List

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার পঞ্চম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে 

পঞ্চম স্মারক বক্তৃতা ২০১০

২৭ জানুয়ারি

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

দিন বদলের অঙ্গীকারের আলোকে বাংলাদেশের বিদেশনীতি

ফারুক চৌধুরী

বাংলাদেশের অর্জন আর গঠনে শামস কিবরিয়ার অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধা আমাদের প্রজন্মের ইতিহাসের একটি গৌরবময় গাথা হয়ে রইবে। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন আমাদের প্রজন্মের একজন অনুপম প্রতিনিধি। বাংলাদেশের একজন সফল অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার সুনাম সর্বজনবিদিত। তবে সুদীর্ঘ সাড়ে তিনটি দশক পররাষ্ট্রনীতির অঙ্গনে সহকর্মী হিসেবে তার কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য ও সুযোগ আমার হয়েছিল। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে কূটনীতিক হিসেবে তার মেধা, দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা আর সাহসিকতা বাংলাদেশের জন্য সুনাম অর্জন করেছিল। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উপমহাদেশ থেকে যুদ্ধের বারুদের গন্ধ মিলিয়ে যেতে না যেতেই, আমাদের অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির মঙ্গলের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সহযোগিতার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোলকাতার রাজভবনে একটি ভাষণে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যদি তা অর্জন করতে না পারি তাহলে আমাদের ভাবী বংশধরেরা আমাদের ক্ষমা করবে না।’ আমাদের অঞ্চলের জনসাধারণের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে, সার্কের আঙ্গিকেই হউক অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থা এসকাপ (ঊঝঈঅচ)- এর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে; শামস কিবরিয়া অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। সার্কের কৌশলগত চিন্তা ধারাকে পরিস্ফুট করে তুলতে তিনি রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য অবদান। এই অঞ্চলের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে এসকাপের জন্যে এমন একটি ভূমিকা তিনি রচনা করেছিলেন যে তার সময় এসকাপকে (ঊঝঈঅচ) অনেকে সংস্থাটির ‘স্বর্ণêযুগ’ বলে অবহিত করেছিলেন।
১৯৭২ সালের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে যখন আমরা একসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলাম। আমাদের রাষ্ট্রের শুরুর সেই দিনগুলোতে আমরা একসঙ্গে পরিশ্রম করেছি, একসঙ্গে স্বপ্ন দেখেছি একটি সুন্দর সুখী বাংলাদেশের। শামস কিবরিয়া তার অবিচল অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্যে বাংলাদেশের মাটিতেই তার তাজা রক্ত ঢাললেন, নৃশংসতার যুপকাষ্ঠে সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় তিনি প্রাণ দিলেন। তবে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে শামস কিবরিয়ার স্মৃতি, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে নিরন্তর প্রেরণা যোগাবে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৬০ বছরেরও বেশি সময় পূর্ণ করেছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই দেশের মানুষের ‘মুক্তির সংগ্রাম’ আর ‘স্বাধীনতার সংগ্রামের’ সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা, বাংলাদেশের অভুøদয়ের দুই দশকেরও আগে থেকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এ সম্পৃক্ততা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক বিবর্তনকে প্রভাবান্বিত করেছে এবং অতঃপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করেছে। ১৯৭১ সালের বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে এবং একটি সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তায় বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিশ্বে অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি ছিল আমাদের ভাবনা আর প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে। অন্তবর্তীকালিন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব ছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে বিশ্বে জনসমর্থন ও সহানুভূতির সৃষ্টি করা। এই ক্ষেত্রে মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকার সেই স্মরণীয় দিনগুলোতে অসাধ্য সাধন করেছিল। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ, পেশাজীবী এবং প্রবাসী জনগোষ্ঠী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান।
একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, পাকিস্তানের সে সময়কার পররাষ্ট্রনীতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের এবং কখনো বা পরিচালনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আইয়ুব শাহীর সময়ে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ একটি বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরল; আর তা হলো যে আইয়ুব-ভুট্টোর ‘গেম প্ল্যানে’ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়তির হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা দাবির ঝড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের এই নিরাপত্তাহীনতার কথাটি বারবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো, মানুষের মনে একটি কথা দানা বাঁধলো- যে নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই এ অঞ্চল, যা বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, তার নিজের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করতে হবে- যাতে প্রতিফলিত হবে এই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা।
