List


মোনায়েম সরকার

আজ আমি একাত্তরে পা দিলাম। আমার জন্মের পর সত্তর বার সূর্যকে পরিভ্রমণ করেছে পৃথিবী। মহাকালকে যদি প্রশ্ন করা হয় সে হয়তো বলবে এ তেমন কোনো দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু আমি জানি আজ আমার জীবনসূর্য এগিয়ে চলছে পূর্ণতার দিকে। আমার জন্ম হয়েছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধে। সাল তারিখের হিসেবে ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ। দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন ছিল আমার রক্তের ভিতর। বিশ্বযুদ্ধের অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ও ভয়াবহতা আমি প্রত্যক্ষ না করলেও আমার শৈশব ও কৈশোরে এর প্রভাব ছিল ভয়াবহ। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, শোষণ-তোষণ, অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা- অনেক কিছুই আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কিছু উপলব্ধি করেছি পরোক্ষভাবে। ছোট্ট এই জীবনে আমি অনেক বাধা পেরিয়েছি। অপরূপ বাংলার সোনাডাঙ্গা মাঠ ছাড়িয়ে, গোমতী পার হয়ে, ময়নামতি সেনানিবাসের পাশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত শত শত সৈনিকের সমাধির পাশ দিয়ে পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আমার জন্ম, বেড়ে উঠেছিলাম পরাধীন পাকিস্তানি শাসনে। তাই যুগের দাবি মেনে নির্ভীক যৌবনে আমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায়। আমার বিশ্বাস ছিল শোষণ ও বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে একমাত্র সমাজতন্ত্রই মানুষকে দিতে পারে সুন্দর ও সুখী জীবনের নিশ্চয়তা। দেশে দেশে তখন ত্বরান্বিত হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্ল্লব, দারুণ এক স্বপ্নময় সময়। বিশেষ করে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্ল্লব স্বাপ্নিক মানুষের মধ্যে যে আশাবাদের সূচনা করে- তার মোহনীয় আবেদন ছিল আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য।
কিন্তু সমাজতন্ত্র কায়েমের যাত্রাপথে নানা অঘটন অনেকের মতো আমাকেও উদ্বিগ্ন করে তোলে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে রাশিয়ায় দুই কোটি মানুষের জীবন বলিদান। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চীনে- সেখানেও মৃতুøবরণ করতে হয়েছিল তিন কোটি মানুষকে। যে সমাজতন্ত্র মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের মহামন্ত্র নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে অবতীর্ণ হয়েছিল- পরবর্তী সময়ে তার রক্তাক্ত মুখশ্রী দেখে অনেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানে যেমন রুশ বিপ্লবের ভূমিকা ছিল, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্যও দায়ী ছিল তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পার্টির।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন প্রসঙ্গে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিএন হাকসার একটি পত্রে আমাকে লিখেছিলেন- ‘The Soviet Union built no institutions except the Communist Party, Central Committee, Polit Bureau and General Secretary.’ পার্টিই যদি জীবনের সবকিছুকে নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে মানুষের জীবন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই ঘটনাই ঘটেছিল।
১৯৩০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠিতে আমরা তার আভাস পাই-
‘রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে। ···
এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে- কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না- সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।’
আদিমকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে, সমাজে একদল মানুষ থাকে যারা কোনো দিনই মানুষের অধিকার নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরা কম খায়, কম পরে, কম শিখে; কিন্তু কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। এই অল্পে তুষ্ট মানুষগুলো নিজের গায়ে ধূলি লাগিয়ে, কাদা-জলে জীবন কাটিয়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষগুলোকে সেবা দিয়ে যায়- কিন্তু তাদের ভাগ্যে এতটুকু সম্মান বা সমাদর জোটে না। এই ধুলোমাখা মানুষগুলোই সভ্যতার নির্মাতা, এদের বুকে পা ফেলেই পৃথিবীতে আসে নব নব উত্থান। এই মানুষগুলোর মঙ্গল কামনাই আমার জীবনের ব্রত।
কীভাবে এই সুন্দর জীবনবঞ্চিত মানুষগুলোর এতটুকু কল্যাণ করা যায়- আমার মনের গহিনে কেবল সেই চিন্তাই সারাক্ষণ বিরাজমান। আজ জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে মানুষ সামনের দিকে যতটা না এগোচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে তার কয়েকগুণ বেশি। আমার দৃষ্টি দুই শতাব্দীতে প্রসারিত। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগতি আমি প্রত্যক্ষ করেছি- পৃথিবীর ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তা চমকপ্রদ, যা বিগত শতাব্দী এবং অনাগত কালের জন্যও বিস্ময়কর। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে, যে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করছে- মানুষকে বিভিন্নভাবে মারার জন্যও তার প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মারণাস্ত্র তৈরিতেও মানুষের বিপথগামিতার ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজ মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, সে কি তার সর্বশক্তি মানবকল্যাণেই ব্যয় করবে- নাকি মারণাস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বাঙালির জীবনের সবচেয়ে আলোচিত এবং গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। দীর্ঘ তেইশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুধু আমাদের অর্থনৈতিকভাবেই পঙ্গু করেনি- তারা আমাদের মানসিকতারও অবক্ষয় ঘটিয়েছিল। বাংলা ও বাঙালির সংস্ড়্গৃতির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কথা আজ আর কারো অজানা নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, সেই মানসিকতার কিছু মানুষ এখনো বাংলাদেশে আছে, তারা যেন কিছুতেই বাংলা ও বাঙালির সাংস্ড়্গৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কোনো বিষদাঁত না বসাতে পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকা আমাদের কর্তব্য। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ছিল একরাশ সোনালি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নগুলো দাঁড়িয়েছিল চারটি মূলনীতির উপর যথাঃ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ আমি গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক। কেন আমি সমাজতন্ত্র নামের কথিত ধারণার বৃত্ত থেকে বাইরে গিয়ে গণতন্ত্রের কাছে প্রণত হলাম তার একটি ঐতিহাসিক কারণ আছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি খুব দুঃখজনক রূপ ধারণ করে। প্রচণ্ড সরকারবিরোধী ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভ্রান্ত মিলিট্যান্ট অংশ তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও প্রকারান্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তির উত্থানের পথ প্রস্তুত করে। যে আদর্শ বুকে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম- সে আদর্শ আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে পেয়েছি। কালের চিরন্তন ভেলায় তার আদর্শ ও নীতি তাঁকে দিয়েছে অমরত্বের গৌরব। তাই বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তা শুধু মুজিব পরিবারকেই শেষ করার চক্রান্ত নয় – তা ছিল পুরো বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার, ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত। ’৭৫-পরবর্তী কালপর্বে বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক কায়দায়। বন্দুকের নল আর সামরিক চক্রের পদতলে নত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতি। দেশ চলে যায় পাকিস্তানি সামরিক আমলাতান্ত্রিক ধারায়। সেই সময়কার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আজও আমার কাছে রহস্যজনক আর অবোধ্যই রয়ে গেছে। ওই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে যখন মুজিবের নাম উচ্চারণ করা পর্যন্ত অসম্্‌ভব ছিল, তখন ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকাকালে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, পিএন হাকসার, কমরেড আবদুল রাজ্জাক খা, ভুপেশ গুপ্ত, গণেশ ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ইলা মিত্র, প্রফেসর শান্তিময় রায়সহ পৃথিবীর বহু দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মত-বিনিময় করে বুঝতে পারি গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্্‌ভব।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানি ধারায় চলে যায়। বাংলাদেশ যেন হয়ে যায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। দেশশাসন করতে থাকে চিহ্নিত দেশদ্রোহী ও দেশবিরোধীরা। তাই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য আপসকামী বামপন্থীদের সংশ্রব ছিন্ন করে ১৯৭৯ সালে যুক্ত হই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে, যুক্ত হই অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারায়। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশকে যদি এগিয়ে নিতে হয় তাহলে গণতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে নিতে হবে। আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি এদেশের মানুষ যতটা না বিপ্ল্লবী তারচেয়ে অনেক বেশি গণতন্ত্রমনা। সুতরাং গণতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করা অবান্তর।
ইতিহাসে মধ্যযুগে আমরা দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কথা জানি। ক্রুসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম নগরী লুণ্ঠন করেছিল, অসংখ্য মসজিদ ও সিনেগগ ধ্বংস করেছিল এবং নির্বিচারে অগণিত মুসলমান এবং ইহুদিকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পবিত্রতা ছিল না। ১০৯৯ সালে ক্রসেডারা জেরুজালেমে খ্রিস্টান রাজত্ব কায়েম করেছিল।
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ আজও চলছে, তবে অন্যরূপে। আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম আর ধর্ম নিয়ে সংঘাত অনেক সময়ই প্রধান রাজনৈতিক ইসুøতে পরিণত হয়েছে। এক অর্থে এটা হয়তো স্বাভাবিক, কেননা এশিয়া থেকেই বেশিরভাগ ধর্মের উৎপত্তি। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, কনফুসিয়ানবাদ, তাওবাদ, সিন্তোবাদ- এসব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেই সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ধর্মের নামে যে কি ভয়াবহ রক্তপাত হয়েছে তা আমরা ইতিহাসে দেখেছি। দেখেছি হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পরে দেখেছি মুসলমান-মুসলমানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ধর্মের নামে, সাম্প্রদায়িকতার নামে বর্তমান শতাব্দীতেও কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হচ্ছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্ল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিমানুষকে যে পরিমাণ নির্লোভ আর পরার্থপর হওয়া উচিত তা কি একবিংশ শতাব্দীর অতৃপ্ত, লোভী ও স্বার্থপর মানুষের পক্ষে আদৌ সম্্‌ভব? আজ বরং আমার মনে হচ্ছে- যা হয়েছে সমাজপ্রগতির ধারাতেই হয়েছে। যা হবে তাও সমাজপ্রগতির স্বাভাবিক ধারাতেই হবে। সমাজপ্রগতির ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে মানুষ শুধু নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে না, সঙ্গে সঙ্গে মানবসভ্যতার পতনও ডেকে আনবে। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তারই লক্ষণ। আমি আমার অল্প পরিসর জীবনে কত ঘটনা-ই না দেখেছি। আমি দেখেছি জমিদারের জমিদারি গেছে, রাজার রাজত্ব গেছে, সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্য গেছে। সামরিক স্বৈরশাসকদের পতন হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে। শীতল (Cold War) বা স্নায়ুযুদ্ধের মুহূর্তগুলোও প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এগুলো থেকে আমার এই প্রতীতিই জন্মেছে যে, ক্ষমতা কখনো স্থায়ী হয় না; ফাঁকি দিয়ে, চালাকি করে বৃহৎ ও মহৎ কাজ করা যায় না। জোর করে ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায় না। ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে চলে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে চাকরি ও খাদ্যের অভাবে সংগ্রাম চলছে।
নোবেলজয়ী অমর্তø সেন তিনটি কারণকে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্কট বলে উল্ল্লেখ করেছেন- (১) সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ, (২) সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং (৩) জঙ্গি রক্ষণশীলতা। বাংলাদেশে মূলত প্রথম এবং শেষ সংকটটি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হুমকির কারণ। যদি আমরা ধর্মনিরপেক্ষ আচরণে অভ্যস্ত না হই- তাহলে এখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও জঙ্গিবাদ, যা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কখনোই কাম্য নয়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মের নামে কি নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও হানাহানি চলছে তা বিশ্ববাসী অবলোকন করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের উত্থান দেখে মনে হচ্ছে যেন মানুষ আবার মধ্যযুগের মতো ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান বিশ্ব এখন একটা নতুন আর্থসামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থা কখনো সফল হবে না। সি·আই·এ, পেন্টাগন, ন্যাটোর সব প্রচেষ্টা আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সৃষ্ট তালেবান, আল-কায়দা, আই এস-এর সঙ্গে আবার তাদেরই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা (Humane World Order) কামনা করছে। বাংলাদেশও এখন তাই আকাঙ্ক্ষা করে। বর্তমানে বাংলাদেশ সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে একটি দেশ বা জাতিকে টেনে তোলা সম্্‌ভব নয় – যদি না গোটা জাতি উত্তরণের পথ খোঁজে। আমরা অনেক দূরে যেতে চাই- আমাদের সেই যাত্রার অনুপ্রেরণা হোক গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন-
‘বাংলার মাটি নিত্যউর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে। এত ধান আর কোনো দেশে ফলে না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ- আল্লাহ, ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’
পরিশেষে বলতে চাই- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য, সম্পদ ও সম্্‌ভ্রম রক্ষা করার ব্রত আমরা যেন ভুলে না যাই। আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই- মায়ের অশ্রু, ভাইয়ের রক্ত, বিধবা বোনের দীর্ঘশ্বাসের আরেক নাম বাংলাদেশ। আসুন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। জয় বাংলা।
*৭১তম জয়ন্তী উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতা
স্থানঃ বাংলা একাডেমি, ২১ চৈত্র, ১৪২১, ৪ এপ্রিল, ২০১৫।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]