List

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

মোনায়েম সরকার
সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় কথাটি সর্বাংশে ঠিক নয়। অবশ্যই রাজনীতিতে শেষ কথা আছে। সবকিছুর শেষ থাকলে রাজনীতির কেন শেষ থাকবে না? রাজনীতি কি তাহলে এমন কোনো অসীম প্রতিষ্ঠান যার শেষ থাকা সম্ভব নয়? আমার মনে হয় উপরিউক্ত প্রশ্নগুলো নতুন দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করা দরকার।
ষাটের দশকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রÑ তখন পৃথিবীকে যেভাবে দেখেছি, আজকের পৃথিবী কিন্তু তেমনটি নেই। তখন মনে হয়েছিল সারা দুনিয়ায় সমাজতন্ত্র কায়েম হতে চলেছে। সাম্যবাদী পৃথিবী নির্মাণের জন্য সেদিন অনেকের মতো আমিও যোগ দিয়েছিলাম সমাজতন্ত্রের পতাকা তলে। এক সময় আমাদের মোহভঙ্গ হয়। পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দোর্দ- প্রতাপে পুঁজিবাদ চেপে বসে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ঘাড়ে।
মুখ থুবড়ে পড়ে মার্ক-এঙ্গেলস-লেনিনের তত্ত্ব। পুঁজিবাদ-সা¤্রাজ্যবাদের চাপে বিপরীত মুখে যাত্রা শুরু করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো। এর ফলে বিশ্ব আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে ¯œায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা। শান্তি আন্দোলন স্তমিত হয়ে পড়ে। দেশে দেশে বেড়ে যায় স্বার্থবাদী মানুষের সংখ্যা। অঢেল সম্পদের লোভে উন্মত্ত হয়ে ওঠে দিশেহারা মানুষ। দেশে দেশে শুরু হয় স্বৈরাচারী সামরিক শাসন। ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে যায়। প্রত্যাশিত মানবিক বিশ্ব রূপান্তরিত হয় অমানবিক দানবে। মানুষ হিসেবে মানুষের কল্যাণ চিন্তাই আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হওয়া দরকার। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত অশুভকে ডেকে আনছি। সভ্যতা ধ্বংস করে ডেকে আনছি অসভ্যতা। সমৃদ্ধ দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে পরিণত করছি ধ্বংসস্তূপে। একবিংশ শতাব্দীর এমন মুহূর্তে যেই দৃশ্য কল্পনা করা অসম্ভবÑ সেই দৃশ্যগুলোই এখন মঞ্চস্থ হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে যে গণ-রায় দিয়েছেÑ তা ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করেছে। এই গণরায়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকার তথা আওয়ামী লীগের উপর গুরু দায়িত্ব এসে পড়েছে। সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা এবং সকল দলের মতামতের ভিত্তিতে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন কাজটি শেখ হাসিনা সরকারকে অবশ্যই দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ অবহেলা ভবিষ্যতে কি ফল বয়ে আনবে তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও কেবল এটুকু বলা যায় যে, মানুষ আওয়ামী লীগের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। ভারতবর্ষে কংগ্রেসের স্থান দখল করেছে সাম্প্রদায়িক বিজেপি।
বাংলাদেশের সামনে আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সহাবস্থান সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছে যা এতদিন বাংলাদেশের মানুষ মনে-প্রাণে প্রত্যাশা করেছিল। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলোর প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি তাদের ওপর অর্পিত ও সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন এমনটাই প্রত্যাশা করে এদেশের আপামর জনগণ। বাংলাদেশের মানুষ এখন নতুন স্বপ্নে বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এদেশ থেকে দুর্নীতি দূর হবে, অফিস-আদালতে ঘুষ-বকশিস বন্ধ হবেÑ এমনটাই সবার আন্তরিক প্রত্যাশা। সরকার একটু জনবান্ধব হলেই ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করে জনসেবায় মনোযোগ দিতে পারেন। এমপি-মন্ত্রীদের বানাতে পারেন জনগণের সেবক। আমি মনে করি বর্তমান সরকার অবশ্যই জনবান্ধব নিয়ম-নীতি গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান নিবেন এবং মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করবেন।
বাংলাদেশ প্রকৃত পক্ষেই একটি গরিব দেশ। এদেশের গ্রামীণ মানুষগুলো এখনও দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছেন। সরকার এবারের ইশতেহারে ‘গ্রাম হবে শহর’ স্লোগান দিয়ে মানুষের প্রত্যাশাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করার সরকারি সদিচ্ছাকে আমরা অবশ্যই স্বগত জানাই, তবে গ্রামকে শহর বানানোর নামে এম.পি-মন্ত্রী ও দলীয় লোকজনের পকেট যেন অসম্ভব রকম ফুলে-ফেঁপে না ওঠে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কেউ যেন ব্যক্তিগত অপরাধ ক্ষমতাসীন দলের উপর চাপানোর সুযোগ না পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশে প্রতিদিনই ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু কারা ধনী হচ্ছে এ বিষয়ে নজর রাখা দরকার। একটি কথা আছেÑ ‘পাওয়ার ইজ মানি’Ñ যারা ক্ষমতায় এবং উচ্চপদে আসীন তারা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশে ধনী হতে পারছেন না। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য প্রতিদিনই ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিচ্ছেন চিহ্নিত ও ছদ্মবেশী সুবিধাবাদীরা। এসব সুবিধাবাদী মুনাফালোভীদের হাতে কিছুতেই ক্ষমতার ভার অর্পণ করা সমীচীন হবে না। কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সরকারের শরীরে কলঙ্ক লেপন করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পদত্যাগ কিংবা অনুরূপ কোনো গুরু শাস্তির দ- দিতে হবে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল কথাই হলো সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, দেশে আইনের শাসন না থাকলে, সেদেশ কোনোদিনই উন্নতির শিখরে উঠতে পারবে না।
বাংলাদেশের মতো হতদরিদ্র দেশে এম.পি-মন্ত্রীরা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। তারা উচ্চমূল্যের শুল্কমুক্ত গাড়ি, প্লট, আবাসন সুবিধাসহ এমন চোখ ধাঁধানো জীবনযাপন করেন যে, যা কেবল ইউরোপের মতো উন্নত দেশেই সচরাচর দেখা যায়। একজন মানুষের বিলাসিতার জন্য ৪ কোটি, ৫ কোটি টাকার গাড়ি কেন কিনতে হবে তা আমি ভেবে পাই না। আজকাল যারা এম.পি-মন্ত্রী হন, তারা কেউই গরিব ঘরের সন্তান নন। জনপ্রতিনিধিদের কাছে মানুষ সেবা প্রত্যাশা করে, শোষণ নয়। বাংলাদেশের এম.পি-মন্ত্রীগণ নিজ নিজ এলাকাকে যেন কিছুতেই শোষণ ক্ষেত্র মনে না করেন এ ব্যাপারে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। সরকার আইন করে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানী বন্ধ করতে পারেন।
একটি দেশের নব্বই শতাংশ মানুষকে গরিব রেখে দশ শতাংশ মানুষের বিলাসী জীবন-যাপন শুধু হাস্যকর নয়Ñ একে প্রহসন বলেই মনে হয়। এবার যারা মাননীয় সংসদ সদস্য হয়েছেন তাদের উদ্দেশে লেলিনের এই কথাটি বলতে চাইÑ ‘মানুষ পৃথিবীতে মাত্র একবারই আসেন। তাই তাকে এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যেন মৃত্যুকালে সে বলতে পারেÑ আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছি মানবজাতির কল্যাণের জন্য।’ আসলেই তাইÑ এমনভাবে আমাদের জীবনযাপন করা উচিত যেন আমরা মৃত্যুর সময় বলতে পারি আমাদের জন্ম বৃথা যায়নি। একটি মানুষ ইচ্ছে করলেই এমন একটি দৃষ্টান্তযোগ্য জীবনের অধিকারী হতে পারেন, এখন তিনি মহৎ জীবনের অধিকারী হতে চান কিনা সেটাই প্রশ্ন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার’ ছিলেন। আমি মনে করি শেখ হাসিনার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর এই গুণটি আছে। আজ সকল দলের, সকল মতের মানুষ শেখ হাসিনার কাছে ভালোবাসা ও আশ্রয়প্রার্থী। শেখ হাসিনাও তাদের আগলে রাখছেন পরমমমতায়। অন্যান্য দলের যারা আজ শেখ হাসিনার সঙ্গে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করছেন (পত্র-পত্রিকার ছবি দেখে অনুমান করছি) তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইÑ আপনারা জীবনভর অনেক উল্টাসিধা, সুবিধাবাদী রাজনীতি করেছেন, বারবার নীতি-আদর্শ পরিবর্তন করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে এখন আর রূপ বদলাবেন না। নীতি-আদর্শ মেনে রাজনীতি করুন এবং দেশ গড়–ন। টলস্টয় বলেছেনÑ ‘একজন মানুষের সাড়ে তিন হাত জমি প্রয়োজন’Ñ আমিও বলতে চাইÑ অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতার লোভ পরিহার করে, অতীত অভিমান ভুলে গিয়ে সকলে মিলে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়–ন, রাজনীতি দুর্নীতি মুক্ত হলে দেশ থেকে সকল অনিয়ম এমনিতেই নির্বাসনে যাবে।
০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 12
May 19th, 2019