আমাদের এ ভূখণ্ডে ইতিহাসের কোন লগ্নটিতে আমাদের জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল, তা নিরূপণ দুরূহ। এ ভূখণ্ডের হাজার বছরের ইতিহাসে আমাদের জাতীয়তাবোধের চেতনাকে সজীবিত করেছে ইতিহাসের বিভিন্ন লগ্নের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্ড়্গৃতিক স্রোতধারা। বৌদ্ধ পাল রাজাদের যুগ, সেন রাজাদের কাল, ইসলামিক সুফি সাধকদের আগমন, ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়, সুলতানি আমল, ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ, বণিক ইংরেজের মানদণ্ডের রাজদণ্ডে রূপান্তর, ফারায়েজি আন্দোলন, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বঙ্গভঙ্গ আর বঙ্গভঙ্গ রদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশ বাংলাদেশের রাজনীতি, পকিস্তান আন্দোলন ও ভারত ভাগ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ; হাজার বছরের ইতিহাসের চড়াই-উৎরাইয়ে অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিতে দানা বেঁধেছে আমাদের জাতীয়তাবোধ। আমাদের জাতীয়তাবোধকে আলোকিত করেছে অতীশ দীপঙ্করের জ্ঞানের প্রদীপ, মধুর করেছে চণ্ডিদাস আর আলাওলের পদাবলি, অটল করেছে হজরত শাহজালাল অমর সুফি সাধকদের মহানুভবতা, সরলতা আর বিশ্বাস, উদ্বুদ্ধ করেছে রবীন্দ্র-নজরুলের শতরূপে সাজানো আমাদের যাদুকরী বর্ণমালা।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ভারতকে তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় করেছিল। ভারতের সেই মুহূর্তের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের বিভক্তিকরণ। ভারতের ‘ইনস্টিটিউট অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের’ তদানীন্তন পরিচালক কে, সুব্রামানিয়ামের ভাষায় আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ভারতকে এনে দিয়েছিল ‘শতাব্দীর সুযোগ’ (ঈযধহপব ড়ভ ধ ঈবহঃঁৎু)। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতার প্রধান কারণ ছিল আমাদের জাতীয় লক্ষ্য আর সেই সময়কার ভারতের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যের সমন্বয়। তা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবোধকে প্রভাবিত করেনি। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায়, জাতীয়তাবোধ শাশ্বত আর পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য সাময়িক। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় সামগ্রিক জাতীয় লক্ষ্যেরই বাস্তবায়নে।
এই পটভূমিতেই ঘটেছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তাই বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন তখন তার পাওয়া মাত্র একহাজার দিনরাত্রির কিছু বেশি সময়ের মাঝেই তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, জোট নিরপেক্ষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি রচনা করে যেতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সাথে তিনি ভারতের সাথে বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে তিনি অর্থবহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূচনা করে যেতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে, সে সময়কার বিরূপ পরিস্থিতিতেও সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের সূচনা হয়েছিল, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা; বঙ্গবন্ধুর ওয়াশিংটন সফর আর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের ঢাকা সফর রচনা করেছিল দুই দেশের মাঝে স্বাভাবিক সম্পর্কের ভিত্তি। সেই ৩টি বছরের মাঝে বাংলাদেশ জাপানসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু বিরাজমান উত্তেজনা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সেই ৩ বছরের মাঝে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছিল কমনওয়েলথে, লাভ করেছিল জাতিসংঘের সদস্যপদ, ইসলামিক জোট সম্মেলনে সাদরে আমন্ত্রিত হয়েছিল, যোগ দিয়েছিল জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রমণ্ডলীর দলে। মাত্র ৩টি বছরে বঙ্গবন্ধু বেশ ক’টি আন্তর্জাতিক এবং বহুপাক্ষিক সম্মেলনে রেখেছিলেন তাঁর অবদান। ১৯৭৩ সালের আগস্টে অটোয়ার কমনওয়েলথ সম্মেলন, সে বছরেরই সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্স জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন, সে বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আর ১৯৭৫ সালের মে মাসে জামাইকার কিংসটনের কমনওয়েলথ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তাঁর উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর, পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কিংসটনের কমনওয়েলথ সম্মেলনই ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মবহুল জীবনের অংশ নেওয়া তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারবর্গের অনেক সদস্যকে, কতকগুলো বর্বর মানুষের কাপুরুষোচিত আর হিংসাত্মক উন্মত্ততার কারণে আমরা চিরদিনের জন্য হারালাম। তবে এটা বলতেই হয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মৃতুøর আগে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি রচনা করতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মৃতুøর সাথে সাথে এ দেশে শুরু হলো হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, সামরিক বাহিনী প্রভাবান্বিত অথবা সরাসরি সামরিক শাসিত সরকারের ধারাবাহিক ক্ষমতা দখল। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভূলুন্ঠিত হলো, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবোধ, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সহযোগিতা নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের যেসব আদর্শ বিশ্বের নজর কেড়েছিল তা হারিয়ে গেল।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতায় আবার নতুনভাবে বিশ্বের দরবারে আবিভূর্ত হলো, আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আবার রাখল বলিষ্ঠ এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ।
সেই সময়ে পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ উদ্যোগ বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। ১৯৭৫ সালের তুলনায় ১৯৯৬ সালের পৃথিবীর আর্থ-রাজনৈতিক এবং আদর্শগত অবস্থান নাটকীয়ভাবেই পালটে গিয়েছিল। তাই নতুন পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে শেখ হাসিনা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনেক সার্থক এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হলেন। তার মাঝে ছিল ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ, ডি-৮ ও বিমসটেক, উপ-আঞ্চলিক ফোরাম গঠন ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্‌্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে শেখ হাসিনা ভারত থেকে ৬০ হাজার অভিবাসীকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন। ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত দীর্ঘমেয়াদি পানিচুক্তি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টি করল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপমহাদেশে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একটি ত্রিদেশীয় শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করলেন। ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় ছাড়াও ৩ দেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারিরা তাতে অংশগ্রহণ করলেন। ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর দু’দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমিত করার আন্তরিক প্রচেষ্টায় শেখ হাসিনা ইসলামাবাদ ও দিল্লি সফর করলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, পররাষ্ট্র অঙ্গনে এক সক্রিয়, ইতিবাচক এবং ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু তারপর সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির ফলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচুøত করা হলো।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হলো। বিশ্বের নজরে বাংলাদেশ ধরা পড়লো একটি জঙ্গি, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুটি বছর ছিল একটি অপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সময়। একটি অপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের পক্ষে, পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদি সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্্‌ভব নয়। যাই হোক, ২০০৮ সনে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আবার আত্মপ্রকাশ করল।
কিন্তু সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি সাময়িক ব্যবস্থা, যখন কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানকে রাজনীতির বিরুদ্ধে অভিযানে রূপান্তরিত করে সমাজে অনিশ্চয়তা, ত্রাস এবং ভীতির সৃষ্টি করল, সুস্থ রাজনীতির বিকাশে তা একটা বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় এবং নির্মম আচরণ সমাজে ক্রোধ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করল। তবে সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত সাধারণ নির্বাচন এবং তার ফলাফল আজ দেশের সম্মুখে এক বিরাট সম্্‌ভাবনার সৃষ্টি করেছে এবং দিনবদলের সনদ নিয়ে আজ আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকার আগামী ৫টি বছর দেশ পরিচালনায় অবতীর্ণ হয়েছে। একটি জাতির ইতিহাস, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় সম্পদের অবস্থা দেশটির পররাষ্ট্রনীতিকে অবশ্যই প্রভাবান্বিত করে। সাম্প্রতিক ইতিহাস সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ পর্যালোচনা ইতিমধ্যেই করেছি। আমাদের স্বাধীনতা এবং চেতনাবোধের উৎস আমাদের মানুষের অনুভূতির সুগভীরে নিহিত রয়েছে, যা প্রভাবান্বিত করেছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের ইতিহাসের চড়াই-উৎরাইয়ে আহরিত অজস্র অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিই জন্ম দিয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের। ভৌগোলিক অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ, একটি শক্তিশালী ও বিরাট দেশ ভারতপরিবেষ্টিত, যদিও উত্তর-পূর্ব ভারত এবং ভারতের মূল ভূখণ্ডের মাঝে বাংলাদেশ কিছুটা বিশেষ অবস্থানেই রয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিবর্তনে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পূর্বসীমান্তে বাংলাদেশ তার ‘রাঙ্গামাটির পথে’ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর পূর্ব এশিয়ার মাঝে সংযোগ স্থাপন করছে, আর তা অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের যুগে হবে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। আমরা আফ্রিকা আর এশিয়ার দুটি মুসলমানপ্রধান অঞ্চলের মাঝামাঝি, মুসলমানপ্রধান একটি দেশ, যা ইসলামিক কনফারেন্সের সদস্যপুঞ্জের মাঝে আমাদেরকে দিয়েছে একটি বিশেষ স্থান।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির তিনটি মাত্রা রয়েছে। প্রথমত আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করা, দ্বিতীয়ত আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা স্থাপন করা এবং তৃতীয়ত বিশ্বে শান্তি স্থাপন এবং একটি উন্নয়নমুখী পরিবেশ স্থাপনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০০৮ সালে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কিছু ঘোষণা বিশেষ নজরের দাবি রাখে। তার প্রথম এবং প্রধান কথাটিই হলো বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। ১৫ কোটি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের দেশ বাংলাদেশ। একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, আধুনিকমনা দেশ বাংলাদেশ, যার বিরাট চ্যালেঞ্জ হলো দেশ থেকে দারিদ্র্য ও অজ্ঞানতা দূরীকরণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও উন্নতিকরণ করে বাংলাদেশের উন্নয়নের যাত্রা ত্বরান্বিত করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ কখনই পররাষ্ট্র সম্পর্কের অঙ্গনে নিস্ত্র্নিয় ভূমিকা পালন করতে পারে না। সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার এবং উজ্জ্বল করা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান অঙ্গীকার। আমাদের অঞ্চলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ একটি প্রধান সমস্যা। জঙ্গিবাদ এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশ এবং সরকারেরই শত্রু। তাই জঙ্গিবাদ দমনে এ অঞ্চলের সরকারগুলোর মাঝে, শুধু মুখের কথার নয়, সক্রিয় সহযোগিতার প্রয়োজন অপরিসীম।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে বহুমুখী সহযোগিতা জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ভারত পরিবেষ্টিত একটি দেশ, অতএব বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে পারস্পরিক লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা দু’পক্ষেরই করে যেতে হবে। দু’দেশই গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে যে কোনো বিবর্তনের মুখে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া এবং অনুভূতির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। ভারত যত বড় দেশই হোক না কেন বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার মূল্য তাদের অনুধাবন করতেই হবে, বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক; ভারতের জন্যেও তাই। দারিদ্র্য আমাদের দু’দেশেরই শত্রু এবং তাকে জয় করতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে বৈ-কি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর আমাদের দু’দেশের সার্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুতের ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক হয়ে রইবে বলে আমার বিশ্বাস।
একটি দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির জন্য বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতি একটি প্রধান উপাদান। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে, সে দেশে সত্যিকার অর্থে গতিশীল, বহুমুখী এবং বাস্তবধর্মী পররাষ্ট্রনীতি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
একটি গতিশীল পররাষ্ট্রনীতির জন্য দেশে অভ্যন্তরীণ শান্তির প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে ধর্মীয়, গোত্রীয় অথবা যে কোন প্রকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাব বর্জন করার। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা আমাদের বর্জন করতেই হবে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নিষ্ত্র্নিয়তার কারণে তা এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান সরকারকে এ চুক্তিটি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ জাতীয় সংহতির জন্যে তা অপরিহার্য।
যে দুটি দেশের সঙ্গে আমাদের স্থলসীমা রয়েছে, তা হচ্ছে বহুলাংশে ভারত এবং খানিকাংশে মিয়ানমার। ভারতের সঙ্গে আমাদের অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে এবং আগামী দিনেও যে নিত্যনতুন প্রশ্ন উঠে আসবে না, তা তো বলা যায় না। ভারতের সঙ্গে উদ্‌ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বে আমাদের পেশাদারিত্বকে শাণিত করার প্রয়োজন রয়েছে, প্রয়োজন রয়েছে সমস্যাদির খোলামেলা, স্বচ্ছ আলোচনার, যাতে আমাদের দেশের মঙ্গলের জন্যে আমরা বাস্তবমুখী, বাই-পার্টিজান অবস্থান নিতে সক্ষম হই।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক মঙ্গল সাধনে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে। রফতানি বাণিজ্য এবং বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির নিবিড় সম্পৃক্ততা রয়েছে। জনসংখ্যা রফতানি আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানেও প্রতিযোগিতামূলক জনসংখ্যা রফতানির বাজার আমাদের পররাষ্ট্র দফতর এবং দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় রইতে হবে। বিদেশি ভাষা, বিশেষ করে আমাদের জন্য ইংরেজি ভাষা শিক্ষা লাভের গুরুত্ব অপরিসীম।
