List

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলে পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশ ব্রিটিশ উপনিবেশের খপ্পর থেকে পাকিস্তানি উপনিবেশের খপ্পরে পড়ে। যেই মানুষটিকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দানা বেঁধে ওঠে তিনি হলেন বাঙালিশ্রেষ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের সারাজীবনের রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল স্বাধীন বাংলা ভূখ-। যেদিন থেকে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সেদিন থেকেই তার পেছনে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী অপশক্তি ছায়ার মতো লেগে থাকে। একের পর এক চক্রান্ত করতে থাকে শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ নিয়ে। ১৯৫৪ সালে ইস্কান্দার মির্জার লেখা একটি চিঠিতে আছেÑ
Sheikh Mujibur Rahman
Has been in prison several times. Is a remarkably good organizer. Has guts. Holds extreme views in politics. Is an experienced agitator. May be described as the stormy petrel of the Awami League. A dangerous gentleman who is best in jail. (মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’, দ্বিতীয় খ-, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৯৩৩।)
এই চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তৎকালীন গভর্নর গোলাম মোহাম্মদকে। এই চিঠি থেকেই বোঝা যায়, শেখ মুজিব কত বড় মাপের সংগ্রামী ও মর্যাদাবান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন পাকিস্তানিদের চোখে। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানও বলেছিলেনÑÔThis time Mujib will not go un punished.Õ
শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্য-গগনে জ্বলজ্বল করছেন তখন তার চারপাশের প্রায় সকলেই নিবু নিবু করছিল। সেই নিবু নিচু নেতাদের বুকে টেনে নিয়ে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন। সাহসী শেখ মুজিব মরতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু পালানো তার স্বভাবে ছিল না। এ প্রসঙ্গে একটি অবিস্মরণীয় স্মৃতি মনে পড়ছেÑ ন্যাপ সভাপতি আবদুল ওয়ালী খান,এমএনএ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর আমি ২০ মার্চ ১৯৭১ সালে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। আবদুল ওয়ালী খান বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি অনুমান করে বঙ্গবন্ধুকে যা বললেনÑ তা এরকমÑ পাকিস্তানিরা মনে করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তোমাকে না মেরে তারা ভুল করেছে। এবার সুযোগ পেলে তারা তোমাকে হত্যা করবেই। সুতরাং সুযোগ বুঝে পালিয়ে যেও। বঙ্গবন্ধু আবদুল ওয়ালী খানকে বলেছিলেনÑ “আমি তো পালানোর রাজনীতি করি নাÑ পালায় তো মুজাফফররা। তারপরেও কবুতরের খোপের পাশে সিঁড়ি লাগিয়ে রেখেছি।” বঙ্গবন্ধু পালায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে কখনোই রাজনীতি করেননি। তিনি সততা, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অতুলনীয় ও অসামান্য। শেখ মুজিবের শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকু ইতিহাসই রাজনীতির ইতিহাস। অথচ পঁচাত্তরের পরে যারা উড়ে এসে জুড়ে বসল বাংলার মসনদে তারা এমন ভাব দেখাতে শুরু করল যে, শেখ মুজিব কেউ নয়, তিনি কিছুই করেননি, সবকিছু করেছেন ওই উড়ে এসে জুড়ে বসা ছদ্মবেশী নেতা। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে শুধু একটি মানুষেরই মৃত্যু হয়নি, একটি দেশের স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কক্ষপথচ্যুত হয়েছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করে কিংবা হত্যায় ইন্ধন জুগিয়ে যারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছিল ও শিকড় গেড়ে বসেছিলÑ তারাই হাত মিলিয়েছিল একাত্তরের সেই পরাজিত অপশক্তির সঙ্গে। তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, বাংলাদেশ নিজের পায়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে শোষিত হোক, মৌলবাদীদের দিয়ে ভরে যাক। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রক্তাক্ত হোক বাংলার প্রান্তর। যতদিন মুজিববিরোধী তথা আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল ততদিন বাংলাদেশে সন্ত্রাস, মৌলবাদ, বোমা হামলা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক সংঘাত লেগেই ছিল। আজ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত, দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে আছে। কারোই তেমন অভাব-অভিযোগ নেই। উন্নয়নের জোয়ার এসেছে সমগ্র বাংলাদেশে। আজ পাকিস্তানিরাই বলছেনÑ পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করা। বাংলাদেশ যেভাবে আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল বাধা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেÑ তা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিচ্ছে। এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকলে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আর কয়েকদিন পরেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নির্বাচন এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হবে যে সময়টা বিএনপির জন্য হবে অগ্নিপরীক্ষাতুল্য। বিএনপি-জামায়াত ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া মানে নিশ্চিত ভরাডুবি। বিগত দিনের নির্বাচন পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে। আগামী নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে জামায়াতের ভোট বিএনপির বাক্সে গেলেও বিএনপিকে একা একাই মাঠে থাকতে হবে। অবশ্য এই মুহূর্তে একা একা মাঠে টিকে থাকার সামর্থ্য বিএনপির আছে কিনা সেই বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি যা লুটপাট করেছিল এতদিনে সেই পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। হাওয়া ভবনে এখন আর কমিশন ব্যবসা নেই, সিন্ডিকেট নেই, কোকো ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদির ব্যবসা মন্দা, ড্যান্ডি ডাইংও খারাপ অবস্থায়, দলীয় নেতাকর্মীরা সকলেই প্রায় সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে পলাতক বা দলত্যাগী। জামায়াতের কোনো কাজেও বিএনপি আসতে পারছে না যে জামায়াত তাদের অর্থ যোগান দিবে। সুতরাং দুর্নীতিবাজ আসামি অর্বাচীন তারেক জিয়ার নেতৃত্বে কোমর ভাঙ্গা দল নিয়ে বিএনপি কতটুকু লড়াই করতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা সেটাই বিবেচ্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্য ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিকল্প এখন আওয়ামী লীগই। যদি বড় কোনো দুর্যোগ না ঘটে তাহলে এ মুহূর্তে উন্নয়নে, পরিকল্পনায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগের ধারে কাছে কেউ নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পরে যে দুটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল সেগুলো ছিল কৃত্রিমভাবে প্রতিষ্ঠিত দল। ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে জেনারেল জিয়া তথাকথিত ১৯-দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিএনপি আর পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ ১৮-দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় পার্টি। বিএনপি মূলত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, ন্যাপ, সুবিধাবাদীদের নিয়ে গঠিত ওরস্যালাইন পার্টি। ক্যান্টনমেন্টের অন্ধকার কুঠুরিতে জন্ম নেয়া এই দলটি বাংলাদেশের রাজনীতি ধ্বংস করে দেয়, দেশদ্রোহীদের পুনর্বাসন করে সৃষ্টি করে পাকিস্তানি ভাবধারা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়া সরকার অবৈধ ছিল। জিয়া আইয়ুব খানের মতো হ্যাঁÑনা ভোটের আয়োজন করেছিলেন দেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অবৈধ জিয়া সরকার সারাদেশে সৃষ্টি করেন এক দুর্বিষহ আতঙ্ক। তার সীমাহীন নির্যাতনে জেলখানা ভরে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা। জিয়ার শাসনামলে প্রতি রাতে দেশে ‘মার্শাল ল’ থাকতো। জনজীবন ছিল চরম অনিরাপত্তার ভেতর। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশে যে কালো আইন তৈরি এবং মুজিব হত্যাকা-ের বৈধতা দান করে ঘাতকদের পুরস্কৃত করে।
জিয়ার পরে আসে গণতন্ত্রহত্যাকারী আরেক জেনারেল এরশাদ। এরশাদও আওয়ামী লীগের নেতৃকর্মীদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালায়। কেননা এরশাদ তো প্রকারান্তরে জিয়ারই ভাবশিষ্য। তাই আওয়ামী লীগকে নির্যাতন করতে জিয়া ও বিএনপি যা যা করেছেÑ এরশাদ আর জাতীয় পার্টিও তা-ই করেছে। বরং এরশাদের নির্যাতন কোথাও কোথাও জিয়াকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চোখ বেঁধে শেখ হাসিনাসহ ৩৩ জন নেতাকর্মীকে সেনানিবাসের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কলঙ্কিত করা হয়েছিল নির্বাচন প্রক্রিয়া। আসুন আমরা বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখিÑ ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জনগণের প্রিয় পার্টি আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন, ভোট পায় ৮৯ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি আসন, ভোট পায় ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি পায় ২০৭টি আসন, ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট আর ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে দেয়া হয় মাত্র ৩৯টি আসন এবং ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোট। এখানে লক্ষ্য করার মতো একটি ব্যাপার হলোÑ ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পূর্বেও যে আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ তার মৃত্যুর পরে তার ভোটার সংখ্যা কিভাবে ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে যায় আর হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট তা বিশ্লেষণের বিষয়ই বটে।
