মোনায়েম সরকারঃ জীবন ও কর্ম
মোনায়েম সরকার একজন স্থির, বিচক্ষণ, নিলোভ এবং সৎ রাজনীতিকের প্রতিভূ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতির সকল বাঁক ১৯৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৯, ’৭০, ’৭১ থেকে আজ পর্যন্ত সর্বস্থানে তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি ছিল। কৈশোরের ৫২ সালে গ্রামের বাড়িতে ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের যে সূচনা, তা আজকের বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নময় সোনার বাংলাদেশের মাটিতে অনেক শক্তভাবে প্রোথিত। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে আজন্ম অকৃতদার এই মানুষটির অবদান ছিল নিঃশঙ্ক। জীবনে চলার পথে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা, সংগ্রামী দক্ষতা, সততা ও দৃঢ়তাই তাঁর প্রগতিশীল ভাবনার একমাত্র অবলম্বন। জীবনে কোনো কিছু চাওয়ার নেই, পাওয়ার নেই- তবু গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত এই মানুষটি আজও বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা, তাঁর আর্দশই জীবনের শেষ পাথেয় এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কর্মে অটল থাকবেন বলে তাঁর স্থির বিশ্বাস। যদিও ২০০১ সাল থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা ক্ষোভ, দুঃখ এবং রাজনীতির মিথ্যাচারিতায় দূরে সরে আছেন। কারণ তাঁর মতে বর্তমান রাজনীতিতে ক্ষমতার দুবৃêত্তায়ন এবং দক্ষতার অসম্মান প্রবলভাবে উচ্চকিত। বর্তমান রাজনীতির পরতে পরতে অসততা এবং লোভ, ত্যাগী রাজনীতিকদেরকে প্রতিনিয়ত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। অসম্মানিক নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছেন একসময়ের পরীক্ষিত দক্ষ রাজনীতিবদগণ। তাঁর চরম শিকার মোনায়েম সরকারও। ফলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটাই নির্বাসনে মোনায়েম সরকার। আজকের সময়ে নীরব কণ্ঠে সরব উপস্থিতি বর্তমানে তাঁর গবেষণা-কর্মে বেশি উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের একজন দক্ষ বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর সু-লেখনী সর্বমহলে প্রশংসিত। রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সাংস্ড়্গৃতিক আন্দোলনের এই অগ্রপথিকের দীর্ঘায়ু কামনা করি আমরা। আমরাও বিশ্বাস করি, তিনি তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালি-বাংলা-বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকবেন।
১৯৪৫ মোনায়েম সরকারের জন্ম ৩০ মার্চ (১৯৪৫) ফতেহাবাদ, দেবীদ্বার, কুমিল্লা। পিতাঃ আলহাজ্ব আলিমুদ্দিন সরকার। মাতাঃ ফাতেমা বেগম। বড়ভাইঃ বিচারপতি আবদুল বারী সরকার। মেজভাইঃ আবদুল মান্নান। সেজভাইঃ আবদুল খালেক সরকার। বোনঃ রাজিয়া সুলতানা। ন ভাইঃ ড· আবদুল মালেক এবং সর্বকনিষ্ঠঃ মোনায়েম সরকার
১৯৪৭ দেবীদ্বারে পৈত্রিকবাড়ির কাচারি ঘরে মৌলভি সাহেবের কাছে কোরআন শিক্ষার মধ্য দিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ।
১৯৫২ কুমিল্লা দেবীদ্বার ফতেহাবাদ গ্রামে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে, সেজভাই আবদুল খালেক সরকারের নেতৃত্বে রাজপথের আন্দোলনে অংশগ্রহণ। এই ভাষামিছিলে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মের প্রাথমিক হাতেখড়ি।
১৯৫৪ সেজভাই আবদুল খালেক সরকারের নেতৃত্বে দেবীদ্বারে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী মিছিলে অংশগ্রহণ। ন্যাপ এবং মোজাফফর আহমদ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা। রাষ্ট্র, মানুষ এবং মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
১৯৫৬ গ্রামের বাড়ি দেবীদ্বারের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কুমিল্লা শহরে আগমন। ক্লাস সেভেনে কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্ড়্গুলে ভর্তি।
কুমিল্লায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং এমএলএ আশুতোষ সিংহের সাথে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক এবং মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় ঘটে কিশোর মোনায়েম সরকারের। পরবর্তী রাজনৈতিক দীক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি ও সাংস্ড়্গৃতিক বিকাশে এ দুজনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। পাঠাভ্যাস থাকার কারণে কুমিল্লা টাউন হল লাইব্রেরি এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে প্রগতিশীল পাঠচর্চায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
১৯৫৭ ঢাকায় কলম্বো প্ল্যানের অধীনে একমাত্র ভালো স্ড়্গুল তেজগাঁও টেকনিক্যাল হাইস্ড়্গুল। পারিবারিক ইচ্ছায় এই স্ড়্গুলে ভর্তি হতে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ‘মাইগ্রেট’ করেন মোনায়েম সরকার। এবং তেজগাঁও টেকনিক্যাল হাই স্ড়্গুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হন। মেজভাই-এর বাসা ৭৮ কাকরাইলের অধিবাসী হিসেবে অবস্থান। এই বাসায় থাকাকালীন প্রথম পরিচয় ঘটে ন্যাপনেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সাথে। ক্রমান্বয়ে পরিচয় ঘটতে থাকে- কমরেড মণি সিং, অনিল মুখার্জ্জি, খোকা রায়, আবদুস সালাম (বারীন দত্ত) ও জ্ঞান চক্রবর্তীসহ ত্যাগী কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে। তাঁরা তখন প্রত্যেকেই পাকিস্তানি সরকারের শ্যেনদৃষ্টির আড়ালে আত্মগোপনরত অবস্থায়। কিশোর মোনায়েম অল্পকিছু দিনের মধ্যেই জড়িয়ে পড়েন প্রগতিশীল মতাদর্শের সাথে। এ সময় অধ্যয়নের জন্যে ঢাকায় ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিসের লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন।
প্রতিষ্ঠা করেন ‘আকাশপাড়ি খেলাঘর’ নামে শিশুকিশোর সংগঠন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন- জামিলা আক্তার শোভা, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন- মোনায়েম সরকার। এই প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়াল পত্রিকা, হাতে লেখা ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হত। এই দেয়াল পত্রিকার অঙ্গসজ্জায় ছিলেন- আনোয়ার হোসেন (অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর ডিজাইন, বাংলাদেশ টেলিভিশন) এবং আতাউর রহমান বাবু। এই সংগঠন থেকে বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট, মুদ্রা, নকশীকাঁথার কাজ, হাতে বানানো কাপড়ের তৈরি হাতপাখা যেখানে লেখা থাকতো বাঙালির সর্বজনীন প্রবচন তেমনি হাতপাখা সংগ্রহ করে প্রদর্শনী করা হয়েছিল, বর্ধমান হাউজের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) নিচতলায়। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন।
১৯৫৮ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করল, সামরিক শাসন জারি হল পূর্ব পাকিস্তানে। এর প্রতিবাদে ১৯৫৮ সালে সারাদেশে ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হলো। ছাত্রনেতৃবৃন্দগণ বলে গেলেন ক্লাস হবে না। মোনায়েম সরকার তখন স্ড়্গুল ক্যাপ্টেন। প্রধান শিক্ষক ধর্মঘটে যাতে ছাত্ররা অংশগ্রহণ না করে, তাঁর জন্য সাহায্য চাইলেন ক্লাস নাইনের ছাত্র মোনায়েম সরকারের কাছে। কিন্তু মোনায়েম সরকার ততক্ষণে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তিনি ক্লাসে গিয়ে ধর্মঘট বন্ধ না করে উল্টো ছাত্রদেরকে মিছিলে যোগদানের জন্যে গোপনে আহ্বান জানালেন। এই প্রথম মোনায়েম সরকার একক সিদ্ধান্তে এবং রাজনৈতিক ইচ্ছায়, সমগ্র স্ড়্গুলের ছাত্রদেরকে নিয়ে অংশগ্রহণ করলেন রাজপথের মিছিলে- পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। মূলত তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সৃষ্টিলগ্ন ছিল এই মিছিলের নেতৃত্ব দেয়া।
