List

বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়
অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহ্‌মদ

ভূগোল ও ইতিহাস বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্রভূমি এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।১ এই স্বাতন্ত্র্য দীর্ঘকাল আগে থেকে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানাবিধ নরগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসে বসবাস করতে শুরু করেছে। এ সকল নরগোষ্ঠী তাদের সঙ্গে এনেছে নিজস্ব বিচিত্র সাংস্ড়্গৃতিক উপাদান। এ সকল বহিরাগত উপাদান বা উপকরণের সঙ্গে বাংলার দেশজ উপাদানের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় সাধিত হয়েছে এবং এর ফলেই বাংলার সংস্ড়্গৃতির রূপান্তর ঘটেছে যুগে যুগে।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য ছিল। বাংলাদেশ প্রথমে মৌর্য সাম্রাজ্য- এবং পরে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কিন্তু উত্তর-ভারতকেন্দ্রীক আর্য বা হিন্দু শক্তি বাংলাদেশে বেশিদিন আধিপত্য বিস্তার করতে পারে নি। খুব সম্্‌ভব শশাঙ্ক প্রথম বাঙালি যিনি সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।২ যদিও শশাঙ্ক ছিলেন হিন্দু এবং শিবের উপাসক, তাঁর সময়ে তাঁর রাজ্যের সর্বত্র বৌদ্ধ ধর্মের বেশ প্রসার ও প্রতিপত্তি ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে এক অরাজক অবস্থা (মাৎস্যন্যায়) বিরাজ করছিল। পাল রাজত্বের প্রতিষ্ঠা এই অবস্থার অবসান ঘটায়। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনুরোধে গোপাল নামে একজন সৎ ব্যক্তি বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। বাঙালির ইতিহাসে এটি এক অনন্য গৌরবময় ঘটনা। জনসমর্থন নিয়ে রাজা হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল।৩ পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তাঁদের রাজত্ব বাংলাদেশে প্রায় চারশ’ বছর স্থায়ী হয়। পাল আমলে বাংলার সংস্ড়্গৃতির অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন সে যুগের বাংলার মনীষার এক আশ্চর্য নিদর্শন। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও সূচনা হয় পাল যুগে। এর পর দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন বংশীয় হিন্দু রাজারা বাংলাদেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু সেন রাজত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। সেন রাজারা উত্তর ভারত থেকে বেশ কিছু সংখ্যক শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এনে এদেশে বসতি স্থাপন করান। কিন্তু সনাতন হিন্দু-ধর্ম বাংলাদেশে গভীরভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি। তের শতকের প্রথম দিকে মুসলিম বিজয়ের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মমতে তান্ত্রিক ও বৌদ্ধ উপাদানের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত বাংলাদেশে সনাতন হিন্দু ধর্মের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল ছিল বলেই তুর্কি অভিযাত্রী মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর পক্ষে সহজে বাংলা জয় করা সম্্‌ভব হয়েছিল।
অনেকের ধারণা বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের সূচনা তের শতকের মুসলিম অভিযানের অনেক আগেই হয়েছিল। চট্টগ্রাম ও বাংলার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে খ্রিস্টীয় আট শতক থেকে আরব ব্যবসায়ী ও বণিকদের আনাগোনা ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এসব অঞ্চলে কিছু আরব বসতি স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে আরবদের সাংস্ড়্গৃতিক আদান-প্রদান হওয়াও অস্বাভাবিক ছিল না। তের শতকে মুসলিম বিজয়ের পর এ দেশে ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। সমাজের বিশেষ করে নিম্নবর্ণের মানুষ রক্ষণশীল হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা ও অন্যান্য অনুশাসনের উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইসলামের সহজ সরল বাণী ও সামাজিক সাম্যের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু যেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে এ দেশের মানুষ নিজস্ব দেশজ সংস্ড়্গৃতিকে বিসর্জন দেয়নি।
চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি স্বাধীন পাঠান সুলতান শামস্‌ উদ্দিন ইলিয়াস শাহ্‌ বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চলকে জয় করে ঐক্যবদ্ধ করেন। পাঠান সুলতানরা বহিরাগত হলেও এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হোসেন শাহী আমলে বাংলার ভাবজগতে এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাবের ফলে হিন্দু ভক্তিবাদ ও অন্যদিকে মুসলিম মরমী সুফি সাধকদের দ্বারা প্রচারিত আধ্যাত্মিক মানবতাবাদজ্জবাংলার সমাজ জীবনকে উজ্জীবিত করেছিল। গোড়াপত্তন হয়েছিল এক নতুন সমন্বয়ধর্মী বাঙালি সংস্ড়্গৃতির যার নিদর্শন সমকালীন বিশেষ করে ষোল ও সতের শতকের বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ সতের শতকের কবি আবদুল হাকিমের ‘নূরনামা’ উল্লেখ করা যায়। হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মের প্রতি সমানভাবে এই বাঙালি মুসলিম কবি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেনঃ
“আল্লা খোদা গোঁসাই সকল তান নাম
সর্বগুণে নিরঞ্জন প্রভু গুণধাম”৪
বাংলা ভাষার উন্নতি ও বিকাশের এটা ছিল স্বর্ণযুগ। মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারত’ ও ‘ভগবদ্‌গীতা’ প্রথমবারের মত সংস্ড়্গৃত থেকে বাংলাভাষায় অনূদিত হয়। ‘ভগবদ্‌গীতা’ অনুবাদ করার জন্য সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ্‌ মালাধর বসুকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সতের শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়; এর- পর থেকে এই অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ ‘সুবা বাঙ্গালা’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে আঠার শতকে মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর বাংলাদেশ আবার স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।৫
আঠার শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। এর ফলে এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন, চিন্তা-চেতনা এবং সংস্ড়্গৃতিতে এই পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
বস্তুত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাংস্ড়্গৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান উপাদানকে আমরা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারি। এগুলো হলোঃ (১) প্রাক-আর্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ উপাদান; (২) ইসলামী উপাদান; এবং (৩) পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয় উপাদান। এই উপাদানসমূহ পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংমিশ্রিত হয়ে এই অঞ্চলের গোটা সাংস্ড়্গৃতিক অঙ্গনকে বহুরূপে এবং বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা ও সংস্ড়্গৃতির মধ্যে এমন কতকগুলো দিক আছে যেগুলো আমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাঙালি চিরদিন ভাবপ্রবণ জাতি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “প্রাণের নামে, মানবতার নামে দাবি করলে এখানে সাড়া মিলবে।”৬ এবং ধর্ম সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়। বাংলার মানুষের মনকে ধর্মের-তা যে কোন ধর্ম হোক না কেন- বাহ্যিক আচার-বিচারের চেয়ে ধর্মের অন্তর্নিহিত ধর্মবাণী বেশী আকৃষ্ট করেছে। তাই এ দেশে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা কখনও জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেনঃ
“মানবপন্থী বাংলাদেশ প্রাচীনকালেও ভারতের শাস্ত্রপন্থী সমাজনেতাদের কাছে নিন্দনীয় ছিল। তীর্থযাত্রা ছাড়া এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। তার মানে বাংলাদেশ চিরদিনই শাস্ত্রগত-সংস্ড়্গারমুক্ত। বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতি মত এ দেশে বা তার আশেপাশে চিরদিন প্রবল ছিল। তখন মগধ বাংলার সঙ্গেই ছিল একঘরে অর্থাৎ স্বাধীন হয়ে। বাংলার বৈষ্ণব ও বাউলদের মধ্যেও দেখা যায় সেই স্বাধীনতা। তাদের সাহিত্যে ও গানে অলঙ্কার বা শাস্ত্রের গুরুভার তারা কখনও সইতে পারেনি। শাস্ত্রের বিপুল ভার নেই অথচ কি গভীর কি উদার তার ব্যঞ্জনা। এদেশে কীর্তন-বাউল-ভাটিয়ালি প্রভৃতি গানে খুব সাদা কথায় এমন অপূর্ব মানবীয় ভাব ও রস সাধকরা ফুটিয়ে তুলে গেছেন যে কোথাও তার তল মেলে না, কূল মেলে না। অপার মানবীয় ভাবের কোথায় সীমা কোথায় শেষ? প্রাণের মতোই তা সর্বভারমুক্ত ও সহজ তার অতল অপার তার রহস্য।৭
