List

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বাংলাদেশের এক কীর্তিমান পুরুষ। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি যেই জায়গায় নিজেকে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের কম সম্পাদকই তা পেরেছেন। শুধু সম্পাদক হিসেবেই নয়Ñ একজন সুলেখক ও রাজনীতি সচেতন দেশপ্রেমিক হিসেবেও তিনি অনন্য। দেশের দুঃসময়ে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানিক মিয়া সদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আজীবন স্বাধীরন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন কিন্তু অকালপ্রয়াণে মানিক মিয়া স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৬৯ সালের ১ জুন পাকিস্তানে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে তিনি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে দেশের অগণিত মানুষ শোকাহত হন।
আমি বিভিন্ন লেখায় অসংখ্যবার মানিক মিয়ার স্মৃতিচারণ করেছি। আজও তার স্মৃতিচারণ করতে বসেছি। যারা দেশের কৃতিসন্তান তাদের কথা যতবার বলা হবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। তাতে আগামী প্রজন্ম সমৃদ্ধ হবে। জানতে পারবে সঠিক ইতিহাস। যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেন কিংবা ইতিহাস সৃষ্টি করতে রসদ যোগান তারাইতো প্রাতঃস্মরণীয়।
মানিক মিয়া ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’ যে কলাম লিখতেন সেই কলামের আমি একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলাম। তার লেখা বাঙালি জাতির মানস ও মনন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন মানিক মিয়ার ছোট ছেলে বর্তমান মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। মঞ্জুর সঙ্গে বহুদিন মঞ্জুদের বাড়িতে গিয়েছি এবং মঞ্জুর মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না ও ছানা খেয়েছি। এমনকি ১৯৬৬ সালে হল ছেড়ে তাদের বাসায় এক মাস থেকে দুই বন্ধু মিলে অংক কষেছি। সেই সুবাদে মানিক মিয়া ও তার স্ত্রীকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। মানিক মিয়ার কাকরাইলের বাসায় আমি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে থাকতে দেখেছি, অসংখ্যবার দেখেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও।
বয়সের হিসেবে বঙ্গবন্ধু মানিক মিয়ার নয় বছরের ছোট ছিলেন, তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক মিয়ার ভীষণ সখ্য ছিল। মানিক মিয়ার বাসার সামনে অনেক দিন আমি বঙ্গবন্ধুর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। আজ যেটি ‘মুসাফির ভবন’ তখন ওই বাসার নাম মুসাফির ভবন ছিল না। কাকরাইলে আমাদের বাসা আর মানিক মিয়ার বাসা কাছাকাছি ছিল। সুসময়ে-দুঃসময়ে সবসময়ই বঙ্গবন্ধু মানিক মিয়ার পরামর্শ নিতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দুজনের সম্পর্ক অটুট ছিল। মানিক মিয়াকে বঙ্গবন্ধু ‘মানিক ভাই’ বলে ডাকতেন আর মানিক মিয়া বঙ্গবন্ধুকে ডাকতেন ‘মুজিবর মিয়া’ বলে। যারা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বঙ্গবন্ধু কতবার কতভাবে মানিক মিয়া ও ইত্তেফাকের প্রসঙ্গ তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় এলে মাঝে মাঝে তিনি মানিক মিয়ার বাসায় থাকতেন। তিনি যখন ঢাকায় আসতেন তখন ঝুড়ি ভরে আঙ্গুর, আপেল, নাশপাতি আর আলুবোখারা নিয়ে আসতেন। এখন যেমন ঢাকায় যেখানে-সেখানে ফল পাওয়া যায়, তখনকার দিনে এরকম পাওয়া যেতো না। তাই সোহরাওয়ার্দী সাহেব এলেই মঞ্জু আমাকে মাঝে মাঝে ওদের বাসায় নিয়ে যেতো আর ওসব ফল খেতে দিতো। সেসব দিনের কথা মনে হলে আজও স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। মানিক মিয়ার দুই ছেলে ও দুই মেয়েÑ হিরু ভাই, বেবী আপা, মঞ্জু ও রুবী।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন খুবই ব্যস্ত নেতা ছিলেন। ঢাকায় এলে তিনি খুবই ব্যস্ত সময় পার করতেন। অবসর যাপন করার মতো খুব সময়ই তিনি পেতেন। তিনি যখন বাথরুমে ঢুকতেন তখন অনেক সময় নিতেন। পরে জেনেছি বাথরুমে বসেই তিনি পেপার-পত্রিকা পড়াসহ বেশকিছু টুকিটাকি কাজ সেরে নিতেন।
মানিক মিয়া একটু রাগী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তবে তার অন্তরটা ভীষণ কোমল ছিল। মানুষের দুঃখে তিনি চঞ্চল হয়ে উঠতেন। কীভাবে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায় সেই উপায় বের করার জন্য অস্থির হয়ে উঠতেন। তিনি বাজার করতেন দুই হাত খুলে। বহুদিন তাকে নিউ মার্কেট থেকে খাঁচা ভর্তি মুরগি আর প্রচুর মাছ কিনে আনতে দেখেছি।
এদেশের ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করতে মানিক মিয়া সব সময় অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তিনি ছাত্র সংগঠনগুলোকে মাঝে মাঝে চাঁদাও দিতেন। ছাত্রলীগ হোক আর ছাত্র ইউনিয়নই হোক কেউ-ই তার কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে যেতো না। ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি মানিক মিয়া একটা অন্যরকম টান অনুভব করতেন। সেটা অবশ্য সময়ের কারণেই। কেননা তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন যে আদর্শ ধারণ করতো তাতে রাজনীতি সচেতন যে কোনো মানুষই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকা- ভালোবাসতো।
বাঙালি জাতির মনন বিকাশে ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ পত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। এই ইত্তেফাক পত্রিকা প্রথমে ছিল সাপ্তাহিক, পরে মানিক মিয়ার অক্লান্ত পরিশ্রমে সেটা দৈনিকে পরিণত হয়। অনেক আর্থিক অনটন ও দুঃখকষ্ট সহ্য করে তিনি ইত্তেফাক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝেই ইত্তেফাক পত্রিকার অফিসে আসতেন। তখনকার দিনে ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের অঘোষিত মুখপত্র ছিল। এর ফলে ইত্তেফাক এবং মানিক মিয়া আইয়ুব সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়েন এবং বেশ কয়েকবার ইত্তেফাকের প্রকাশনাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জীবনে মানিক মিয়া অনেক বার গ্রেফতার হয়ে কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। তবে তার কারাভোগ ছিল দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার জন্যই। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে সেই দাঙ্গা থামাতে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতাকর্মীর মতো মানিক মিয়াও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
প্রথম প্রথম মানিক মিয়া ‘৬-দফা’ পছন্দ করেননি। পরে তিনি ৬-দফার পক্ষে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ‘৬-দফা’ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুসহ সব সিনিয়র নেতাই যখন কারাবন্দি তখন ইত্তেফাক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র মানিক মিয়ার কারণেই। আজকের দিনের মতো সেদিন এত পত্র-পত্রিকা ছিল না, সেলুন থেকে পান দোকান পর্যন্ত সর্বত্রই ইত্তেফাক পত্রিকার সমাদর ছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল মানিক মিয়ার নেতৃত্বের কারণেই। ইত্তেফাকের প্রচার সংখ্যা ছিল সর্বাধিক।
অকাল প্রয়াত মানিক মিয়ার লাশ ঢাকায় এলে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমিও লাশ গ্রহণ করতে তখনকার এয়ারপোর্টে যাই। ধানমন্ডির একতলা বাসায় তার লাশ রাখা হয়। সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু সেদিন মানিক মিয়ার মরদেহ দেখতে এসেছিলেন। বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মানিক ভাইকে দেখছো’Ñ এই বলে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। বঙ্গবন্ধুকে আমি মানিক মিয়ার লাশের পাশে অঝোর ধারায় কাঁদতে দেখেছি। ফরিদা হাসানও সেদিন ভীষণ কেঁদেছিল। বঙ্গবন্ধু কাঁদছিলেন আর বারবার বলছিলেনÑ পাকিস্তানিরা মানিক ভাইকে মেরে ফেলেছে। বর্তমানে সেই বাসায় আনোয়ার হোসেন মঞ্জু থাকেন। মঈনুল হোসেন বারিধারায়।
মানিক মিয়ার কবর কিনতে হিরু ভাই (ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন) আর আমি আজিমপুর পুরানো কবরস্থানে যাই। আজিমপুর যাওয়ার সময় মানিক মিয়ার স্ত্রী তার স্বামীর পাশে তার জন্যও একটি কবর কিনে রাখতে বলেন। আমরা প্রতিটি কবর এক হাজার টাকা করে দুটি করব দুই হাজার টাকায় কিনেছিলাম। আমি মানিক মিয়ার শবযাত্রায়ও অংশ নিয়েছিলাম। সেদিনের সেই শবযাত্রায় সম্পাদকসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গকেও আমি উপস্থিত হতে দেখেছিলাম। মানিক মিয়ার মরদেহ কবরে নামাতে বঙ্গবন্ধু নিজে কবরে নেমেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুকে আমরা কয়েকজন ধরে কবর থেকে উঠাই। তাঁর পাঞ্জাবিতে অনেক মাটির দাগ লেগেছিল।
মানিক মিয়া বাংলাদেশের মূল্যবান মানিকই ছিলেন। তাঁর ভাবনা জুড়ে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন, বাঙালির মুক্তজীবনের কল্পনা। তিনি স্বাধীনতার বীজ বপণ করেছিলেন, কিন্তু যখন সেই কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা বাঙালির ঘরে এলো তখন তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। বাংলার এই সাহসী সন্তানকে তার ৪৮তম মৃত্যু দিবসে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।
২৮ মে, ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]