তেজগাঁও টেকনিক্যাল হাইস্ড়্গুলে থাকাকালীন মোনায়েম সরকারের রাজনৈতিক সংকল্পের সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটে। রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততার দৃঢ়তা মোনায়েম সরকারকে আরও উদ্দীপ্ত করে তোলে। এ সময়ে ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’, ‘যে গল্পের শেষ নেই’, ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ এবং কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘শিখা’ নিয়মিত পাঠ শুরু করেন।
১৯৫৯ বন্ধু এবং বন্ধুর বড়বোনের অসুস্থতার কারণে, তাদের সেবাশুশ্রূষার জন্যে মাঝে মাঝে লেখাপড়ার বিঘ্ন ঘটিয়ে বন্ধুর বাসায় রাত্রি যাপন, চা’র বদলে দুধ খাওয়ার অন্যায় আবদার এবং প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে নিয়মিত পাঠ গ্রহণ করা হচ্ছে না, এমনিতর পারিবারিক নানা অভিযোগের কারণে মেজভাইয়ের হাতে রাম-চড় খেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত। ইঁদুর মারার ওষুধ র্যাটম খাওয়ার পর মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি। ফলাফল, সে যাত্রায় আত্মহত্যা করা আর হলো না। একটি নিষ্ফল আত্মহত্যা এবং র্যাটম সংক্রান্ত জটিলতায় অবশেষে প্রবেশিকা পরীক্ষা স্থগিত।
ব্যর্থ আত্মহত্যার কারণে মানসিক এবং শারীরিক অবসাদ কাটানোর লক্ষ্যে, হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম হয়ে দ্বীপজেলা সন্দ্বীপ যাত্রা। সাগর পরিবেষ্টিত নতুন এই গ্রামীণ শহরে মুন্সেফ হিসেবে কর্মরত বড়ভাইয়ের আবাসে কিছুদিন যাপন।
১৯৬০ মানসিক অবসাদ কাটিয়ে অবশেষে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। ভালো ফলাফল। এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি। কিন্তু ক্যাডেট কলেজের অতিরিক্ত নিয়মতান্ত্রিকতা পছন্দ না হওয়ায় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজকে চিরবিদায়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি, ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়ন শুরু।
১৯৬২ সমগ্র দেশে শিক্ষা আন্দোলন চলছে। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকতর হচ্ছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা রাজপথে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনি একটি সময়ে কুমিল্লায় প্রথম রাজনৈতিক প্রতিরোধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন মোনায়েম সরকার। পাকিস্তান জাতীয় সংসদের স্পিকার, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ফজলুল কাদের চৌধুরীর কুমিল্লা টাউন হলে আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে কুমিল্লায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- আখলাকুর রহমান, গিয়াস কামাল চৌধুরী ও মোনায়েম সরকার। এই আন্দোলনে আখলাকুর রহমানসহ ১৭জন ছাত্র গ্রেফতার হন। ‘আইয়ুব শাহী আইয়ুব শাহী, ধ্বংস হোক নিপাত যাক’- এমন স্লোগানের মধ্য দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট থেকেই মোনায়েম সরকার রাজপথের সক্রিয় আন্দোলনে আরও সক্রিয় হন।
১৯৬৩ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় যথারীতি ভালো ফলাফল। পুনরায় ঢাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে জৈব রসায়নে ভর্তি। পরবর্তীতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে পদার্থবিদ্যা, ভূ-তত্ত্ববিদ্যা এবং অঙ্ক সমন্বিত পাস কোর্স, জিওফিজিক্সে ভর্তির লক্ষ্যে মানসিক প্রস্তুতি। শেষ পর্যন্ত জিওফিজিক্স বিভাগ খোলা হয়নি- তাই ভর্তি হলেন নতুন বিভাগ ফলিত পদার্থবিদ্যায়।