বাংলাদেশে ইসলামের বিস্তারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, মৌলবাদী রক্ষণশীল মোল্লাদের প্রচারণার চেয়ে সুফি-সাধক, পীর-দরবেশ, আউল-বাউলদের অবদান এ দেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর হয়েছে।৮ এই সব মরমী সাধক অনেকে তাঁদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক গুণাবলির জন্য সকল শ্রেণীর জনগণের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। ধর্মক্ষেত্রে তাঁরা যে ঐতিহ্যের সূত্রপাত করেছিলেন সেটা ছিল আধ্যাত্মিক মানবতার ঐতিহ্য, পরমত সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য, যেটা বাংলার মন ও মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের সাংস্ড়্গৃতিক ঐতিহ্যেও যে ধারণাটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সেটি বিরোধ বা সংঘাতের ধারা নয়, সেটি হলো বিভিন্ন মতবাদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের ধারা বা সমন্বয়ের ধারা। বস্তুত আমাদের জীবন ও সংস্ড়্গৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বৈচিত্র্যের মধ্যে সুরসঙ্গতি বা যধৎসড়হু।৯ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র ভারত উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক বিরোধের তেমন নজির দেখা যায় না। সাম্প্রদায়িক বিরোধ বা ধর্ম নিয়ে হিংসাত্মক হানাহানি বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা নানাবিধ ঐতিহাসিক কারণে ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি! বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা যেন সেই আবহমান ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই বৃহত্তর ঐতিহাসিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়কে নিরীক্ষণ করতে হবে।
যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের ফলে আমাদের সময়কালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে, সেই জাতীয় চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। বলা যায় যে ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির সময়কাল পর্যন্ত এই জাতীয় চেতনা এদেশে সম্পূর্ণরূপে গঠিত হয় নি। এই অঞ্চলের দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়জ্জ হিন্দু ও মুসলমান যদিও ভাষা, সংস্ড়্গৃতি, জীবনযাত্রার দিক দিয়ে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না, তা সত্ত্বেও প্রধানত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তাদের মধ্যে এক ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। জাতীয়তাবাদ মূলতঃ একটি ভূ-ভিত্তিক চেতনা; একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় সম্বন্ধে সম্মিলিত চেতনা বা অনুভূতি। এই চেতনার উন্মেষের পেছনে যে উপাদানটি সর্বাধিক প্রয়োজনীয় সেটি হ’ল এক সম্মিলিত ঐতিহ্যবোধ। এই ঐতিহ্যবোধ বা চেতনা যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে কেবল এক বংশজাত বা এক ধর্মাবলম্বী অথবা এক ভাষাভাষী হলেই কিংবা এক অঞ্চলে বা একই রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করলেই জাতীয়তাবাদের পূর্ণ স্ফূরণ ঘটে না। জাতীয়তাবাদ যেহেতু একটি ভূ-ভিত্তিক চেতনা, এর একটি প্রধান উৎস হল ভূ-খণ্ডের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা বা স্বদেশপ্রেম; সেই সঙ্গে এসে যায় সেই ভূ-খণ্ড বা দেশে বসবাসকারী ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর জনগণের মধ্যে একাত্মবোধ বা সহমর্মিতা। সুতরাং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
ভারত উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদ দুটি সমান্তরাল ধারায় আত্মপ্রকাশ করে; একটি ধারা ছিল চরিত্রগত দিক দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ। ১৮৮৫ সালে স্থাপিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে বলা যেতে পারে এই ধারার প্রতিভূ। যাঁরা এই ধারার অনুসারী ছিলেন তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, যেহেতু ভারত উপমহাদেশ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের আবাসভূমি- তাদের সকলের ধর্মীয় সাংস্ড়্গৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা সম্্‌ভব। যদিও কংগ্রেসের সদস্যদের মধ্যে হিন্দুরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে অনেক মুসলমানও এতে যোগ দিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকজন মুসলমান কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, যেমন বদরুদ্দীন তৈয়বজী, হাকিম আজমাল খান, ড· এম এ আনসারী এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। কংগ্রেসের এইসব মুসলমান নেতা বিশ্বাস করতেন যে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের তথা অন্যান্য সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দ্বারা নয়, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের দ্বারাই রক্ষা