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে যাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিবিড় হয়, সেই আহ্বান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায়ই সার্কের ভাবনার জন্ম হলো, যা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় থেকে বহুমুখী কূটনৈতিক তৎপরতার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময়ে। পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে উন্নততর সম্পর্ক সার্কের বর্তমান স্থবিরতাকে দূরীভূত করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত মূল্যবান জনগোষ্ঠী। তাদের প্রেরিত অর্থের সদ্ব্যবহার বাংলাদেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে সংসদের মাধ্যমে দেশের জনগণ আর তা বাস্তবায়িত করার পথ সুগম করবে পেশাদার কূটনীতিকরা। এ দেশের বিরোধী দলের অনুধাবন করার প্রয়োজন রয়েছে যে একমাত্র সংসদের মাধ্যমেই দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে, দেশের জন্যে একটি ‘বাই-পার্টিজান’ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে সহায়ক হতে পারে।
ওপরের আলোচনার আলোকে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ, সব দেশের, সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্ড়্গৃতিক সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক ফলপ্রসূ সহযোগিতার ভিত্তি প্রসারিত করতে হবে। ভারতের সঙ্গে গঙ্গাচুক্তির অনুরূপ অভিন্ন পানি বণ্টনের চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে যৌথ নদী কমিশনকে কার্যকর করা, ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যার সমাধান এবং সীমান্তে শান্তি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি মিয়ানমারের সঙ্গে চূড়ান্ত করতে হবে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির আলোকে সুষ্ঠু, যৌক্তিক ও সুষম ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য কার্যকর উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সার্ক, বিমসটেক ও ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোসহ অন্য প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগের প্রসার ঘটাতে হবে। শুধু বিদুøৎ জ্বালানি ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণই নয়, পরিবেশ, পানি ও বনজ সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সহযোগিতা ও যৌথ উদ্যোগ বাড়াতে হবে পর্যটনের ক্ষেত্রে। প্রাকৃতিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনপ্রসূত দুর্যোগ মোকাবেলায় আঞ্চলিক উদ্যোগ ও প্রস্তুতি, সাবধানকরণ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একটি আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সদ্য সমাপ্ত কোপেনহেগেন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান জোরালোভাবে উপস্থাপনে বাংলাদেশ সফল হয়েছে, আগামীতে আবহাওয়া এবং পরিবেশজনিত কর্মকাণ্ডে তা বাংলাদেশের সহায়ক হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চীন, রাশিয়া এবং আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক নিবিড় করার প্রচেষ্টা এখন জোরালো। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার সঙ্গে অধিকতর যোগাযোগ ও নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড়তর সম্পর্ক স্থাপনে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে এখন বাংলাদেশ সচেতন।
সৌদি আরব, মিশর, প্যালেস্টাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ এবং তুরস্ড়্গ, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের মুসলিম দেশসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক এবং উন্নয়ন ও সহযোগিতার ক্ষেত্র জোরদার করতে হবে। মুসলিম উম্মাহ্‌র সংহতি এবং ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) কাঠামোয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। উক্ত সংস্থার সব সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক স্থাপনে বাংলাদেশকে সচেষ্ট থাকতে হবে। আফ্রিকার আরব রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে স্থাপন করতে হবে অর্থবহ সম্পর্ক। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সাহারার দক্ষিণস্থ রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিকাশ এবং সেসব দেশে দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানুষের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।
জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অধিকতর অংশগ্রহণসহ এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা বাড়াতে হবে। কমনওয়েলথ ও জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন সংস্থাকে আরও ফলপ্রসূ করার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। বিশ্বায়নের স্বার্থে বাংলাদেশকে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও তার প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশে সবিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে বিশ্বায়ন ও উন্নত বিশ্বের একতরফা চাপের বিরুদ্ধে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
২০০৯ সালে দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গঠিত হয়েছে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন ইশতেহারটি তারই আলোকে প্রণীত হয়েছিল এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তো এই হবে যে একটি প্রগতিশীল, সক্রিয়, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের দিন বদলে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বে এই অর্জন সম্্‌ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।
২৭ জানুয়ারি ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]