কাকরাইলে (বর্তমানে মুসাফির ভবন) ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বাড়ি। এই বাসাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি থেকে এসে মাঝে মাঝে আস্তানা গাড়তেন। মানিক মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং মওলানা ভাসানীর ছেলে আবু নাসের খান ছিলেন মোনায়েম সরকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বন্ধুত্বের সুবাদে মানিক মিয়া এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল মোনায়েম সরকারের।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আবু নাসের খান এবং মোনায়েম সরকার ছিলেন হরিহর আত্মা। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্ড়্গৃতিক আড্ডায় তাদের পরিপক্ব আলোচনা ছিল তুঙ্গে। এই আলোচনার স্থান হিসেবে কিছু সময় ব্যয় হতো গুলিস্তান সিনেমা হলের ওপর ছিল নাজ সিনেমা হল, তাঁর ওপরে চু চিং চে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। চায়নিজ খাওয়ার অর্থ যোগানের দায়িত্ব বেশিরভাগ ছিল মোনায়েম সরকারের। তবে একবার দুরন্ত আবু নাসের খান কৈশোরিক উচ্ছ্বাসে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পকেট থেকে না বলে টাকা এনে চাইনিজ খাইয়েছেন মোনায়েম সরকার এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে, গুলিস্তান সিনেমা হলের ওপরের তলায় চু চিং চে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের বিস্ময়কর প্রবেশদ্বার। এখানে ভর্তি হয়ে মোনায়েম সরকার তাঁর চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে লাগলেন। রাজনৈতিক কর্মে সম্পৃক্ত এমন বন্ধুদের সাথে পরিচিত হতে লাগলেন। অংশগ্রহণ করতে লাগলেন সাংস্ড়্গৃতিক রাজনৈতিক পরিক্রমার সাথে ব্যাপকভাবে। এমনি একটি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিবেশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর সফলতার লক্ষ্যে সম্পৃক্ত হন ‘ছাত্র ইউনিয়নে’র সাথে। ছাত্ররাজনীতির এই প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত হয়ে মোনায়েম সরকার তাঁর কর্মের পরিধির বিস্তার ঘটাতে থাকেন সুস্পষ্টভাবে।
১৯৬৪ ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি তাঁবেদার গর্ভনর মোনায়েম খানের হাত থেকে ছাত্ররা ডিগ্রির সনদপত্র নিতে অস্বীকার করে। মিছিলের পর মিছিল শুরু হয়ে যায়। উত্তপ্ত হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। এ উপলক্ষে গভর্নরের আগমনে সম্মিলিতভাবে বাধা দেয় ছাত্ররা। এই বাধাপ্রদানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন মোনায়েম সরকার। পুলিশের বাধার মুখে ছাত্ররা পিছু হটে ঢাকা হলে (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) আশ্রয় নেয়, সেখানেও শুরু হয় মিছিল। মোনায়েম সরকার তখন ঢাকা হলের ছাত্র ছিলেন।
‘ছাত্র পর্যটন সংস্থা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন মোনায়েম সরকার এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময়ে উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে বরিশালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন। বিধ্বস্ত কুয়াকাটায় একটি গাছের সাথে মানুষের লাশ ঝুলতে দেখা যায় পত্রিকায়। মোনায়েম সরকার এই ছাত্র পর্যটন সংস্থা থেকে বিভিন্ন স্ড়্গুলে আবেদন জানান ঘূর্ণিঝড় কবলিত অঞ্চলের মানুষের জন্যে যার যা আছে তা নিয়ে সাহায্য করবার। মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ২ মণী বস্তার ১৫০টি বস্তা সংগৃহীত হয় বিভিন্ন কাপড় আর নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দ্বারা। একটি লঞ্চ ভাড়া করে বন্যা কবলিত বরিশালে তখন ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছিল এই ছাত্র পর্যটন সংস্থা থেকে।
এই সংস্থা থেকে ২০ মাইল দীর্ঘ এক সাইকেল প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল তৎকালীন ঢাকায়। সেসময় এই আয়োজন ছিল ঢাকাবাসীর জন্যে একটি নতুন উদ্দীপনা, চমকপ্রদ ঘটনা। সম্্ভবত এই ধরনের আয়োজন ঢাকায় সেই প্রথম।