১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন বিএনপি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরে দাঁড়ায় এবং খালেদা জিয়া তথাকথিত আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে ঠেকাতে ৪৮ ঘন্টা মিডিয়া ক্যু করে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩টি আসন, ভোট পায় ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগ আসন পায় ৭৬টি, ভোট পায় ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। মিডিয়া ক্যু না হলে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই যেতো। ১৯৮৮ সালে আবার এরশাদের অধীনে নীল নকশার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন, ভোট পায় ৬৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ফ্রিডম পার্টি পায় ২টি আসন আর ৭২ দলীয় জোটের নেতা আ স ম আবদুর রব ১৯টি আসন পেয়ে বিরোধী দলীয় নেতা হন।
১৯৯১ সালে সর্বদলীয় রাজনৈতিক পার্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বিএনপি পায় ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ জোট পায় ১০০টি আসন এবং জাতীয় পার্টি পায় ৩৫টি আসন। এই নির্বাচনের ভোটের সংখ্যা বিশ্লে¬ষণ করে দেখা যায় বিএনপির বাক্সে পড়ে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৩ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি পায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভাট। জামায়াত পায় ১৮টি আসন। জামায়াত-বিএনপির আসন ভাগাভাগির ফলে বিএনপি ১৯৯১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার এসে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অধীনে আয়োজন করে ষড়যন্ত্রের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন, ফ্রিডম পার্টি পায় ২টি এবং স্বতন্ত্র পার্টি পায় ১০টি আসন। কিন্তু খালেদা জিয়া গণ-আন্দোলনের মুখে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। প্রচ- গণ-আন্দোলন ও জনতার মঞ্চ গঠন করার ফলে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। যদিও তিনি বলেছিলেনÑ ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নির্দলীয় নয়’।
এই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন এবং ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে একুশ বছর পরে অর্থাৎ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন এবং ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি আসন এবং ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এই নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমসংখ্যক ভোট পেলেও আসন সংখ্যায় বিএনপি এগিয়ে থাকে। এবারও জামায়াতকে সাথে নিয়ে জামায়াতের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোট নিয়ে এবং ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার নানামুখী ষড়যন্ত্র করে, রাজাকারদের মন্ত্রী বানায়, বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এবং দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। বিএনপির রক্তলোলুপ চক্রান্তে শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাও ১৯ বার মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বেঁচে যায়। এর মধ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা সবচেয়ে নির্মম আর মর্মান্তিক।
বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে যেমন ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি তেমনি ২০০১ সালে ক্ষমতা পেয়েও তারা মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহনা শুরু করে। এরপর আবির্ভূত হয় কিছু উচ্চাভিলাশী সামরিক ও বেসামরিক নেতার নেতৃত্বে আর্মি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারাও দুই বছর গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রাখে। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে তারাও বাধ্য হয় ২০০৮ সালে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে এবং মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করে। দেশে এখন সেই ধারাই অব্যাহত আছে। উপরের বিশ্লে¬ষণ থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে যে, যখনই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে তখনই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এ ধারা ১৯৭০ থেকে শুরু হয়ে ২০১৪ পর্যন্ত বিদ্যমান, ২০১৮ সালেও তার ব্যত্যয় হবে না।
বাংলার মানুষ আজ ক্যান্টনমেন্ট নির্ভর ক্ষমতাবানদের চায় না। তারা ‘গণভবন’ আর ‘বঙ্গভবন’ নির্ভর ক্ষমতা দেখতে চায়। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ উভয়েই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। উভয়েই নানাপ্রকার চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। আজ এদের পক্ষে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা, গণতন্ত্রের বিপক্ষেই কথা বলা। দেশে অনেক জঞ্জাল জমেছে। সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়া দরকার। আশাকরি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ সে সুযোগ আওয়ামী লীগকে দেবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের নৌকা থেকে ফেলে দিতে হবে। দেশের মানুষ উন্নত ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায়। হাওয়া ভবন বা খোয়াব ভবন দেখতে চায় না। শেখ হাসিনার মতো এমন ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব দেশবাসী বিগত ৪৫ বছরে দেখেনি। তিনি চলনে-বলনে-আহ্বানে দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক কৌশলে দূরদর্শী এবং সিদ্ধান্তে দৃঢ়চেতা এক ব্যক্তিত্ব।
আজকাল জোট ও ভোট নিয়ে চারদেিক নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। যার এক শতাংশ ভোট নেই, যিনি নির্বাচনে প্রার্থী হলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, তিনিও এখন নিজেকে বড় নেতা বলে প্রচার করার চেষ্টা করছেন। নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট করে লাভ নেই, তাদের এককভাবে নির্বাচন করতে দেওয়া হোক। তারা জয়ী হলে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির সঙ্গে তাদের জোট হবে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও ন্যাপ (মোজাফফর) ৪০টি আসন নিয়ে দরকষাকষি করেছিল। বঙ্গবন্ধু ২০টি আসন দিতে চেয়েছিলেন। পরে ন্যাপের ভরাডুবি আমরা লক্ষ্য করেছি। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জোটের মধ্যে ভাঙনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত কোন জোটের কি অবস্থা হবে তা বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের কতিপয় সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও বামনেতা আজ পত্র-পত্রিকায়, টকশোতে বলার চেষ্টা করছেন দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেইÑ একথা সত্য নয়। দেশে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা না থাকলে তারা এত কথা বলেন কিভাবে? ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারা কোথায় ছিলেন? ওয়ান ইলেভেনের সময়ও তারা নিশ্চুপ ছিলেন কেন? খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়াÑ উভয়েই দুর্নীতির কারণে দ-প্রাপ্ত। বর্তমানে অনেক দেশেই দুর্নীতির কারণে নেতা-নেত্রীরা জেল খাটছেন। খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক জিয়া রাজবন্দী হলে তাদের পক্ষে কথা বলা যেতোÑ তারা যেহেতু দুর্নীতির কারণে দ-িত তাদের পক্ষে কথা বলা কি প্রকারান্তরে দুর্নীতির পক্ষেই কথা বলা নয়? এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও দিকভ্রান্ত বাম-নেতাদের অতীত অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ এখন আর এদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সুচিন্তিত ও সুদৃঢ় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন এ কথা সর্বাংশে সত্য। তবু কিছু কিছু মানুষ ভুল পথে আছে, তারা এখনো বিশ্বাস করে পাকিস্তানি ভাবধারায়। এই ভুল পথে চলা মানুষগুলোকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আজ আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর অঙ্গীকার হোকÑ অবাধ, সুষ্ঠু, সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতারোহণ। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সৎ, দুর্নীতি মুক্ত, সদালাপী, সদাচারী ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। দলের এমন লোককে মনোনয়ন দিতে হবে যার ব্যক্তি ইমেজ অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সম্মানীয়। এমন কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া যাবে নাÑ যার অতীত কিংবা বর্তমান কালিমালিপ্ত ও দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষায় বিঘœসৃষ্টিকারী। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগ। সবার পক্ষে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার জন্য কোনো কিছুই আজ অসম্ভব নয়। তিনিই পারবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়তে। সুতরাং নিজেকে প্রশ্ন করুন, কোন্ পক্ষে যাবেন? যদি স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চান, তাহলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করুন। সম্মিলিত কণ্ঠে স্লোগান তুলুনÑ ‘জয় বাংলা’।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০৭ অক্টোবর, ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]