করা সম্্‌ভব। কিন্তু নানাবিধ কারণে ভারতের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। জাতীয়তাবাদের এই দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারা ১৯০৬ সালে ঢাকায় স্থাপিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ-এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। উল্লেখযোগ্য যে ভারতের গোটা মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ছিল বাঙালি মুসলমান। যদিও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমানরা এক অভিন্ন ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, তা সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয়কে সব সময়ে বজায় রেখেছে। বস্তুত ভাষা ও সংস্ড়্গৃতির দিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের চেয়ে ভিন্ন তো বটেই, তারা ছিল বাঙালি হিন্দুদের অনেক কাছাকাছি। অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতো। হিন্দুদের তুলনায় এইসব মুসলমান ছিল শিক্ষা ও সাংস্ড়্গৃতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর। বাংলার অধিকাংশ জমিদার ও মহাজন ছিল হিন্দু। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও বেশীর ভাগ তাদের হাতে ছিল। এর ফলে বাঙালি মুসলমানরা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগছিল। অন্যদিকে গ্রামের কৃষক শ্রেণী যারা অধিকাংশই ছিল মুসলমান তাদের উপর হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা নানারকম অত্যাচার ও শোষণ চালাতো। আবার শহর অঞ্চলে বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক ও উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা মুসলমানদের প্রতি উন্নাসিক মনোভাব পোষণ করতো এবং তাদেরকে নিচু চোখে দেখতো। অন্য দিকে বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব ছিল নগরবাসী উচ্চশ্রেণী আশরাফ বা শরীফ শ্রেণীর মুসলমানদের হাতে। এই শ্রেণীর লোকেরা ছিল অধিকাংশ অবাঙালি বহিরাগতদের বংশধর। তারা ছিল উর্দুভাষী এবং গ্রাম বাংলার বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের চেয়ে তাদের সাংস্ড়্গৃতিক সম্পর্ক উত্তর ভারতের উর্দুভাষী- মুসলমানদের সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠ ছিল। এই সকল কারণে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সমন্বয়ধর্মী বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। বস্তুত অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান মুসলিম লীগের প্রচারের ফলে ধর্ম-ভিত্তিক বিচ্ছিন্নবাদী মুসলিম জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থনে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টির পর বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সমাজ চিন্তায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়। ইতোমধ্যে এক নতুন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছে এবং এই শ্রেণী কেবল রাজনীতিতে নয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, যারা ছিল অধিকাংশই অবাঙালি, তারা যখন ইসলাম ও পাকিস্তানের সংহতির নামে বাঙালিদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করতে শুরু করল তখন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে এক নতুন চেতনা জাগ্রত হতে শুরু করল। এই অস্তিত্ব ছিল বাঙালি হিসেবে তাদের জাতীয় অস্তিত্ব। এই অস্তিত্ব যে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক নয়- এই অস্তিত্ব আঞ্চলিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ, সেকথা বলিষ্ঠভাবে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি মুসলিম মনীষী অধ্যাপক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাঁর ভাষায়ঃ
আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙ্গালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙ্গালীত্বের এমন দাগ মেরে দিয়েছেন যে
মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।১০
অধ্যাপক শহীদুল্লাহ এই ঐতিহাসিক উক্তিটি করেছিলেন ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য-সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে। ড· শহীদুল্লাহর এই অবিস্মরণীয় উক্তির মধ্যে নিহিত ছিল নতুন বাঙালি জাতীয় চেতনার মর্মবাণী। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগণ যারা ধর্মীয় বিভাজন সত্ত্বেও এক অভিন্ন সাংস্ড়্গৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারি এবং এক ভাষাভাষীজ্জ তাদের সম্মিলিত চেতনাই প্রতিফলিত হয়েছিল এই নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার মধ্য দিয়ে। এ কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই এই অঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহ এই নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত হয়েছে। ১৯৪৮-৫২ সময়কালের ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহ, যেমন ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ও যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২-৬৩ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন, ১৯৬৯ সালের গণঅভুøত্থান এবং আইয়ুব শাহীর পতন, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়, এবং পরিশেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ- এইসব ঘটনা ছিল পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বস্তুত এই ঘটনাসমূহ যেগুলিকে চিহ্নিত করা যায় নতুন বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষের বিভিন্ন পর্যায় হিসেবে, সেই পর্যায়গুলি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনেও প্রতিফলিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি আমাদের বাঙালি জাতি সত্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়া হঠাৎ করে শুরু হয়নি। বাঙালির দীর্ঘদিনের আত্মানুসন্ধান, দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও সংগ্রামের অমোঘ পরিণতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। আজ এ কথা ভেবে বিস্মিত হই যে, এই ভূখণ্ড যেটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথমে ‘পূর্ব বাংলা’ এবং পরে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পরিচিত ছিলো, সেটিকে ১৯৬৯ সালে ‘বাংলাদেশ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই জাঁদরেল পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে। এ দেশের রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করার পেছনেও শেখ মুজিবের অবদান ছিলো অনন্য। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আবার আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরজ্জএ দেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলা যেতে পারে বাংলাদেশের মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার ধারক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭০ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছিলো এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, সকল সম্প্রদায়ের মানুষজ্জ হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে একত্রিত হয়ে এক অখণ্ড বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়েছিল যেটা আগে কখনও হয়নি। বস্তুত এই সময় এই অঞ্চলের সর্বস্তরের বাঙালিদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিলো, যেটা গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে অর্থাৎ বিগত স্বদেশী যুগের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু সে আন্দোলনটা ছিল খণ্ডিত আন্দোলন। এর প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিলো এই যে, তখনকার মুসলমান সমাজের বৃহত্তর অংশ ঐ আন্দোলনে যোগ দেয়নি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার মুসলমানদের যোগ না দেওয়ার প্রধান কারণ ছিলো তাঁর ভাষায়জ্জ ‘তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।’১১
গত কয়েক দশকে আমাদের সময়কালে এই অঞ্চলের বাঙালি মানসচেতনায় যে অভূতপূর্ব স্বদেশপ্রেমের স্ফূরণ ঘটেছিল, সেই অনুভূতি ছিল একটা সামগ্রিক অনুভূতি, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলো। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় যেটা সম্্‌ভব হয়নি, আমাদের সময়কালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেটা সম্্‌ভব হয়েছিল।
স্বদেশী যুগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আমাদের সময়কালের বাঙালি জাতীয়তাবাদের আর একটা মৌলিক পার্থক্য হলো এই যে, সেকালের স্বদেশী আমলের বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি; তাঁদের জাতীয়তাবাদ ছিলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, তাঁরা ব্রিটিশ শাসিত সমগ্র ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু আমাদের সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়। বাঙালির সর্বকালের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছাড়া এটা সম্্‌ভব হতো না। তিনি সুকৌশলে ধাপে ধাপে আমাদেরকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার দাবির মধ্যে স্বাধীনতার পূর্বাভাস খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬৯-৭০ এর গণঅভুøত্থানে সেটা এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর বিখ্যাত ভাষণে বাংলার জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেশবাসীকে ডাক দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ··· ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। পাকিস্তানের জাঁদরেল সামরিক শাসকদের নাকের ডগায় বাস করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার সপক্ষে এর চেয়ে বলিষ্ঠ ও পরিষ্ড়্গার আহ্বান আর কি হতে পারতো সে সময়? বস্তুত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো তখন থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে কোনো সেনাপতি বা সমরনায়কের ডাকে শুরু হয়নি। এটি ছিলো দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বেচ্ছায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা দেয়ার পেছনে মনে হয় একটা কৌশলগত কারণ ছিলো। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিশ্বজনমতের সমর্থন লাভ করা সহজতর হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যদিও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো বঙ্গবন্ধুর নামেই পরিচালিত হয়েছিলো। যুদ্ধকালীন সময়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’ নামে পরিচিত ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগকে এককভাবে দায়ী করেছিল। পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তাঁর ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে দম্্‌ভভরে ঘোষণা করেনঃ
ঞযরং সধহ ধহফ যরং ঢ়ধৎঃু ধৎব বহবসরবং ড়ভ চধশরংঃধহ ধহফঃযবু ধিহঃ ঊধংঃ চধশরংঃধহঃড় নৎবধশ ধধিু পড়সঢ়ষবঃবষু ভৎড়সঃযব পড়ঁহঃৎু· ঐব যধং ধঃঃধপশবফঃযব ংড়ষরফধৎরঃু ধহফ রহঃবমৎরঃু ড়ভঃযরং পড়ঁহঃৎুঃযরং পৎরসব রিষষ হড়ঃ মড় ঁহঢ়ঁহরংযবফ?১২
পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার পথ সুগম করার অপরাধে পাক সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মৃতুøদণ্ড দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব জনমতের ভয়ে তারা সেই দণ্ড কার্যকর করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই শেখ মুজিবকে তারা মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছবার পর বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম ভাষণে ঘোষণা করেছিলেনঃ
আমি স্পষ্টভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।১৩
এই অসাধারণ ঘোষণার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র চিন্তার মূল নীতিগুলি পরিষ্ড়্গারভাবে ব্যক্ত করা হয়েছিল। বস্তুত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এই চারটি নীতিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সন্নিবেশিত করা হয়।১৪ এখানে এই চার মূলনীতির কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন এই কারণে যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই মূলনীতিসমূহের অপব্যাখ্যা করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে এসেছে। প্রথমে জাতীয়তাবাদের কথা ধরা যাক। আবহমানকাল থেকে বাংলার জনগণ বহির্বিশ্বের কাছে বাঙালি বলে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল সম্প্রদায়ের মানুষের আত্ম-পরিচয় সম্বন্ধে সম্মিলিত চেতনাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান উৎস। এই জাতীয় চেতনা ধর্ম-ভিত্তিক বা সাম্প্রদায়িক নয়; এটি অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা, যেটি গড়ে উঠেছে এক অভিন্ন ভাষা, সংস্ড়্গৃতি ও জীবনযাত্রার উপর ভিত্তি করে। সুতরাং আমাদের জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ। আবার আমাদের দেশে যে গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে, যেটি চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, সেটি ছিলো প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। তাই এই গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্্‌ভব নয়। তেমনি সমাজতন্ত্রকেও রাষ্ট্রের মূলনীতি করার পেছনে একটি বিশেষ কারণ ছিল। বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের অন্যতম। এ দেশের শতকরা ৮০ জন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে, মানবেতর জীবনযাপন করছে; অশিক্ষা, অনাহার ও বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। এই সকল