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু : জুলিও ক্যুরি শান্তি পদকের প্রাসঙ্গিকতা মোনায়েম সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ […]

April 30th, 2019

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক মোনায়েম সরকার পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল […]

April 12th, 2019

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন

১৭ এপ্রিল : সাহসী শপথের দিন মোনায়েম সরকার আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। ১৯৭১ […]

March 24th, 2019

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে

ক্ষমতা নয়, কর্মই মানুষকে মহিয়ান করে মোনায়েম সরকার আধুনিক মানব সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন সভ্যতাও এগোতে […]

March 12th, 2019

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য

জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমা ও ঔদার্য মোনায়েম সরকার যুগ যুগ বাংলাদেশ পরাধীন ছিল। এই পরাধীন বাংলাকে যে মানুষ তার […]

March 2nd, 2019

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি

শেখ হাসিনার বিকল্প ভাবার সময় এখনও আসেনি মোনায়েম সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। ওই […]

February 22nd, 2019

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটনা ও দুর্ঘটনা মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদিনই ঘটছে নাটকীয় ঘটনা, এসব ঘটনা এখন এতই দ্রুত ঘটছে যে, […]

February 12th, 2019

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক

রাজনীতি দুর্নীতিমুক্ত হোক মোনায়েম সরকার সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ Ñ আমার মনে হয় […]

January 13th, 2019

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে

বাংলা কবে জাতিসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা হবে মোনায়েম সরকার বাংলা ভাষা বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মাতৃভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষাকে […]

January 9th, 2019

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন মোনায়েম সরকার লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে […]