List

স্মারক বক্তৃতা
বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতাঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু
দ্বারভাঙ্গা হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু

শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সমবেত সুধীমন্ডলী, আজ আমার জীবনের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা হলে, বঙ্গবন্ধুর মতো মহামানবের স্মৃতিচারণ করে, স্মারক বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হবে তা আমি আশা করিনি। এই হলেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বারভাঙ্গা মহারাজের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত এই হলে বক্তব্য রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি প্রমুখ শ্রেষ্ঠ মনীষীবৃন্দ। এমন একটি স্থানে আমার মতো অকিঞ্চনের বক্তব্য রাখার সুযোগদানের জন্য আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অনুমান করি, বঙ্গবন্ধুর উপর হাজার গ্রন্থের মধ্যে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত আমার সম্পাদনায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জীবন ও রাজনীতি’ (২ খণ্ডে) গ্রন্থটির জন্যই বিশ্বকোষ পরিষদ আমাকে স্মারক বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
সম্মানিত সুধীবৃন্দ, আমার বক্তব্যের প্রারম্্‌েভ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী কালপর্বে, ভারতের সর্বস্তরের জনগণ, সশস্ত্র বাহিনী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অমূল্য অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
আবহমান বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি অবিস্মরণীয় বিস্ময়কর নাম। অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলার মানুষ যে-সব রাজনৈতিক নেতাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন একটি বিশেষণ। যেমন চিত্তরঞ্জন দাশের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘দেশবন্ধু’, সুভাষ বসুর নামের সঙ্গে ‘নেতাজি’। আবুল কাশেম ফজলুল হক হয়েছিলেন ‘শেরে বাংলা’। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। এখন মহাত্মাজি বললে যেমন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে বোঝায়, কবিগুরু বললে যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝায়, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতি বঙ্গবন্ধু হিসেবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি, বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তন ধারায়, একটি ভৌগোলিক সীমারেখায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন। তাঁর কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনানী এবং সমকালীন বিশ্বের মানব জাতির মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিত-প্রাণ উৎসর্গীকৃত সন্তানদের একজন। শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা- জাতির জনক।
শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব একটি ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন- যেমন ইতালিতে ম্যাটসিনি ও গ্যারিবল্ডি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতে মহাত্মা গান্ধী তাঁরা সবাই বিশ্বের মহানায়ক। উপনিবেশবাদের কবল থেকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য মহাত্মা গান্ধীর অবদান, কিংবা হল্যান্ডের অধীনতা থেকে ইন্দোনেশিয়াকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে সুকর্নর ভূমিকার কথা স্মরণ রেখেও, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানের বৈশিষ্ট্য এবং নেতৃত্বের পার্থক্য কোথায় তার বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ভারত উপমহাদেশে বিদেশি শাসকের অধীনতা ছিন্ন করার স্বাধীনতার সংগ্রাম, ফরাসি অধীনতা থেকে আলজিরিয়া, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, ব্যাপক অর্থে এক হলেও, এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারার সঙ্গে, উল্লিখিত সংগ্রামগুলোর চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে।
রাজনৈতিক-সামাজিক ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের মহানায়কের অবস্থানে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। তার ভাবনা- চিন্তা-আদর্শবোধ-জীবন দর্শন ইত্যাদি আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদানগুলো ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। এক অবস্থান থেকে উন্নততর অবস্থানে উত্তরণ ঘটেছে। উত্তরণ ও বিবর্তনের এই গতি কোনো দিন বন্ধ হয়নি, অব্যাহত থেকেছে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। রাজনীতির অনেক আঁকাবাঁকা পথে তাকে চলতে হয়েছে, অনেক আগু-পিছু করে তাঁকে রাজনীতির পথ পরিক্রম করতে হয়েছে, বাস্তবতার প্রতিকূলতার মুখে কখনও কখনও তাকে সাময়িক আপসও হয়তো করতে হয়েছে- কিন্তু তার সামগ্রিক বিবর্তনের গতি ছিল সামনের দিকে, প্রগতি অভিমুখে।
শেখ মুজিবের স্বকীয় নেতৃত্বের আভাস তার কিশোর বয়সের কয়েকটি ঘটনা থেকে আঁচ করা যায়। তিনি কিশোর বয়সে খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা শেরে বাংলা এ· কে· ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর নিকট গোপালগঞ্জে নির্ভীক কণ্ঠে তাঁদের গ্রামের স্ড়্গুলের দাবি তুলে ধরেছিলেন। আঠারো বছর বয়সে স্ড়্গুলে পড়ার সময় এক ঘটনার প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণের জন্য তরুণ শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং সাত দিন হাজতবাস করেন। বিদ্রোহী এই বালক যে, একদিন স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এমন সম্্‌ভাবনা অনুধাবন করা গিয়েছিল সেদিন। দেশের মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে শেখ মুজিব কিশোর বয়স থেকেই সচেতন ছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তা প্রকাশও পেয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বৈষম্য-নীতি, শোষণ ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামের কথাই বারবার ঘুরে ফিরে আসে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে। তখন থেকেই তিনি দেশের ইতিহাস, সংস্ড়্গৃতি, বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির জন্য ভেবেছেন- কোনো শ্রেণি, সংগঠন, পেশা বা কোনো গোষ্ঠীর কথা আলাদা করে ভাবেননি। কিন্তু এসব সামাজিক-আর্থিক অবস্থানের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সমস্যাগুলোকে তাঁর কর্মে ও ভাবনায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাবনা জুড়ে ছিল হাজার বছরের বাংলাদেশ। তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখার ইতিকথা কেবল পাকিস্তান আমলে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যুগের নয়, তারও আগের। শেখ মুজিব সর্বভারতীয় রাজনীতি অপেক্ষা বাংলার রাজনীতি, বাংলার ভাগ্য নিয়ে বেশি ভাবতেন, বাংলার দুঃখী মানুষের কথা তাঁর রাজনৈতিক কর্মে ও ভাবনায় কৈশোর থেকেই স্থান করে নিয়েছিল, আর এ কারণেই তাঁকে প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধ’ু উপাধি জনগণের ভালোবাসার দান হিসেবে সার্থক হয়ে উঠেছে। তাই শেখ মুজিবের জীবন ও কর্ম তথা রাজনৈতিক ইতিহাসকে বাংলাদেশের মর্মকথার নৈর্বøক্তিক ইতিহাস, বাংলাদেশের বহির্জগতের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিত্রিত করা সম্্‌ভব নয়। একটি সমাজ, জনজীবন বা জাতির ভাবধারাতে সঠিক স্থান নির্দেশই শুধু ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয়, তার বিচার-বিশ্লেষণ ইতিহাসের অন্তর্গত। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ইতিহাস সর্বতোভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মনে রাখতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু পূর্বাপর একজন অনমনীয় ও অনন্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। এ ক্ষেত্রে তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যধারার উত্তর-সাধক বলা চলে। সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। আশৈশব সংগ্রামী ভূমিকায় বাংলার স্বার্থের প্রশ্নে তিনি কখনও কোথাও কোনো আপস করেননি অথবা কোনো চাপের সামনে নতি স্বীকার করেননি। এ কারণেই তাঁকে বারবার কারাবন্দি হতে হয়েছিল। এ কারণেই তাঁকে ৬-দফা আন্দোলন পরবর্তীকালে, দেশের মাটিতে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে এবং ১৯৭১-এর মুক্তি-সংগ্রামকালে মৃতুø-খড়্‌গ মাথার ওপরে ঝুলন্ত অবস্থায়, পাকিস্তানে দুঃসহ বন্দি জীবন যাপন করতে হয়েছে। আর ঠিক একই আপসহীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই, তাঁকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং আত্মীয় পরিজনসহ নৃংশসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে।
আবার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক সমাজ, ধর্ম ও দর্শনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সেখানে সংঘাত, বহিরাক্রমণ, শাসন-ব্যবস্থা ও রাজ্য পরিচালনা-ব্যবস্থার মধ্যে যে নতুন সম্পর্ক দেখা দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে তাঁকে বিশ্লেষণের সুযোগ আছে। উনিশ শতক থেকে, বিশেষভাবে তার দ্বিতীয়ার্ধে, রাজনৈতিক উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ, সমাজ-সংক্রান্ত একটি দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে গড়ে ওঠে এবং সমাজ-জীবনকে সংগঠিত করার পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। ভারতীয় সমাজ দেশজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত, এটাই ছিল সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ। একই সঙ্গে ইহজাগতিক সাধারণ স্বার্থ- যেমন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্ড়্গৃতিক বিষয়গুলো সম্প্রদায়-নির্বিশেষে জনগণ একইভাবে ভোগ করতো। তারপরও তা পাশ্চাত্য সমাজ থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ছিল। লোকাচার, পেশার অপরিবর্তনীয় উত্তরাধিকার, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস একই সম্প্রদায়ের মধ্যে দুস্তর বিভাজন সৃষ্টি করেছিল-পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে- যা ছিল অবমাননাকর।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পাশাপাশি অবস্থানের কারণে, কালেভদ্রে ধর্মীয় সংঘাত বিরাজ করলেও, সাম্প্রদায়িকতা রাজনৈতিক উপসর্গ হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে স্থান করে নেয় এবং বিশ শতকে এসে তার উগ্রতা প্রকাশ পায় বিদেশি শক্তির কূটকৌশলে। এক্ষেত্রে উপনিবেশবাদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। আর এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু ও মুসলিম মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে অসম বিকাশ সূত্রে। ঔপনিবেশিক শাসন এদেশের বুকে স্থান করে নেয়, বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলকে আশ্রয় করে, যেখানে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল দরিদ্র শ্রেণির। আধুনিক ঔপনিবেশিক শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানের পক্ষে সহজ হয়েছিল। মুসলিম সমাজের এই সুযোগ গ্রহণ উনিশ শতকের সত্তরের দশকে শুরু হলেও তাদের সমাজের রক্ষণশীল অংশের প্রবল বিরোধিতার মুখে, তার বিকাশ ছিল মন্থর। ভারতের রাজনীতিও এই অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জনসাধারণের ইহজাগতিক পরিচয়- শ্রেণি, এলাকা, ভাষা ও সংস্ড়্গৃতিকে কেন্দ্র করে বিকাশের পরিবর্তে নৈর্বøক্তিক ভারতীয় তথা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বাংলাদেশের অবস্থাটা ছিল ভিন্ন রকম। লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা বাংলার ভূমি-ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। আমাদের কৃষিজীবী জনগণ বিশিষ্ট জমিদার শ্রেণিকে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে দেখতে পায়, যাদের পেছনে ছিল ব্রিটিশ শাসকশ্রেণির সমর্থন। শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলায় কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছে বারবার। ইতিহাসের এই ঘটনাবলি বাঙালির বিদ্রোহের স্পৃহাকে বারবার উন্মোচিত করেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন, আপাতদৃষ্টিতে যা পাকিস্তানি শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে, তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক- এ প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি তো বিশ শতকের মধ্যভাগে এসে, ভিন্নতর ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-এ অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্প্রদায়গত বৈষম্য, যা অবিভক্ত ভারতে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্তি হিসেবে এসেছিল, তার সামাজিক দিকটির সত্যতা আপেক্ষিক, তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানি শাসকদের ধর্মীয়-সামাজিক পটভূমিতে, বৃহত্তর জনগণের দুঃখ-দারিদ্র্য ব্যাখ্যার সুযোগ অন্তর্হিত হলো। শোষণের ক্লাসিক্যাল তত্ত্ব পুনর্বøক্ত হলো বাঙালির নিকট। জাতীয় চেতনার ক্ষেত্রে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধারণা থেকে বাঙালির মোহমুক্তি ঘটে পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের নগ্ন বহিঃপ্রকাশে। জাতীয় ঐক্যের বন্ধন হিসেবে ভাষা ও সংস্ড়্গৃতি প্রধান স্থান দখল করে। এ ক্ষেত্রে তরুণ ছাত্র ও যুব নেতৃত্বের কারণেই ভাষা-আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে ১৯৫২ সালে এবং এর পরবর্তী সময়কালে।

উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,
বিশ শতকের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ধারার সংগঠনের বিকাশ, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির অবনতি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং পরিশেষে বাংলা ও ভারত বিভাগ। ভারত বিভাগোত্তর যুগের রাজনীতির লক্ষণীয় দিক হচ্ছে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২১-দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ছিল তাদের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার বিপর্যয়। তেমনি বাঙালি জাতীয় সত্তা সংরক্ষণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পায় প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলনে, পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ে। সর্বশেষে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলনে। যুগান্তকারী ভাষা-আন্দোলন ও ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচির পর, ১১-দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণ-অভুøত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা স্থগিত, ৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এবং গণরায় নস্যাতের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এই অসহযোগ আন্দোলনের সূচনায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও ইতিহাসে এক অমর গাথা। ‘নিউজ উইক’ সাময়িকীর রিপোর্টার রবার্ট জেঙ্কিন্স বঙ্গবন্ধুকে যথার্থই ‘পোয়েট অব পলিটি’ বা ‘রাজনীতির কবি’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও ব্যাপকতা, ভারতে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তুলনীয় নয়। স্থান ও কালের ব্যবধান ছাড়াও শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন একটি সমান্তরাল বেসামরিক সরকার পরিচালনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, যা মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও প্রভাব থেকে প্রকৃতিগতভাবেই আলাদা। বাংলাদেশের মানুষ, সংগঠন, রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের ডাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়া দিয়েছে এবং অংশগ্রহণ করেছে। একদিকে সামরিক বাহিনী শত শত লোককে গুলি করে হতাহত করেছে, অপরদিকে বাংলাদেশের মৃতুøঞ্জয় জনতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে অসম সাহসে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়ে আন্দোলন করেছে- কারফিউ ভেঙেছে জনগণ, তাদের কানে বেজেছিল বঙ্গবন্ধুর অমোঘ নির্দেশঃ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই অসহযোগ আন্দোলনকে সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় হিসেবে অভিহিত করা যায়। তিন সপ্তাহব্যাপী একটি সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্ব ও সাহসের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যার উদাহরণ ইতিহাসে নেই। তারপরই শুরু হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ- বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে, মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গীত, একটি গানের প্রথম চরণ ছিলঃ ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালির একটিই নাম- মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর।’ প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে নিরেট বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ জীবনবাজি রেখে, স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে নিতে, যুদ্ধের প্রান্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁরই নির্দেশে, তাঁরই নামে, তাঁরই অনুপ্রেরণায়। সে সময় যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে ছিলেন, যারা ভারতবর্ষের শরণার্থী শিবিরে ছিলেন, যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুর বেয়নেটের মুখেও স্বাধীনতার জন্য বুক বেঁধে ছিলেন, তারা জানেন এটি কোনো অতিশয়োক্তি নয়। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একে অপরের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বিশ্লেষণে গবেষক ও আলোচকগণ বিস্মিত হতেন এ জন্য যে, যিনি তাঁর রাজনীতি শুরু করেছেন তরুণ বয়সে মুসলিম লীগের সংস্পর্শে, তিনি কীভাবে সামন্তবাদী সমাজের চিন্তা-ভাবনা ও ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর ওপর কার প্রভাব বেশি ছিল এবং কেন ও কীভাবে দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও দেশের মানুষ সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তায় তাঁর নিজস্বতা গড়ে উঠলো? শৈশবের বহু ঘটনায় সামাজিক পরিবেশের বহু প্রভাব মানুষের চরিত্র গঠনে সহায়ক হয় এবং শেষ দিন পর্যন্ত জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকে। পারিবারিকভাবে তিনি পিতার সস্নেহ প্রশ্রয় পেয়েছেন বাল্যকালেই। একবার ফলন ভালো না হওয়ার কারণে এলাকার গরিব কৃষিজীবী মানুষ খাদ্যাভাবে কষ্টে নিপতিত হলে শেখ মুজিব তাঁর ঘরের সঞ্চিত ধান-চাল তাদের মধ্যে বিতরণ করেন। এভাবে পরিবারের নিকট থেকেই তিনি মানুষকে ভালোবাসার, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা পেয়েছেন। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁকে কোনো তত্ত্বের দরোজায় হাজিরা দিতে হয়নি।
কলকাতায় কলেজে পড়তে গিয়ে শেখ মুজিব মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। গোপালগঞ্জ সফরের সময় স্ড়্গুল জীবনেই তার মধ্যে অমিত সম্্‌ভাবনার লক্ষণ সোহ্‌রাওয়ার্দী সাহেব দেখতে পেয়েছিলেন। কলকাতায় এসে শেখ মুজিব পরিচিত হন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের সঙ্গে। মুসলিম লীগের সোহ্‌রাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপ ছিল আধুনিক ভাবধারার অনুসারী। আবুল হাশিম তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের প্রশিক্ষণের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। রক্ষণশীলরা আপত্তি করেছিলেন। এ ব্যাপারে আবুল হাশিমের বক্তব্য হলো, ‘মুসলিম লীগ শুধু এদেশের মুসলমানের প্রতিষ্ঠান নয়- সকল দুঃখী মানুষের প্রতিষ্ঠান। কোরআনে দুঃখী ও নিপীড়িত মানুষকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে তাদের ক্ষুধার যন্ত্রণা আলাদাভাবে দেখায়নি, ক্ষুধার্তকে অন্ন দিতে বলেছে।’ উল্লেখ্য, শেখ মুজিব ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করার বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় একটি প্রধান ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একই সময় মন্ত্রী ও দলের কোনো সাংগঠনিক পদে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না, এই নীতি অনুসরণ করে শেখ মুজিব মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে এসেছিলেন দেশের মানুষকে ভালোবেসে। দেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে ১৯৪২-৪৩ সালে শেখ মুজিব যখন ছাত্র-রাজনীতি করতেন তখন তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তার কারণে ওই সময়ই তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগ ফেডারেশনের কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলি, সাহস ও সাংগঠনিক দক্ষতা।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় বাংলা ভাগ করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসুর উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তখন যুক্ত বাংলার পক্ষে যুক্তি ছিল বাংলাদেশের ভাষা, সংস্ড়্গৃতি ও ইতিহাস- যা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সেখানে ধর্মের পার্থক্য সত্ত্বেও উভয়েই বাঙালি। এই প্রচেষ্টার সব দিক শেখ মুজিব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তারপর দেশ ভাগের মুখে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল মহল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। দেশ ভাগের সময় পূর্ববাংলার আইনসভার নেতা নির্বাচনে শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর পরাজয়ের মূলে অনেক কারণের মধ্যে ছিল সোহ্‌রাওয়াদী ও আবুল হাশিমের মতবিরোধ। উল্লেখ্য, কংগ্রেস হাই কমান্ডও অখণ্ড বাংলা চাননি।
শেখ মুজিব যে শুরুতে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি অসাধারণ রাজনৈতিক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার লেখক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অনুরোধে তিনি এই আত্মজীবনীটি লেখতে শুরু করেছিলেন। এটা তিনি শেষ করতে পারেননি। তার জন্মকাল থেকে (জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ) শুরু করে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ঘটনা- যার বেশিরভাগের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সংশ্লিষ্টতা ছিল- তুলে ধরা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে তিনি লিখেছেনঃ
‘হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারে বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল কারণেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দু ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তখন অনেকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারা ভোগ করেছে ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন তাহলে তিক্ততা এত বাড়তো না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজি সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তারা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তার লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন। এ কথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করতো, হিন্দু হিসাবে নয়, প্রজা হিসাবে। এই সময় যখনই কোনো মুসলমান নেতা মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার দাবি করতো, তখনই দেখা যেতো হিন্দুদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত, এমনকি গুণী সম্প্রদায় চিৎকার করে বাঁধা দিতেন। মুসলমান নেতারাও ‘পাকিস্তান’ সম্বন্ধে আলোচনা ও বক্তৃতা শুরু করার পূর্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গালি দিয়ে শুরু করতেন।’
পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে নিজের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে শেখ মুজিব লিখেছেনঃ
‘অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে।’
তবে রাজনীতিতে নিজের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে তিনি লিখছেনঃ
‘আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খৃস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’

সাতচল্লিশের পর ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিব নতুন উদ্যম নিয়ে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশকে একত্রিত করে নতুন যাত্রা শুরু করেন। তখন শেখ মুজিবের ভূমিকা ও নেতৃত্ব সামনে চলে আসে। মুজিব ছিলেন দুঃসাহসী ও দৃঢ়চেতা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোনোরূপ নৈরাশ্য কখনও তাঁর ওপর ছায়া ফেলেনি। তিনি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নামে মুসলিম থাকলেও এর কর্মকাণ্ড ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম লীগের ধর্মান্ধ রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণার মুখে তিনি বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন সংগঠন থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিলেই অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না। কাজের মধ্য দিয়ে এই ধারাকে এগিয়ে নিতে হবে। মানুষকে চেনার ক্ষমতা যেমন শেখ মুজিবের ছিল, তেমনি মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর কথাবার্তা ছিল খুবই আটপৌরে এবং আকর্ষণ করার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ৬ বছরের মাথায় মূলত তাঁরই উদ্যোগে এবং তাঁর সংগঠন-শক্তির কল্যাণে দলটিকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত করা সহজ হয়।
একজন মানুষ হিসেবে শেখ মুজিবের মহত্ব এখানে যে, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য তিনি লড়াই করেছেন। তিনি চেয়েছেন এই দেশের মানুষ যেন খেয়েপরে সুখে-শান্তিতে বাঁচতে পারে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের ন্যায্য স্থান পেতে পারে। আর এ জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবন, চিন্তা-ভাবনা ও শ্রম উৎসর্গ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আদর্শবাদী ও নীতিবান মানুষ হিসেবে এদেশের সাধারণ মানুষের একান্ত কাছাকাছি ছিলেন। ২৪ বছরের নিরলস সাধনায় সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও তিনি অহঙ্কারী ও উদ্ধত ছিলেন না। বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারকে তিনি ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কখনো প্রশ্রয় দেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় বসবাস করতেন। বাসাটি একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আড়ম্বরহীন, বাহুল্যবর্জিত ছিল। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হিসেবে তিনি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। তাঁর পত্নীও তাঁরই আদর্শের অনুসারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই নির্দ্বিধায় বলা সম্্‌ভব হয়েছে সমগ্র দেশবাসীকে, এদেশের প্রতিটি বাঙালিকে, প্রতিটি মানুষকে-‘আমি তোমাদেরই লোক’। কোনোরূপ উচ্ছ্বাস বা অতিশয়োক্তির স্থান ছিল না এই উচ্চারণে। মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনায় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মাপের মানুষ।
চরিত্রের দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের অতুলনীয়তায় বঙ্গবন্ধু সকলের ঊর্ধ্বে ছিলেন- কি উচ্চতায়, কি চিত্তের বৈভবের বিপুলতায়। একাধারে তিনি সাহসী ও বিনম্র ছিলেন এবং ছিলেন বলিষ্ঠ চিত্তের একজন। উত্তেজনার মাত্রা বাড়িয়ে যে রাজনীতির চর্চা বিশ্বব্যাপী চলছে, তার মধ্যে নিঃশঙ্কচিত্তে নিজের দাবি তিনি জলদগম্্‌ভীর স্বরে তুলে ধরতেন। এজন্য রাজদণ্ডের ব্যবস্থাপত্রের সাথে তাঁকে বিনাশের আয়োজন করা হয়েছে একাধিকবার। বারবার জেলে নিয়ে নিগ্রহ করার পাশাপাশি তাঁকে হত্যার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। আগরতলা মামলায় দেশদ্রোহী বলে তাঁর প্রাণনাশ করার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৬-দফা আন্দোলন কর্মসূচিকে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, বাঙালি সেই শক্তি আয়ত্ত করে প্রত্যাঘাত হেনে তাঁর মৃতুøর চক্রান্তকে প্রতিহত করে।

সুধীমণ্ডলী,
একজন বিরাট মাপের মানবতাবাদী হিসেবে শেখ মুজিব বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক- এ কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। একটি অসহযোগ আন্দোলন তিনি পরিচালনা করেছেন। সামরিক জান্তার উস্ড়্গানি, হত্যা, রক্তপাত এবং অবাঙালিদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে আসেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র অবস্থানের মধ্যে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুরই ঐকান্তিক আগ্রহে। এ থেকেও তাঁর ব্যক্তিত্বের অসাধারণত্ব প্রকাশ পায়। স্মরণীয় যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরেও জার্মানির মাটিতে মার্কিন, সোভিয়েট, ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল। কোরিয়া যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরেও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সৈন্য আর জাপানে অদ্যাবধি মার্কিন সৈন্য অবস্থানের কথা প্রসঙ্গক্রমে স্মরণীয়।
এই উপমহাদেশে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথকভাবে চর্চার বঙ্গবন্ধুই পথপ্রদর্শক। ভারতীয় সংবিধানে এই নীতি ১৯৭৯ সালে একটি সংশোধনীর মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসৃত না হওয়ার ফলে ভারতে হিন্দু মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। আর পাকিস্তান তো কার্যত একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশেও একই ধারার অনুসৃতি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। স্মরণীয় যে, বাঙালি ১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র করার জন্য।
ইউরোপীয় রেনেসাঁর সারমর্ম হলো মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদকে জীবনচর্চার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ। এর ফলে বুদ্ধির মুক্তি, জ্ঞানচর্চার প্রসার, বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তিকে অলৌকিকতার কবলমুক্ত করে মানুষের মনন ও চিন্তার সীমাহীন সম্্‌ভাবনার দ্বার উন্মোচন। এই উপমহাদেশে বঙ্গবন্ধু তারই সার্থক প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে কিন্তু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চক্রান্তে তা সফল হতে পারলো না।
স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্রুত নানা মেরুকরণ হতে থাকে। দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি শুরু করে নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে দেখা দেয় অস্থিরতা। স্তাবকের দল তাঁকে জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করে দেশে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস চলে। অতি বামপন্থীরা চালায় গুপ্ত হত্যা ও পাটের গুদামে আগুন দেয়ার মতো অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড। ’৭৪-এ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করায় অসংখ্য মানুষ অনাহারে মৃতুøবরণ করে। পরাজিত পাকিস্তানপন্থীরা গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনীতিকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা গোপনে চলতে থাকে। এ ব্যাপারে তাঁকে সতর্ক করা হলে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’ মানুষের প্রতি এই অবিচল বিশ্বাসই তাঁর মধ্যে মানবতাবাদের উৎকৃষ্ট গুণাবলির সমাহার ঘটিয়েছিল। তাঁর হত্যাকারীরা বাহ্যিক পরিচয়ে বাঙালি হলেও তারা ছিল কার্যত বহিঃশত্রুর আজ্ঞাবাহী দাস। পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমেই একাত্তরের পরাজিত শত্রুর পুনরাবির্ভাব ঘটে।
পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরাচরিত গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা থেকে সরে এসে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করায় তিনি সমালোচিত হন। একদলীয় শাসন নয়- জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ কায়েম করাই যে বাকশাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল সেটা প্রমাণ করার সুযোগ আর তাঁকে দেয়া হয়নি। (পরিশিষ্টে বাকশালের আদর্শ দ্রষ্টব্য) ঐকমত্যকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর এই নতুন যাত্রাপথের শুরুতেই সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি তাঁকে হত্যা করে। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার সপক্ষে যত কারণই বলা হোক, তার আসল কারণ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দান। একই কারণে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত জাতীয় চার নেতাকে জীবন দিতে হয়েছিল। বস্তুত পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বোপরি বাঙালির ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে। যুগ যুগ ধরে এই ঘটনা বাঙালি জাতির সংগ্রামকে দিক-নির্দেশনা দেবে প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করতে। আর এই ঘটনার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে খ্যাতনামা সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘ইতিহাসের পণ্ডিতদের কাছে একটি কথা বলার জন্য আমি ক্ষমা চাই। কথাটি হলো, পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) যেমন বহুকালের জন্য ভারত উপমহাদেশের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টও তেমনি নির্ধারণ করে বিশ শতকের শেষ অঙ্কে সারা উপমহাদেশের ভাগ্য। পনেরোই আগস্টের হত্যাকাণ্ড যদি নিবারণ করা যেতো, তাহলে কয়েক বছর পর পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড, আরও পরে ইন্দিরা-হত্যা, রাজীব-হত্যা সম্্‌ভবত নিবারণ করা যেতো।
দূর-নিয়ন্ত্রণ রাজনীতির নেপথ্য অক্ষশক্তির কাছে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একটি বিষ-ফোঁড়ার মতো অস্বস্তিকর। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের পরিষ্ড়্গার কথা- আফ্রিকা হোক, ল্যাটিন আমেরিকা হোক, আরবদেশ হোক, যেখানে মানুষ শোষিত, যেখানে মানুষ অত্যাচারিত, যেখানে মানুষ দুঃখী, যেখানে মানুষ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত, আমরা বাংলার মানুষ দুঃখী মানুষের সঙ্গে আছি ও থাকবো।’ এই অঞ্চলের মধ্যে সবার আগে গিনিবিসাউয়ের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা ও কাজের সঙ্গতির প্রমাণ দিয়েছিলেন। অধিকাংশ আরব দেশ যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, তখনই বঙ্গবন্ধু প্যালেস্টাইন মুক্তিসংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন ও একাত্মতা ঘোষণা করতে কুণ্ঠিত হননি। ১৯৭৪ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনঃ
বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাধারণ মানুষের লোক। ছিলেন জনতার নেতা। রাজনীতির তাত্ত্বিক পণ্ডিত তিনি ছিলেন না। এক বা একাধিক বিষয়ে তিনি বিশেষ জ্ঞানী কিংবা বিশেষজ্ঞও হয়তো ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞাবান একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনি মানুষকে বুঝতেন, বুঝতেন জনমনস্তত্ত্ব। মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করতে পারতেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের রসদ তিনি সংগ্রহ করতেন মানুষের কাছ থেকে।
শেখ মুজিবের রাজনীতি প্রাসাদ চক্রান্তের সূতিকাগারে জন্ম নেয়নি, ক্ষমতার প্রলোভনে পুষ্ট হয়নি। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে বঞ্চিত বাংলার সুদূর গ্রামাঞ্চলে, নীরব নিভৃত পল্লীতে, প্রতারিত শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। যে ক্ষমতার উৎস জনগণের সমবেত ইচ্ছায়, সহযোগিতায় ও সমর্থনে নিহিত, সে সুপ্ত ক্ষমতার পুনর্জাগরণই মুজিব রাজনীতির মূলমন্ত্র।
মুজিব নেতৃত্ব উপর থেকে চাপানো কর্তৃত্ব নয়। এ নেতৃত্ব বাংলার মাটি থেকে উদ্‌ভূত। আলো-বাতাসের আশীর্বাদপুষ্ট শস্যের মতন বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে এ নেতৃত্বের উদগম। জনগণের সঙ্গে অচ্ছেদ্য অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অমৃতরসে পুষ্ট। এ নেতৃত্বের বুনিয়াদ জনতার অন্তরে।
মানুষের মুক্তির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর আজীবন নিঃস্বার্থ ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিরল। তুলনাহীন অজেয় চরিত্র এবং বীর্যবান নেতৃত্ব যার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এ ত্যাগ ক্ষমতালোভীর লোক-দেখানো ভান নয়, এ ত্যাগ গণকল্যাণে উদ্বুদ্ধ দরদি মনের আত্মবিলুপ্তির পরিচায়ক, এ ত্যাগ ন্যায়ের পক্ষে নির্ভীক গণনেতৃত্বের দুর্বার সংগ্রাম। এ নেতৃত্ব অত্যাচারী বর্বর সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদের দুঃসাহসিকতা।

সমবেত সুধীবৃন্দ,
পৃথিবীর বর্তমান সভ্যতার ইতিহাস পাঁচ হাজার বছর আগে শুরু হলেও নির্মম ও মর্মান্তিক হত্যার ইতিহাস বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও তা থেমে নেই। হত্যাকাণ্ডের শিকার মহামণীষীদের নামের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও যুক্ত হয়।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব লিখেছেনঃ
যে-কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোন ভালো কাজ করতে পারে নাই- আমার বিশ্বাস।
এই বিশ্বাস থেকে আমৃতুø তিনি চুল পরিমাণ বিচুøত হননি, এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ-নিজের জীবন দিয়ে গেছেন।
ইতিহাস যেমন নেতৃত্বের সৃষ্টি করে, নেতৃত্বও তেমনি ইতিহাস সৃষ্টি করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের মূলস্রোতে নিয়ে তাঁকে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেছে, ঠিক তেমনিভাবে শেখ মুজিবও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তাঁর রাজনৈতিক সাধনা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন একটা পরিণতরূপে স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে। তাই বাংলাদেশ ও বাঙালির অপর নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর মহিমা এখন বাংলাদেশ ছেড়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম। সম্প্রতি হলিউডের একদল চলচ্চিত্রকার আমাকে জানান যে, হলিউডে শীঘ্রই শুরু হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ। হলিউডের রিসার্চ টিমের সদস্যবৃন্দ আমার কাছ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থটি গ্রহণ করার সময় বলেছিলেন যে, এটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হবে।
একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো যেখানে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে যখন মহান ভারতের ঔদার্যে দেশের বিধ্বস্ত সেতু, সড়কপথ পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার যখন আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকশূন্য, সেই সর্বশূন্য অবস্থা থেকে সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করেছিলেন। এটি সম্্‌ভব হয়েছিল তার প্রজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম এবং অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য। এই প্রবৃদ্ধির হার আজও বাংলাদেশের জন্য একটি ইপ্সিত লক্ষ্য।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনঃ
‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে বাংলার মাটি ও মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সংশপ্তক, শত্রুর নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চ থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন, দেশ ও বিশ্ববাসীর দাবির মুখে বীরের বেশে। কিন্তু এই ভালোবাসার কাঙাল মানুষটিকে, শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত দিতে হলো, বাংলার মাটিতে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, কতিপয় অবিমৃষ্যকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষায়ঃ
‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইন্‌শাল্লাহ।’
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। এখন আমাদের ঋণ পরিশোধ করার পালা। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। আবহমান কালের প্রবহমান মানুষ তার নামে উদ্দীপ্ত হবে, অনুপ্রাণিত হবে, অনুরণিত হবে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]