বিপন্ন অসহায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন একমাত্র কোনো ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্্‌ভব। বস্তুত আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সমাজতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্্‌ভব নয়। তবে এই সমাজতন্ত্র যে নিছক টেক্‌স্টবুক সোশিয়ালিজম বা কেতাবী সমাজতন্ত্র, কিংবা সোভিয়েত রাশিয়া, গণচীন বা কোনো বিদেশী মডেল অনুযায়ী হবে না- এ ব্যাপারে আমার ধারণা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবতাবাদী সাংস্ড়্গৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উদ্‌ভাবন করতে হবে, যাতে জনগণের বৃহত্তম অংশের জীবনযাত্রার ন্যূনতম চাহিদা মিটানো সম্্‌ভব হয়। এ জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকেও যথেষ্ট পরিমাণে উৎসাহ দিতে হবে। উভয়ের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির পথ সুগম হবে।
এসব সমস্যা নিয়ে যখন আওয়ামী লীগ সরকারি মহলে ভাবনা-চিন্তা হচ্ছিলো এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল এবং এর ফলে কিছুটা সুফল পাওয়ার সম্্‌ভাবনাও দেখা দিয়েছিল ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক লোক, যারা নানাবিধ কারণে সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল, তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেষ রাতে এক অভুøত্থান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগের ভেতরেই খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে একটি চক্র বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত ছিলো। এই চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রুদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বস্তুত বাংলাদেশের ভেতরেই কিছু সংখ্যক লোক ছিল যারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং পুরোপুরি পাকিস্তানপন্থী। তারা অনেকেই পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়কে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাকিস্তানের প্রতি অনুরক্ত এক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে খন্দকার মোশতাক ও তাঁর অনুসারীদের যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সেটা এখন প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভুøত্থান ও স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল এই ষড়যন্ত্রেরই ফল।
বাঙালি জাতির চরম দুর্ভাগ্য, যে সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্যত হচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রের নির্মম শিকার হলেন তিনি। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুর চারজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান এঁদের জেলখানায় বন্দি অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এমনিভাবে উৎখাত করা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে। যাদের হত্যা করা হলো তাঁরা সকলেই ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির নায়ক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। এটা সর্বজন বিদিত যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসররা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুনজরে দেখেনি। তাই বাংলাদেশের মাটিতে যখন আধুনিককালের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হলো তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার দোসররা তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি, বরং হত্যাকারীদের নিজেদের দেশে আশ্রয় দিয়েছে। ষড়যন্ত্র ও হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মুখোশধারী যে ফ্যাসিস্ট সরকার অধিষ্ঠিত হলো, তাকে স্বীকৃতি দিতেও দ্বিধা করেনি। বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিচার কার্য একুশ বছর পর শুরু হলেও পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে এই বিচারকার্য স্থগিত করে দেয়।
আজ বাংলাদেশের জন্য বড় দুঃসময়। একাত্তরের স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকার ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের প্রেতাত্মা ও অনুসারীরা আজ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সদর্পে বিচরণ করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে গোটা দেশ এক হৃদয়হীন, দুর্নীতিবাজ, মনুষ্যত্ববিহীন, কুশিক্ষিত, যোগ্যতাহীন বিকৃত রুচিসম্পন্ন গোষ্ঠীর হাতে জিম্মী। এরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাঙালির স্বাধীন সত্ত্বাকে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের দুর্নীতি, দুঃশাসন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে চরম অযোগ্যতার ফলে আজ বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভয়ানকভাবে ক্ষুণ্ন, বস্তুত এদের হাতে পড়ে বাংলাদেশ এক ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে গণ্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই অসহনীয় অবস্থাকে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
১৯৭১ সালে যে-যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল- সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা কতখানি পূরণ হয়েছে স্বাধীনতা লাভের তিন দশকের অধিককাল পর এ প্রশ্ন উত্থাপন করা মোটেই অবান্তর নয়। এটা অনস্বীকার্য যে জনগণের অধিকাংশ প্রত্যাশাই পূরণ করা সম্্‌ভব হয়নি। কিন্তু তবু নিরাশ হওয়ার কারণ নেই। আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং অভিন্নতার আলোকে আমাদের ক্রমাগত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সাফল্য যেমন অকিঞ্চিৎকর নয়, তেমনি আমাদের ব্যর্থতাও পর্বতপ্রমাণ। একটা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বিপ্লবের পথ কণ্টকাকীর্ণ। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বিপ্লবের নায়করা ক্ষমতা লাভ করে কখনও কখনও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন; তাদের ভুল-ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতার জন্য তখন তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তখন বিপ্লবের অগ্নিশিখা অনির্বাণ রাখার জন্য আবির্ভাব হয়েছে নতুন নেতৃত্বের। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিক ঐবধৎহ ঝযধ িবলেছেনঃ ুঞযড়ংব যিড় ংঃধৎঃ ধ ৎবাড়ষঁঃরড়হ ধৎব ংবষফড়সঃযড়ংব যিড় বহফ রঃ, অর্থাৎ বিপ্লব যাঁরা শুরু করেন তাঁরা অনেকেই বিপ্লব শেষ করতে পারেন না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে তাই ঘটেছে। তবে ইতিহাসে বিপ্লবের সকল নায়কদের যথার্থ মূলে রযেছে; ইতিহাসের পাতা থেকে কাউকে মুছে ফেলা সম্্‌ভব নয়।
বাংলাদেশ আজ এক মহাসঙ্কটে নিমজ্জিত। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার সপক্ষের সকল শক্তিকে পরস্পরের মধ্যে ছোটখাটো মতপার্থক্য, বিরোধ ও ভুল বোঝা-বুঝির অবসান ঘটিয়ে এক অভিন্ন জাতীয় প্ল্যাটফর্মে মিলিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। স্বাধীনতার সংগ্রাম কখনও শেষ হয় না। নতুন নতুন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ বা হুমকির মোকাবেলা করার জন্য নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করতে হয়। তাই সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রতিহত করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করতে হবে- এই হোক আজ আমাদের অঙ্গীকার।

তথ্য নির্দেশ
১· ইতিহাসে গোটা পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ বলা হত। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত ও স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়ে যায় এবং এর নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণের স্বায়ত্ব শাসনের সপক্ষে গণঅভুøত্থানের সময় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, এর পর থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ না বলে ‘বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করা হবে।
২· নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব, প্রথম খণ্ড, তৃতীয় সংস্ড়্গরণ, কলকাতা ১৯৮০, পৃ · ১৪৯
৩· রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড ষষ্ঠ সংস্ড়্গরণ, কলকাতা ১৯৭৪, পৃ · ৪০
৪· রাজিয়া সুলতানা সম্পাদিত আবদুল হাকিম রচনাবলী, ঢাকা ১৯৮৯, পৃ · ৪৭২
৫· নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ· ১৪৯
৬· উদ্ধৃতি, ক্ষিতিমোহন সেন, বাংলার সাধনা, কলকাতা ১৯৬৫, পৃ· ৭
৭· ঐ
৮· এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন। অনফঁষ কধৎরস, ঝড়পরধষ ঐরংঃড়ৎু ড়ভঃযব গঁংষরসং ড়ভ ইবহমধষ, উযধশধ ১৯৫৯; এবং গধযধসসধফ ঊহধসঁষ ঐধয়, অ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঝঁভরংস রহ ইবহমধষ, উযধশধ, ১৯৭৫·
৯· ক্ষিতিমোহন সেন, প্রাগুক্ত, পৃ · ৭
১০· উদ্ধৃতি, বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, ঢাকা, ১৯৭০, পৃ · ১৮৩
১১ আগস্ট ২০০৫, সিরডাপ মিলনায়তন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]