও ঈর্ষা করার মতো। তার পাঠকের সংখ্যা অগণিত। তার মতো একজন বড় লেখকের পাঠক টানার গরজ থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমার মনে হয় ব্যাপারটার বীজ অন্যখানে লুকিয়ে আছে। আমি ড. জাফর ইকবাল সম্পর্কে বলার পূর্বে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রসঙ্গে কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলতে চাই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল বুদ্ধিজীবী আওয়ামীবিদ্বেষী ও ভারতবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতেন। তারা এখনও সক্রিয় আছেন। তাদের সেই সক্রিয়তা বর্তমান প্রজন্মকেই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এই সুচতুর গোষ্ঠীবদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা পঁচাত্তর-পরবর্তী কালপর্ব থেকে বর্তমানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদ্গার করে যাচ্ছেন। এ সকল জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবী বুঝতে পারছেন না, আওয়ামীবিদ্বেষী বা ভারত বিদ্বেষী হয়ে তারা মূলত বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যেতে চান। তারা এখনও প্রহর গুণছেন পাকিস্তানি মৌলবাদী ভাবধারায় বাংলাদেশ নিয়ে যেতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বাংলার মাটিতে তারা এ সুযোগ আর কোনোদিনই পাবেন না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন, তারা কোনোকিছুতেই ইতিবাচক কিছু খুঁজে পান না। ভালো কাজের মধ্যেও মন্দকে খুঁজে বের করা তাদের একমাত্র কাজ। এসব বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যেতে চান। এরা সেই অন্ধকার চানÑ যে অন্ধকারে দেশ ঢেকে গেলে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল হবে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা কোনো ভালো কাজ নয়। অন্তত বুদ্ধিজীবী পদবাচ্য যাদের গায়ে লেগেছে তাদের পক্ষে ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা’কে আমি পাপ বলেই গণ্য করি। আমাদের দেশের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী সময়ের হাওয়া ধরে পাল তোলার চেষ্টা করেন। এ ঘটনা পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বিভিন্ন সামরিক সরকারের সময়ে দেখেছি, এমনকি মৌলবাদ ও পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও দেখেছি। বুদ্ধিজীবীদের সর্বশেষ দ্বিমুখিতা দেখেছি ১/১১-এর ঐতিহাসিক দুঃসময়ে। তখন যাদের কলাম-বক্তৃতা পেপারে-টেলিভিশনে পড়েছি-শুনেছি, আজ তারা অনেকেই হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে গেছেন ১/১১-এর কুশীলব ও তাদের মদতদাতা ডক্টর গং। সত্য মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যায় বটে, তবে বেশিক্ষণ সত্য ঢেকে রাখা যায় না। সত্য স্বপ্রকাশ। সে নিজে নিজেই বেরিয়ে আসে। সত্যকে যারা মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে মিথ্যা বানাতে চায় তারাই মিথ্যুক বলে একদিন প্রমাণিত হয়ে যায়।
একটি কথা না বললেই নয়Ñ বিগত ২১ বছরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে এদেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়, যারা বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চায় পাকিস্তানি ভাবধারায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলে ২১ বছর বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকে বাংলাদেশ বিরোধীচক্র ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই একুশ বছরে বাংলাদেশ উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে। স্বাধীন-সার্বভৌম ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিবর্তে এখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি। তারা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়। এর ফলে এখানে তৈরি হয় ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে তৈরি হয় একদল সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী। এরা কারণে-অকারণে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এদের চোখে আওয়ামী লীগের কোনোকিছুই ভালো নয়। আওয়ামী লীগ যা করে তারা তার বিরুদ্ধেই তীব্র ও মারমুখী আচরণ করতে শুরু করে। কিন্তু তারা বোঝে না, এ দেশের মানুষ এখন আর মিথ্যে কথায় ভোলে না। আজ আওয়ামী লীগের সাফল্য দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নে এখন অনেকেই বিস্মিত ও অভিভূত। এহেন পরিস্থিতিতে এই সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে গেছে। এখন তাদের উচিত, অযথা দেশের ও আওয়ামী লীগের বদনাম না করে গঠনমূলক সমালোচনায় নিজেদের নিয়োজিত করা।
যারা বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন-অগ্রগতিকে অস্বীকার করতে চান, তারা কি আবার বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় দেখতে চান? বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে এমন কী দিয়েছে যে তাদের জন্য তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের এত মায়াকান্না করতে হবে? ইনিয়ে-বিনিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে? হ্যাঁ বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে আর কিছু না দিতে পারুক, মৌলবাদকে উসকে দিতে পারে, দেশের সিরিজ বোমা হামলা করতে পারে, অবাধ ঘুষ লেনদেন করতে পারে, দেশদ্রোহী চিহ্নিত রাজাকারদের হাতে তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তে সিক্ত পতাকা তুলে দিতে পারে। যারা শহিদের রক্ত নিয়ে প্রহসন করে, তাদের পক্ষে যারা ওকালতি করতে চায়, এ দেশের প্রতিবাদী মানুষ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে।
আমি বলব না আওয়ামী লীগের কোনো দোষ নেই। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের অনেক ত্রুটি আছে। দেশ এগিয়ে গেলেও এখনও দেশে দুর্নীতি আছে, আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কোনো কোনো সেক্টরে এখনও তেমন আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। আওয়ামী লীগের দোষত্রুটি নিয়ে আমিও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করছি। আবার পাশাপাশি সরকারের সাফল্যকেও স্বাগত জানাচ্ছি। বুদ্ধিজীবীদের কাজ হলো সরকারের প্রতিটি কাজ বিচারবিশ্লেষণ করে দিকনির্দেশনা দেওয়া। সরকারকে বিভ্রান্ত বা দোষী সাব্যস্ত করা নয়।
এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বাইরে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। সুতরাং জনগণের উচিত ধৈর্য ধরে শেখ হাসিনার কাজকে সমর্থন করে যাওয়া। যেহেতু দেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করছে এবং মাথাপিছু আয়সহ জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই দিশেহারা বুদ্ধিজীবীদের বলব আপনারা পজেটিভ হন, দায় নিয়ে সমালোচনা করুন। তা না হলে এদেশের মানুষ আপনাদের কারণে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদেরও সন্দেহের চোখে দেখবে। বুদ্ধিজীবীদের সত্য বলার ও সুপথে চলার সাহস থাকা দরকার। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের বুদ্ধিজীবী সত্য বলবেন।
ফিরে যাচ্ছি ড. জাফর ইকবালের প্রসঙ্গে। ড. জাফর ইকবালকে অনুরোধ করবো, আপনি বর্তমান বাংলাদেশে একজন দায়িত্বশীল মানুষ। আপনার লেখায় এমন কোনো ইঙ্গিত থাকা ঠিক নয় যা বিভ্রান্তি ছড়ায়। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সমাজে অনাচার সৃষ্টি হোকÑ এটা যদি আপনার ইচ্ছে হয় তাহলে সে কথা ভিন্ন। যেহেতু আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকÑ যেহেতু বাংলাদেশ আপনার স্বপ্নের দেশ, সেহেতু আপনার কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে, সমালোচনা করুন, সেই সঙ্গে সমাধানের দিকনির্দেশনাও দিন। আমরা পাহাড়িদের সুন্দর জীবন যেমন চাই, তেমনি পদ্মা সেতুও চাই। দুটোই আমাদের অন্তরের আকাক্সক্ষা। পাহাড়িদের সঙ্গে পদ্মা ব্রিজের কোনো বাহ্যিক সম্পর্ক নেই। কেন তাহলে পদ্মা ব্রিজের তুলনা? পাহাড়ের সমস্যা একদিনের নয়, দীর্ঘদিনের। পার্বত্য জেলাসমূহে আজ যেটুকু শান্তি আছে তার কৃতিত্ব অনেকখানিই আওয়ামী লীগের। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তি হওয়ার ফলে সেখানে অনাকক্সিক্ষত মৃত্যু বন্ধ হয়েছে, হ্রাস পেয়েছে সংঘাত ও সহিংসতা। এখন পাহাড়ে যেসব সমস্যা আছে তাও ধীরে ধীরে সমাধান হবে বলেই আমি আশা করি। আপনি যেহেতু পাহাড়ের কাছাকাছি থেকেছেন বা থাকেন, আপনি সেটা আরো ভালো জানেন। তিন পার্বত্য জেলা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণÑ তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণবঙ্গের ১৭টি জেলা। পার্বত্য জেলার সমস্যার সমাধান চাওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ বঙ্গের জনগণের দুর্ভোগের কথাও আমাদের মাথায় রাখা দরকার। যাইহোক, আলোচনা-সমালোচনার ভেতর দিয়েই দেশ এগিয়ে যাক। উন্নত হোক আমাদের স্বপ্নরঞ্জিত বাংলাদেশ।
২০ জুন, ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *