বাংলাদেশে সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারা
– মইনুল ইসলাম
সুধীমণ্ডলী,
বক্তৃতার শুরুতেই আমি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। বঙ্গবন্ধুর মৃতুøবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ যে বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা-২০১২-এর আয়োজন করেছে, আমাকে তা প্রদানের আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করার জন্যে আমি আয়োজকদেরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
যে বিষয়টি আমার স্মারক বক্তৃতার জন্যে চয়ন করেছি, তার গুরুত্ব বিবেচনায় আমার এ বক্তৃতার প্রারম্্েভই নিবেদন করছি, একটি স্মারক বক্তৃতার সীমিত অবয়বে বিষয়টির আলোচনা-বিশ্লেষণকে যথাযোগ্য গভীরতায় নিয়ে যাওয়া সম্্ভব না-ও হতে পারে, সে জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পেরিয়ে এসেছে আমাদের মাতৃভূমি। সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে পরিবর্তনের ধারা আমাদের অস্তিত্ব, জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ১৭৫৭ সালে একবার, ১৯৪৭ সালে আরেকবার ঔপনিবেশিক দখলদারির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে শোষণ, লুণ্ঠন, বঞ্চনা ও সর্বোপরি অমানবিক হত্যাযজ্ঞের লীলাক্ষেত্র হয়েছে এদেশ। আবার, একনদী রক্তের পথ বেয়ে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে এ-জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্র। অতএব, এদেশের সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারা বহন করে চলেছে বিজয়ের গৌরবদীপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার ফল্গুধারা। অপরদিকে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তলোলুপ হত্যাযজ্ঞের পথ ধরে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রক্ষমতার অবৈধ জবরদখলকারী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার প্রয়োজনে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে আবারো ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন পাকিস্তানি আদলের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবৈরিতা ও মার্কিন-প্রেমের পুরানো দুষ্টচক্রে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঘটনাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাওয়া সামরিক কর্মকর্তা ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে’ বহু সাধ্য-সাধনায় আনীত হলেন একজন ‘আর্মি মেজরের’ কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি ঘোষণা প্রদানের জন্যে, যাতে ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সেনানীরা উদ্দীপ্ত ও ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ২৬ মার্চ দুপুর থেকে দফায় দফায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি সমরাঙ্গনের রণতূর্যের উজ্জীবনী সুধায় আপ্লুত হয়ে জাতিকে অকুতোভয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অমোঘ পথনির্দেশে রূপান্তরিত হয়। ইতিহাসের কী ট্র্যাজিক পরিহাস, ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অগ্রসেনানী হয়েও জিয়াউর রহমান যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারেননি, তারই অজস্র প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে তার জবরদখলকৃত পুরো শাসনামলে! সুচিন্তিতভাবে তিনি এবং তার সৃষ্ট বিএনপিতে কেনাবেচার মাধ্যমে জড়ো হওয়া সুবিধে শিকারী রাজনৈতিক সাঙাতরা একে একে জনগণের মানসপট থেকে মুছে দিতে চেয়েছেন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি আদর্শ, অর্জন ও গৌরবগাথা। আর তার এই দেশদ্রোহিতামূলক পাকিস্তানি সত্তার সবচেয়ে বড় প্রমাণটি উদঘাটিত হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যা পরিকল্পনাটি সম্পর্কে তিনি আগাগোড়া অবহিত থাকা সত্ত্বেও অভুøত্থান পরিকল্পনায় তার সম্মতি প্রদানের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে মূল ঘাতকদের জবানীতে জানাজানি হওয়ার মাধ্যমে। এখন নির্দ্বিধায় বলা চলে, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার নেহাত ‘সুবিধেভোগী’ নন, তিনি প্রকৃত বিচারে ছিলেন ঐ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম চাণক্য-শিরোমণি কুশীলব। অতএব, তিনি বঙ্গবন্ধু, চার জাতীয় নেতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার সংগ্রাম- সবকিছুকেই ইতিহাস থেকে মুছে দিয়েছিলেন। ঐ ব্যাপারগুলোকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে এদেশের সামাজিক বিবর্তন ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারায় তার মুখোশাবৃত পাকিস্তানি সত্তাটির নির্মোহ মূল্যায়নও করতেই হবে। কারণ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, ঐ ঐক্যবদ্ধ জাতিকে জিয়াউর রহমানই আবার বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির কানাগলিতে প্রবিষ্ট করে গেছেন সুপরিকল্পিতভাবে। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃতুøর পর ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার সিংহাসন আবারো জবরদখলকারী আরেক সমরপ্রভু এরশাদ এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের বিধবা পত্নী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকে সযত্নে লালন করে গত তিন দশকে প্রচণ্ড শক্তিধর অবস্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। অতএব, ২০১২ সালের আগস্টের বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সমাজ বিবর্তন ও রাজনীতির ধারাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজনে প্রথম থেকেই উপরে উল্লিখিত বিপরীতমুখী এই দুটো প্রধান চেতনার ধারাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেই হবে।
সুধীমণ্ডলী,
নব্য-সাম্রাজ্যবাদী ‘বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নিরন্তর ঠাণ্ডা যুদ্ধ জোরদার করেছে তার মতাদর্শিক প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বলে দাবিদার দেশগুলোর জোটকে ছত্রখান করার উদ্দেশ্যে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই নব্য-সাম্রাজ্যবাদী ‘বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা’ বিশ্বের একক আধিপত্য বিস্তারকারী মতাদর্শিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি ছদ্মনাম ধারণ করলেও একুশ শতকের এক যুগ অতিক্রমণের ক্রান্তিলগ্নে ‘বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার’ বর্তমান প্রায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য সারা বিশ্বে পুঁজির শাসনকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অবাধ করার পথে তাবৎ বাধা অপসারণে আগ্রাসী ভূমিকাকে নিরন্তর জোরদার করে চলেছে। সরাসরি দেশ দখলের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পুরানো মডেলটি সাম্রাজ্যবাদী পর্বে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বকে দুটো বিশ্বযুদ্ধ উপহার দেওয়াতে যুগোপযোগিতা হারিয়েছে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নব্য-সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ও কায়দা-কানুন অনুসরণের মাধ্যমে পুঁজিবাদের বিশ্ব সাম্রাজ্য বিস্তারের আগ্রাসন নতুন নতুন ডাইমেনশানে বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে দিনকে দিন। বহুজাতিক করপোরেশন, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ, বৈদেশিক পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক এবং ইন্টার-আমেরিকান উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আঞ্চলিক পুঁজি-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ, বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য, দাতা সংস্থাসমূহ, দাতা দেশ ও সংস্থাসমূহের কনসর্টিয়াম, আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ, গ্যাট ও তদপরবর্তী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও), আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনসমূহ, জি-সেভেন (বা জি-এইট), এনজিও মডেল, কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচি, বিশ্বায়ন- এগুলো সবই এই নব্য-সাম্রাজ্যবাদী ‘আধিপত্য ও পরনির্ভরতা’ কাঠামোর লালনকারী বিভিন্ন কলাকৌশল, প্রতিষ্ঠান ও ডাইমেনশান। পুঁজির আন্তর্জাতিক চলাচল ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্যে উপরে উল্লিখিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও কলাকৌশলের মাধ্যমে পুঁজি এখন ধাবিত হতে পারে বিশ্বের যে কোনো স্থানে। সস্তা এবং দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন, নিষ্ঠাবান ও নির্বিরোধ শ্রমশক্তি যোগানের সম্্ভাবনা যেখানেই আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে পুঁজি সে দেশের পানেই ছুটে চলেছে মুনাফা আহরণের তাগিদে। অতএব, এ-ব্যবস্থায় শ্রম-শোষণের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়ে সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে এবং শ্রমজীবী জনগণ নিজ নিজ দেশেই আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণের শৃঙ্খলে।
এই নব্য-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রান্তীয় অবস্থানে অবস্থানকারী বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ জনসংখ্যার বসতি এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এদেশটি বিশ্বের ৪৮টি স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের মধ্যে জনসংখ্যার বিবেচনায় সর্ববৃহৎ। এদেশের অনুন্নয়নকে জনাকীর্ণতার অবশ্যম্্ভাবী ফল বিবেচনা করে এর উন্নয়ন-সম্্ভাবনা সম্পর্কে দেশে-বিদেশে অনেক উন্নয়ন-চিন্তক ও প্রতীচ্যের নয়া-ক্লাসিক্যাল উন্নয়ন অর্থনীতির তাত্ত্বিক মহল গভীর হতাশা পোষণ করতেন। ১৯৭২ সালে তদানীন্তন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ (International bottomless bread basket) হিসেবে অভিহিত করার মাধ্যমে পুরো জাতিকে অপমান করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মার্কিন কূটনীতির ব্যর্থতা ও পরাজয়ের গ্লানি-সঞ্জাত জ্বালা জুড়িয়েছিলেন। কিন্তু, খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোজগৎ, দেশচিন্তা এবং উন্নয়ন বীক্ষায়ও এহেন হতাশার ছাপ পড়েছিল, যা বৈদেশিক ঋণ/অনুদান গ্রহণের ব্যাপারে বাছ-বিচার করা সম্পর্কীয় তাঁর সরকারের প্রাথমিক অবস্থানকে পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের ৪১ বছরের পথ-পরিক্রমায় ২০১২ সালের বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন-অনুন্নয়নের যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে সেখান থেকে নিঃসঙ্কোচে বলা যাবে, হতাশার পরিবর্তে আশাবাদ ক্রমেই বাংলাদেশ সম্পর্কিত উন্নয়ন চিন্তাকে আলোড়িত করতে শুরু করেছে।
সুধীমণ্ডলী,
হয়তোবা অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির স্বর্ণ-সম্্ভাবনা আবাহন জানাচ্ছে বাংলাদেশকে। কিন্তু, এই সম্্ভাবনার পথ আগলে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রচরিত্র এবং সমাজে দৃঢ়মূল হয়ে গেঁড়ে বসা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী চিন্তা-চেতনা। যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূল ভিত্তি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে উৎসাদন করেছে ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাইকারী সমরপ্রভুরা। পাকিস্তানি স্টাইলে সেনা ছাউনীর রাজনীতি উৎপাটিত করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে, জন্ম দেওয়া হয়েছে মানচিত্র-ভিত্তিক, বিভেদকামী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কৃত্রিম কনসেপ্টের। সকল ধর্মের সম-মর্যাদা প্রদানকারী ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে, পরবর্তীকালে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’কে সংবিধানে প্রোথিত করেছেন চরম অধার্মিক ও দুর্নীতিতে আপাদমস্তক নিমজ্জিত স্বৈরশাসক এরশাদ। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার প্রদানকারী সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ শব্দগুচ্ছের আড়ালে নির্বাসনে পাঠিয়ে পরনির্ভরশীল মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের দর্শন ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিকে’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে লালন করা হচ্ছে গত ৩৭ বছর ধরে।
অথচ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জনগণের মালিকানাধীন একটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা, যে রাষ্ট্র শোষিত-বঞ্চিত শ্রমজীবী জনগণের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানোর সুকঠিন সংগ্রামে শ্রমজীবী জনগণের পক্ষের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কার্যকরভাবে ভূমিকা পালন করবে, যে রাষ্ট্র সমাজ পরিবর্তনকে তার মূল মিশন হিসেবে বিবেচনা করবে। কিন্তু, সামরিক স্বৈরশাসকগণ ১৯৭৫ সালে ঐ রাষ্ট্রটিকে ছিনতাই করে আবারো নব্য-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রান্তীয় অবস্থানের একটি মুৎসুদ্দি ও মক্কেল রাষ্ট্রের পুরানো অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন, যে রাষ্ট্রের অর্থনীতি লজ্জাজনকভাবে বৈদেশিক ঋণ ও খয়রাত-নির্ভর হয়ে পড়েছিল, যেখানে সরকারী উন্নয়ন বাজেট শতভাগ ঐ বৈদেশিক ঋণ ও খয়রাত-নির্ভর ছিল, যেখানে দেশের রপ্তানী আয় দিয়ে আমদানী ব্যয়ের মাত্র ৩১ শতাংশ মেটানো যেতো এবং বাকিটা মেটাতে হতো বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের অর্থে (১৯৮০-৮১ অর্থ-বছর)। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে সমরপ্রভুদের অবৈধ ও অসাংবিধানিক কাটা-ছেঁড়ার পর্ব পেরিয়ে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রীয় চার মৌল নীতি সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু, ২০১১ সালে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হলো, তাতে রাজনীতির সাম্প্রতিক বাস্তবতার ধুয়া তুলে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এ-দুটো নীতিকেই বহাল রাখা হয়েছে, যাকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার নজির বলাই সমীচীন মনে করি। ধর্মীয় মৌলবাদী ফ্যাসিবাদীদের ধর্মান্ধ তাণ্ডব সৃষ্টির আশঙ্কাকে ভয় পেয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতিতে ধর্মীয় জিগিরকে স্থান করে দিলো, এই জগাখিচুড়ি অবস্থান গ্রহণ করে। হায়রে ধর্মনিরপেক্ষতা!
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১-২০১২ পর্বে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু, সামরিক স্বৈরাচারী শাসন থেকে আপাতদৃষ্টিতে এদেশের জনগণ নিষ্কৃতি পেয়েছে মনে হলেও বিশ্লেষণের গভীরে গেলে বোঝা যাবে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি এখনো তেমন প্রণিধানযোগ্যভাবে বেগবান হয়ে ওঠেনি। যদিও গত ২১ বছরে যে চারবার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত অভিমত রয়েছে, তবুও এ চারটি নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ শ্রমজীবী জনগণের শোষণমুক্তির পথে সংগ্রামের ধারা জোরদার হওয়ার সম্্ভাবনা উজ্জ্বলতর হয়েছে বলা যাবে কি? এমনকি, সাধারণ জনগণের কাছে সত্যিকার অর্থে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টিও আজো অধরা রয়ে গেছে। দুটো প্রধান রাজনৈতিক দল অন্যান্য ক্ষুদ্রতর দলের সমর্থনে কিংবা তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে পালাক্রমে দু’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে এই চারটি নির্বাচনে। কিন্তু, এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে, এই চারটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই শুধু ‘নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্বই’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে দুজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পালাক্রমে এদেশ শাসন করে চলেছেন, তাঁরা যেমনিভাবে নিজেদের দল দুটোকে একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে স্বৈরশাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছেন, তেমনিভাবে দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁরা পুরো দেশটাকেই তাঁদের একচ্ছত্র রাজত্বের খাস তালুক হিসেবে বিবেচনা করছেন। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যগণ, নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ কিংবা দলের অন্যান্য পদ-পদবীধারী সিনিয়র নেতৃবৃন্দ- কারো কোন স্বাধীন ভূমিকা পালন কিংবা ভিন্নমত প্রকাশকে কঠোরহস্তে দমনের সংস্ড়্গৃতি গেঁড়ে বসে রয়েছে দুটো দলেই। সংবিধানের ৭০ ধারার ভয়ে নেত্রীর সামনে থরহরি কম্পমান থাকেন বাঘা বাঘা সব নেতা-নেত্রীরা। বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের সংস্ড়্গৃতি চালু থাকার কারণে নির্বাচিত সংসদ বহুলাংশেই অকার্যকর থেকে যাচ্ছে প্রতিবারই। বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ এখনো অনেকখানি বহাল রয়ে গেছে। পরিষ্ড়্গার বোঝা যায়, প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র একেবারেই নেই। এমনকি সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের নির্বাচনী মনোনয়নও দলীয় প্রধানের একক কর্তৃত্বাধীন রয়ে গেছে। দেশের চারটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দুটোরই জন্ম দিয়েছেন ক্ষমতাসীন সামরিক একনায়করা, তৃতীয়টি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী ক্যাডার-নির্ভর দল। বামপন্থী বলে দাবিদার ডজন দুয়েক রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক অঙ্গনে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের সম্মিলিত জনসমর্থন অকিঞ্চিৎকর এবং তা বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী দিন দিন তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যকে প্রচণ্ড শক্তিশালী অবস্থানে উন্নীত করে চলেছে ব্যাংক, বীমা, ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, কোচিং সেন্টার, কিন্ডার গার্টেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ, প্রাইভেট স্ড়্গুল-কলেজ, রিয়াল এস্টেট ব্যবসা, চেইন স্টোর, পর্যটন ইত্যাকার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণের মাধ্যমে। তাদের এই অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ থেকে উদ্ভূত ক্রম প্রসারমান আর্থিক সক্ষমতার সাথে যোগ হচ্ছে বিদেশ থেকে, বিশেষত সৌদী আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে খয়রাতি অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত এনজিও ফান্ড, মসজিদ-মাদ্রাসার নামে সংগৃহীত অর্থ এবং ধর্মীয় কার্যক্রমের নামে দেশে আসা সাহায্য-সহায়তা। ফলে, বিশাল এক ক্যাডার বাহিনীকে তারা পরিপালন করছে নিয়মিত বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধে, ব্যাংক ঋণ, এনজিও ফান্ডিং এবং নানাবিধ লোভনীয় আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে। তাদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরি ও বিনিয়োগ অর্থায়ন প্রায় শতভাগ বরাদ্দ থাকছে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী ও ক্যাডারদের জন্যে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এসব ক্যাডারদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র যোগান প্রভৃতির প্রধান সূত্র বলে বহুদিন ধরেই অভিযোগ উঠছে। প্রয়োজনে বিভিন্ন সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর মাধ্যমে তারা তাদের শক্তির প্রকাশ্য মহড়া প্রদর্শনও করে চলেছে বারংবার। অতএব, বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ডাইমেনশান ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হচ্ছে জামায়াত-শিবিরকেন্দ্রিক ‘সশস্ত্র ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের’ ঘোষিত লক্ষ্যে মৌলবাদী অপশক্তিসমূহের সশস্ত্র প্রস্তুতি পর্বের শক্তি সঞ্চয়নের ব্যাপারটিতে। বিএনপির পাকিস্তান-প্রেমী রাজনীতির ছত্রছায়া সুকৌশলে ব্যবহার করে চলেছে এই অপশক্তিসমূহ, বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে। যেহেতু ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার রাজনীতির প্রধান আশ্রয় এখনো বিএনপি’ই রয়ে গেছে, তাই বিএনপি’র কাঁধে চড়েই বারংবার নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনে সমর্থ হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য মৌলবাদী দলগুলো। ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে ক্ষমতাসীন হয়ে মন্ত্রীত্ব কিংবা সাচিবিক শীর্ষ পদ বাগিয়ে জামায়াত রাষ্ট্রের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। উদাহরণ- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়। ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপির নেতা কর্মীরা প্রধানত দুর্নীতি, মার্জিন-কমিশন, ঠিকাদারি, টেন্ডার, চাঁদাবাজি, মাস্তানি ইত্যাকার পুঁজি লুণ্ঠনের মওকা বাগানোতেই ব্যস্ত থেকেছে। আর তাদের কাঁধে চড়ে ক্ষমতায় বসে জামায়াত-শিবির চক্র এবং তাদের ধুরন্ধর নেতৃবর্গ ও থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সুপরিকল্পিত হোমওয়ার্ক ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দখলদারি বৃদ্ধির প্রয়াস চালিয়েছে সেনাবাহিনীতে, সিভিল প্রশাসনে, পুলিশে, র্যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, শিক্ষা ক্যাডারে, স্বাস্থ্য ক্যাডারে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এনজিও সেক্টরে ও সেফটি নেট কর্মসূচিগুলোতে। এমনকি দেশের মিডিয়া সাম্রাজ্যেও উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপ্রবেশ করেছে তারা টিভি, রেডিও, পত্র-পত্রিকাগুলোর মালিকানা বাগিয়ে নিয়ে। অতএব, এদেশের অদূর ভবিষ্যতের যে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে জামায়াত-শিবির এবং তাদের বহুল-বিস্তৃত, সুসংগঠিত এবং আর্থিক বলে বলীয়ান নেটওয়ার্কগুলো যে কী পরিমাণ রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে সক্ষম হবে, সে বিষয়টি নিয়ে এখন থেকেই গভীর পর্যালোচনা ও সমীক্ষা চালানোর প্রয়োজন অনস্বীকার্য মনে করি।
উপরের আলোচনা-বিশ্লেষণে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর বিপুল শক্তি-সঞ্চয় ও প্রস্তুতি পর্বের সংক্ষিপ্ত যে বর্ণনা প্রদত্ত হলো, তাকে এদেশের ভবিষ্যতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ডাইমেনশান ও অশনি সংকেত ধরে নিয়েই নির্বাচনী রাজনীতির প্রধান কুশীলবদেরকে তাদের দাবার ছক সাজাতে ও দাবার চাল চালতে অনুরোধ করবো। গত চারটি নির্বাচনের মতো আগামী ২০১৪ সালের নির্বাচনও বিশ্বাসযোগ্যভাবে নিরপেক্ষ ও জালিয়াতিমুক্ত হতেই হবে। ধরেই নিতে হবে, ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তিগুলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে অবস্থান নেবে। কিন্তু, সাধারণ জনগণের কাছে তাদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই, এবং তারাও এটা ভালো করেই জানে। গত চারটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে বিপর্যয়কর পরাজয় বরণ করেছে জনগণের দ্বারা বিপুলভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, স্বজনপ্রীতি, বেধড়ক টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, আত্মীয়-তোষণ, কমিশন-মার্জিন শিকার ইত্যাকার পুঁজি-লুণ্ঠনের মোচ্ছব, অপশাসন এবং দুঃশাসন প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তাকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করেছে; সরকারের সুকৃতি ও সাফল্যগুলো চাপা পড়ে গেছে নেতিবাচক উপাদান ও ব্যর্থতাগুলোর প্রচার-প্রচারণার নীচে। ২০১২ সালের আগস্টে যখন বর্তমান মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনের মূল্যায়ন করি, তাহলে আবারো তাদের জনপ্রিয়তায় মারাত্মক ধস নামার আলামতগুলো ক্রমেই জোরদার হতে দেখছি। অথচ, অতীতের যে কোনো সরকারের চাইতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারের সাফল্যের ও সুকৃতির পাল্লা নিঃসন্দেহে ভারী বলতেই হবে। প্রধানত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নীচের কয়েকটি আশা-জাগানিয়া বিষয়কে জাতির গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলতেই হবেঃ
১· ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮২ শতাংশকেই ‘দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থানকারী’ বিবেচনা করা হতো। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুøরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপের’ (Household Income and Expenditure Survey ev HIES) প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ থেকে ৫ বছরে কমে ২০১০ সালে ৩১·৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ২০০০ সালে ঐ অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ, যা ৫ বছরে মাত্র ৪ শতাংশ কমে ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল ২০০৫ সালে। অথচ ২০০৫-২০১০ এই ৫ বছরে ৮·৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে অনুপাতটি। মানে, এই তথ্য বলতে চাইছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য নিরসনের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে ঐ ৫ বছরে। যদি জরিপের তথ্যকে রাজনৈতিক কারণে ম্যানিপুলেট করা না হয়ে থাকে, তাহলে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়ায় গতিসঞ্চার হওয়ার এই খবর দেশের জনগণের জন্যে বড় ধরনের সুখবর বলা চলে।
২· বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে ২০১১-১২ সালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ফলে দরিদ্র জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে দেশে বিরাট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বলা চলে, যদিও খাদ্য নিরাপত্তা শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয় না। তবুও বলতে হবে, ১৯৭০ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগানে প্রায় ৪০ লাখ টন ঘাটতি থেকে যেতো, আর এখন দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য যোগান দিচ্ছেন এদেশের কৃষকরা। কৃষিখাতের অন্যান্য ধরনের উৎপাদনেও গতিসঞ্চার হয়েছে। বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সৎ ও সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশের কৃষিখাতে প্রশংসনীয় গতি সঞ্চারিত হয়েছে, দেশের আপামর জনগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন।
৩· একই সাথে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও উৎপাদন ঘাটতির আশঙ্কা মোকাবেলায় প্রায় ১৪ লাখ টনের খাদ্যশস্যের বাফার স্টক গড়ে তোলা হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যশস্য মজুতের ক্যাপাসিটি ২০ লাখ টনে উন্নীত করার জন্য গুদাম সম্প্রসারণের কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছে। ফলে দেশে খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় প্রশংসনীয় সামর্থø অর্জিত হয়েছে বলা চলে।
৪· বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান মোতাবেক এদেশের প্রায় ৮০ লাখ অভিবাসী বিদেশে রয়েছেন। আরো প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী সরকারী এ তালিকার বাইরে রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়, যাদের বেশিরভাগই হয়তো অবৈধভাবে অভিবাসন করেছেন। প্রবাস থেকে এসব বাংলাদেশী অভিবাসীরা গত ২০১১-১২ অর্থবছরে ১২·৮৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা পরিবার-পরিজনদের ভরণ-পোষণ এবং নানাবিধ বিনিয়োগ অর্থায়নের জন্য দেশে প্রেরণ করেছেন বৈধ রেমিট্যান্স চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর (যেমন, হুন্ডি এবং দেশে আসা যাত্রীদের লাগেজ ও সরাসরি বহনকৃত) মাধ্যমে আরো প্রায় ১০-১৫ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর রেমিট্যান্স দেশ আসছে কিংবা আসছে না। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈধ ও অবৈধ পথে প্রেরিত কিংবা হুন্ডিওয়ালাদের কব্জাকৃত এই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ এদেশের অর্থনীতির বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠায় বিশাল অবদান রাখছে। যদিও অবৈধ পথে প্রেরিত বা হুন্ডিতে বিক্রিত বৈদেশিক মুদ্রা চোরাচালান, পুঁজি বিদেশে পাচার, মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ বৈধকরণের মতো নানান অবাঞ্ছিত প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে, তবুও স্বীকার করতেই হবে, নব্য-সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও পরনির্ভরতার দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হওয়ার একটি উজ্জ্বল সম্্ভাবনা তৈরি করেছে রেমিট্যান্সের এই ক্রমবর্ধমান প্রবাহ। দেশের ধনাঢ্য গোষ্ঠী নিজেদের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করার জন্য, ছেলেমেয়েদেরকে বিদেশে পড়ানোর জন্য, নিজেদের ও পরিবারের বিদেশে চিকিৎসার জন্য, ঘন ঘন বিদেশে বেড়ানোর জন্য, বিদেশে ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ক্রয়, শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা কিংবা বিদেশের ব্যাংকে জমা করার জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের বড় অংশটাই অপব্যবহার করছে। কিন্তু তদসত্ত্বেও এদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই এক কোটিরও বেশি অভিবাসী। জনশক্তি রপ্তানী খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটলে এই বিপুল বৈদেশিক আয়ের সূত্র এদেশের অনুন্নয়ন কাটিয়ে ওঠার পথে বিপুলভাবে অবদান রেখেই যাবে ভবিষ্যতেও।
৫· পাকিস্তান আমল থেকেই বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভরতাকে এদেশের অর্থনৈতিক অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য মনে করার ধারণাটিকে দেশ-বিদেশের উন্নয়ন-পণ্ডিতরা ‘প্রশ্নাতীত ভবিতব্যের’ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ/অনুদানকে এদেশের জনগণের জীবন-মরণ ইসুø মনে করা হতো। বিশেষত, খাদ্য সাহায্য নিয়ে মার্কিন ব্ল্যাকমেইলিং ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ ঘটানোর পর ‘বৈদেশিক খয়রাত না পেলে এদেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে না’ মর্মে বদ্ধমূল ধারণা গড়ে উঠেছিল বিশ্বব্যাপী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ও অভুøত্থানের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরবের মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশ নিজেদের পছন্দসই সরকার পেয়ে যাওয়াতে ১৯৭৬-১৯৮১ পর্বে এদেশে বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের বান ডেকেছিল। জিয়াউর রহমানের প্রিয় একটি বাক্য ছিলঃ ‘Money is no problem’। এহেন বৈদেশিক ঋণ/অনুদান প্রবাহের জোয়ার জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এদেশের অর্থনীতিকে এমনভাবে পরনির্ভরতার পঙ্কে নিমজ্জিত করেছিল যে, ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক ঋণ/অনুদান ১৩·৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৮০-৮১ ও ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানী আয় দিয়ে আমদানী বিলের মাত্র ৩১ শতাংশ মেটানো গেছে, বাকি ৬৯ শতাংশ মেটাতে হয়েছে বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের অর্থে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট (এডিপি) একশত ভাগই বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভর হয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে রপ্তানী আয় বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির যুগল ভূমিকার কারণে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে প্রকৃতপক্ষে ছাড়কৃত (actually disbursed) বৈদেশিক ঋণ/অনুদান ৯ শতাংশেরও নীচে নেমে গেছে।
৬· স্বাধীনতার পর তিন দশক ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকত। কিন্তু, একুশ শতকের ১২ বছরে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে প্রায় প্রতি বছর উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে এখনো ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু রেমিট্যান্সের ক্রমবর্ধমান প্রবাহ আমদানী-রপ্তানীর ঘাটতি এখন পূরণ করতে সমর্থ হচ্ছে প্রতি বছর। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০১২ সালের জুলাইয়ের ৩১ তারিখ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০·৭১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ৮ আগস্ট ২০১২ তারিখে রিজার্ভ ১১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
৭· বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ের প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তৈরি ওভেন পোশাক এবং নীটওয়্যার রপ্তানীতে বাংলাদেশ এখন চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। বিশেষত নীটওয়্যারে বাংলাদেশ ক্রমেই উৎপাদন খরচের বিচারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে এবং নীটওয়্যার উৎপাদনে যেহেতু বাংলাদেশের ফ্যাক্টরিগুলোর ‘অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন’ (domestic value added) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার রুলস অব অরিজিনের (৪০ শতাংশ) বাধা অতিক্রম করে গেছে, তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাফল্য নীটওয়্যারে ক্রমেই বাড়তে থাকবে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানী আয় ২৪·৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তবে এটুকুও বলতে হবে, রপ্তানী আয়ের প্রায় ৮৯ শতাংশ এ দুটো প্রধান আইটেমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াতে, এবং তাদের প্রধান আমদানীকারক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হওয়াতে বাংলাদেশ আরো বেশি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। অতএব, আমাদেরকে আমাদের রপ্তানী পণ্য বহুমুখীকরণ এবং রপ্তানীর বাজার সম্প্রসারণ ও বহুধাকরণের ব্যাপারে আরো বেশি যত্নবান হতে হবে। কিন্তু, এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, ২০১২-এর আগস্টের বাংলাদেশ এখন আর খয়রাত-নির্ভর, সাহায্য-ভিক্ষুক দেশ নয়, বাংলাদেশ এখন একটি বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যনির্ভর দেশ। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, এ দুটো রপ্তানী-তাড়িত শিল্প সস্তা নারীশ্রমের নিষ্ঠুর শোষণের ক্লাসিক উদাহরণ। কিন্তু, এ দুটো শিল্প বিকশিত না হলে এগুলোতে কর্মসংস্থান হওয়া নারীদের কী ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হতো, তা গভীরভাবে চিন্তা করতে বলি। এখানেই শোষিত নারী শ্রমিকদের পক্ষে সরকারকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। যেহেতু এ দুটো শিল্প ঋড়ড়ঃ ষড়ড়ংব শিল্প, মানে সহজেই গুটিয়ে ফেলা যায়, তাই বিদেশী ক্রেতাদের ব্ল্যাকমেইলিং এবং এদেশীয় গার্মেন্টস ও নীটওয়্যার শিল্প মালিকদের সাথে ন্যায্য মজুরি সম্পর্কিত দরকষাকষিতে সরকারকে শ্রমিকদের ন্যায্য স্বার্থের পাহারাদার হতে হবে। দরিদ্রতম অবস্থানের নারীদেরকে কোনমতে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প; কিন্তু মালিকদেরকে দ্রুত বিলিওনেয়ার বানানোর Foot looseও তৈরি করে দিযেছে এ দুটো শিল্প। পাহাড়প্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টির এই মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদী ক্ষেত্রগুলো বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী চরিত্রকে ভেংচি কাটছে বৈকি!
৮· প্রফেসর ইউনূসের যুগান্তকারী উদ্ভাবন ক্ষুদ্রঋণের ‘গ্রামীণ ব্যাংক মডেল’ গ্রামের দরিদ্র ও ভূমিহীন নারীদের কাছে সহ-জামানত বা বন্ধকী ব্যতিরেকে ব্যাংক ঋণ পৌঁছে দেয়ার একটি সফল পদ্ধতি হিসেবে বিশ্ব-স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। ২০০৬ সালে প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর সফল উদ্ভাবন গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্ড়্গার জয় করেছেন এবং বাংলাদেশ ‘হোম অব মাইক্রো ক্রেডিট’ নামে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছে। আশির দশক থেকে গত তিন দশকে হাজার হাজার এনজিও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের নানাবিধ ‘কাস্টমাইজড’ পদ্ধতি নিয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে মাঠে নেমে পড়েছে। কিন্তু, বিশ্বব্যাপী ১৬০টির মতো দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ‘গ্রামীণ মডেলটিই’ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছে।
৯· বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবেই বাড়ছে এবং গত ৫ বছর যাবত ঐ হার ৬ শতাংশ অতিক্রম করে চলেছে। ২০০৭ সাল থেকে চলমান বিশ্ব মন্দা সত্ত্বেও এ প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখা গেছে।
১০· স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বাংলাদেশে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
উপরের ইতিবাচক পরিবর্তনের কৃতিত্ব কোনো নির্দিষ্ট সরকারকে দেওয়া না দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। ওয়াকিবহাল মহল নিজেরাই তা নির্ধারণ করতে পারবেন। নীচে বর্ণিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পথের মূল বাধাগুলো একই ধারা অনুসরণ করবে, কাউকে খাটো করার প্রয়োজন নেইঃ
১· বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে মারাত্মক বাধা দুর্নীতি। রাজনৈতিক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, ব্যবসায়িক দুর্নীতি, ঠিকাদারির দুর্নীতি- সবই আজ প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে। দুর্নীতিতে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন বাহাদুরি! নখদন্তহীন দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
২· স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বছরটি বাদ দিলে গত ৪১ বছর সরকারগুলো আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি করায় অবদান রেখে চলেছে নিরন্তর। তাই, ২০১২ সালের বাংলাদেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আয় বৈষম্য পরিমাপের জন্য ‘গিনি সহগ’ বলে একটা বহুল ব্যবহৃত পরিমাপ ব্যবহার করি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল ০·২৮ (মানে নিম্ন বৈষম্য), ২০১০ সালের HIES জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০·৪৬৫। মানে, গিনি সহগ ০·৫ অতিক্রম করলে বাংলাদেশ উচ্চ বৈষম্যের দেশে পরিণত হবে। এটারই প্রতিফলন হলো, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মাত্র দুটো পরিবার পড়েছিল বাংলাদেশের ভাগে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকই তথ্য দিচ্ছে, বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৩,২১২ জন। কালো অর্থনীতি, কালো টাকা, চোরাকারবারির টাকা, ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজের টাকা নিশ্চয়ই ঐ হিসাবে আসেনি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশের ১৬ লাখেরও কম মানুষ দেশের স্বাধীনতা-উত্তর ৪১ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফসলটা কুক্ষিগত করে নিয়েছে। দেশের ৯৯% জনগণ এই লুণ্ঠনমূলক অর্থনীতির ন্যায্য সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে।
৩· দেশের রাজনীতি দুবৃêত্ত-কবলিত হয়ে গেছে। কালো টাকা ও পেশী শক্তি ক্রয়ের সামর্থø নির্বাচনী মনোনয়ন কেনাবেচার বাজারে প্রধান নির্ধারক হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি ও মাস্তানি কোটিপতি হওয়ার সোজা পথ, আবার এদের সবারই গডফাদার কোনো না কোনো রাজনীতিবিদ।
৪· নির্বাচনী রাজনীতি দৃশ্যমানভাবে দুই দলের মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হলেও প্রকৃতপক্ষে দুই পরিবারের পরিবারতন্ত্রই এই প্রক্রিয়ার মূল ফায়দাভোগী। প্রফেসর আনিসুর রহমান তাই একে ‘নির্বাচিত জমিদারতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। যুবরাজ তারেক রহমান লন্ডনে বসেই বিএনপির মূল পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক, এটা কে না জানে!
৫· কোনো নির্বাচনেই পরাজিত দল নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেয়নি গত ২১ বছরে এবং নির্বাচনে হেরে যওয়ার পর থেকে আবারো ক্ষমতাসীন হওয়া পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সরকারের বিরুদ্ধে সব ধরনের সাবোটাজ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটাই এদেশের প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক সংস্ড়্গৃতি হিসেবে চালু হয়ে গেছে।
৬· গত ২১ বছরের প্রতিটি ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের শাসনামলে বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের পছন্দমত সাজিয়ে গেছে পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনার অসদুদ্দেশ্যে। কিন্তু, প্রতিবারই অধুনালুপ্ত কেয়ারটেকার সরকার ঐ সাজানো ছক তছনছ করে দেওয়ায় ঐ ধরনের ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ ভণ্ডুল হয়ে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘নির্দলীয়’ বনাম ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার নিয়ে দু’দলের অবস্থানকে এ আলোকেই বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। উপরে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম ন্যক্কারজনক রাজনীতিকীকরণ বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
সুধীমণ্ডলী,
আমার স্মারক বক্তৃতার শিরোনামের প্রথম অংশ ‘বাংলাদেশে সমাজ বিবর্তন’ হলেও সমাজ বিবর্তনের তাত্ত্বিক আলোচনা আমি যথাযথ বিবেচনা করিনি সীমিত কলেবরে ওই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ না থাকায়। তাই কৈফিয়ত হিসেবে বক্তৃতার শেষে এসে বলতে চাই, বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ সামীর আমীনের National Social Formation তত্ত্বে যেভাবে তিনি Peripheral Capitalism বা প্রান্তীয় পুঁজিবাদের তত্ত্বের সাহায্যে মার্কসীয় ‘সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন তত্ত্ব’ এবং বারান-সুইজীর ‘আধিপত্য-পরনির্ভরতা’ ভিত্তিক ‘নব্য-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার’ স্বরূপ উদঘাটনকারী ‘অনুন্নয়নের নব্য-মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের’ অবস্থানকে সুসমন্বিত করেছেন, সেটাকেই আমি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করি।
এই তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমিও বলি, বাংলাদেশ একটি প্রান্তীয় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা নিয়েই ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছে। উপনিবেশ-উত্তর অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা অন্যান্য প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে অগ্রন্থিলতা (disarticulation)) বা সমন্বয়হীনতা রেখে দিয়েছে। কিন্তু, ঔপনিবেশিক যুগে ‘পুঁজিবাদী কেন্দ্রের’ (metropolitan capitalist centres) সাথে প্রান্তীয় অবস্থানের উপনিবেশ হিসেবে ‘অসম বিশেষায়ন’ এবং ‘অসম বিনিময়ের’ (ঁunequal exchange) সম্পর্কের জালে বন্দী হয়ে প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে পুঁজি পাচার, পুঁজি লুণ্ঠন এবং শোষণের শিকার হয়ে গেছে। সামীর আমীন তার xtraverted circuit of capital কনসেপ্টের সাহায্যে দেখিয়েছেন, সদ্য স্বাধীন উপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোর বেশিরভাগই এখনো নব্য-সাম্রাজ্যবাদী ঐ শৃঙ্খল ভাঙতে পারেনি। হামজা আলাভী এং অনুপম সেন রাষ্ট্রের তুলনামূলক স্বশাসন ক্ষমতা অর্জন সম্্ভাবনা সম্পর্কিত মার্কসের কনসেপ্টটি তাত্ত্বিকভাবে বিন্যস্ত ও সম্প্রসারিত করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রবণতার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। এই তাত্ত্বিক অবস্থান থেকেই গ্রন্থপঞ্জিতে তালিকাভুক্ত আমার এ সম্পর্কিত বইয়ের মূল থিসিসটি আমি নির্ধারণ করেছিঃ
‘বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র।’
ধন্যবাদ।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
Alam H, (1975), ‘India and the Colonial Mode of Production’, in R. Miliband and J. Savile (eds.), The Socialist Register 1975. Merlin, London.
Amin S. (1977), Imperialism and Unequal Development, Harvester Press, Hassocks and Monthly Review Press, New York, originally published in French in 1976.
Baran. P. (1973), The Political Economy of Growth, Penguine, Harmondsworth, originally published in 1957.
Baran. P & P. Sweezy (1968), Monopoly Capital, Penguine, Harmondsworth, originally published in 1966.
Bukharin N. (1972), Imperialism and World Economy, Merlin, London, originally published in Russian in 1917.
Chakravarthi Raghavan (1991), Recolonization: GATT, The Uruguay Round & the Third World, Third World Network, Malaysia.
Emmanuel. A (1972), Unequal Exchange. A Study of the Imperialism of Trade, New Left Books, London and Monthly Review Press, New York, originally published in French in 1969.
Frank, A. G. (1969), Capitalism and Underdevelopment in Latin America, Modern Reader Paperbacks, New York, First edition published in 1967.
Frank A. G. (1972), Lumpenbourgeoisic: Lumpendevelopment, Monthly Review Press, New York and London.
Hilferding R. (1970), Finance Capital (Le Capital Financier), Editions de Minuit, Paris, originally published in German in 1910.
ইসলাম, মইনুল, (১৯৯৭), ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্র কি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্তরায়?’ বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ ও দুর্নীতির অর্থনীতি, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, পৃঃ ৯-২৬।
ইসলাম, মইনুল, (২০০৩), ‘বাংলাদেশের অনুন্নয়নে মুৎসুদ্দি সরকার ও মুৎসুদ্দি পুঁজির ভূমিকা’, প্রান্তীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও অনুন্নয়নঃ প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, প্যাপিরাস, ঢাকা, পৃঃ ৯-১৮।
ইসলাম, মইনুল, (২০০৩), ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম বাংলাদেশের মুক্তবাজার অর্থনীতি’, প্রান্তীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও অনুন্নয়নঃ প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, প্যাপিরাস, ঢাকা, পৃঃ ১৯-৪৯।
Kautsky, K (1970), ‘Ultra-imperialism’, New Left Review, 59, Jan./Feb., originally published in German in 1914.
Lenin V.I. (1950), Imperialism, The Highest Stage of Capitalism, in Selected Works, Vol. I. Foreign Languages Publishing House, Moscow, originally published in Russian in 1917.
Luxemburg. R. (1951), The Accumulation of Capital, Routledge & Kegan Paul, London, originally published in German in 1913.
Myrdal. G. (1957), Economic Theory and Underdeveloped Regions, Duckworth, London.
Sen. A. (1982), The Statge, Industrialization and Class Formation in India, Routledge & Kegan Paul, London.
Sobhan, R. (1993), Agrarian Reform and Social Transformation, University Press Limited, Dhaka.
Sobhan, R. (1993), Memorial Lecture delivered in the biennial conference of the Bangladesh Economic Association, Dhaka, P. 6.
Stern. N. (2001), A Strategy for Development, The World Bank, Washington D.C.
Wallerstein. I. (1974), The Modern World System, Academic Press, New York.
বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ কর্তৃক ২৫ আগস্ট ২০১২ তারিখে শাহবাগস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত।
Leave a Reply