‘পূর্ব পাকিস্তান বাংলা প্রচলন সমিতি’ তৈরি করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন- ড· মাহফুজুল হক, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন- ফকির আশরাফ। পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন- মোনায়েম সরকার। কোষাধ্যক্ষ ছিলেন- ড· সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এই সমিতি থেকে প্রচারিত পোস্টারের ভাষা ছিল- ‘বাংলা বলুন, বাংলা লিখুন- অন্যকেও বাংলা বলতে সাহায্য করুন।’ ‘অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার পূর্ণমর্যাদা দিন।’ ‘শহীদের রক্তদান সার্থক করে তুলুন।’ এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘মাতৃভাষা’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় গর্ভনর মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে নরসিংদী থেকে ১০,০০০ লোকসহ ভুখা মিছিল নিয়ে ঢাকায় আসার দায়িত্ব পালন করেন মোনায়েম সরকার। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হন তিনি। কিন্তু মোনায়েম সরকার ছিলেন তাঁর কর্তব্যে অবিচল, অপ্রতিরোধ্য।
১৯৬৫ পাবলিক লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান বাংলা প্রচলন সমিতি আয়োজন করে ‘বাংলা বইমেলা’। এটিই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বাংলা বইয়ের প্রথম ‘বইমেলা’। এই বইমেলার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মোনায়েম সরকার। মেলার সহযোগী হিসেবে আরও ছিলেন- বাংলা বিভাগের- মালেকা বেগম, রেহানা হক রাণু, সেলিমা আফরোজ এবং বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ আবদুল হাই-এর কন্যা রীনা।
১৯৬৬ জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রবল উপস্থিতির কারণে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে’র সাথে নিজেকে আরও জড়িয়ে ফেলেন মোনায়েম সরকার।
আইয়ুবী দুঃশাসনে পূর্ব পাকিস্তানে তখন ত্রাহি অবস্থা। চারদিকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল জনরোষ। আন্দোলন সংগ্রামে মুখরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৭ জুন আইয়ুববিরোধী হরতাল-আন্দোলনে কার্জন হলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ ছিল ভয়ঙ্কর। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে মোনায়েম সরকারের হাতের শিরা দ্বিখণ্ডিত হয়। এই ক্ষতচিহ্ন আজও তাঁর বাঁ হাতের কব্জিতে দৃশ্যমান। এই আন্দোলনে শহিদ হয়েছিলেন মনু মিয়াসহ আরও অনেকে। ছাত্র আন্দোলনের এই ব্যাপকতার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ শুরু হয়ে যায় মোনায়েম সরকারের।
মোনায়েম সরকার-এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং শেখ জামাল-এর, ৩২ নম্বর রোডে জনাব আইনুল হক ও জামিলা আখতার (শোভা আপার)-এর বাড়িতে। শোভা আপার স্নেহধন্য ঢাকা হলের ছাত্র মোনায়েম সরকার এই বাড়িতে ঢাকায় সদ্য চালু হওয়া টিভি অনুষ্ঠান এবং বাড়তি হিসেবে ভালো খাবারের লোভে প্রায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। একদিন অনুষ্ঠান দেখে একসাথে শোভা আপার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর খাদি পাঞ্জাবি পরিহিত মোনায়েম সরকারকে শেখ রেহানার প্রশ্ন- ‘আপনি কী রাজনীতি করেন।’ মোনায়েম সরকারের সম্মতি। শেখ রেহানার পরবর্তী কথা- ‘দেখে মনে হয় ছাত্রলীগ করেন না। শোনেন ওসব ছেড়ে দেন, ছাত্রলীগ করেন, ছাত্রলীগ করেন।’ পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা এবং ড· ওয়াজেদ মিয়া শোভা আপার বাড়ির ভাড়া-বাসিন্দা হন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত।
১৯৬৭ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে এম·এসসি· ডিগ্রি অর্জন। পারিবারিক ইচ্ছা এবং ড· আবদুল মতিন চৌধুরীর আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। কিন্তু তিনি সে পথে না গিয়ে পার্টির তাগিদে হয়ে গেলেন ন্যাপের ফুলটাইমার রাজনৈতিক নিবেদিত সংসারত্যাগী কর্মী।
১৯৬৮ ন্যাপ সম্মেলনে প্রথম প্লেনে করে লাহোর হয়ে পেশোয়ার যাত্রা। সেই সম্মেলনে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের ছেলে খান আবদুল ওয়ালী খান সভাপতি, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী সাধারণ সম্পাদক এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ নেতা দেওয়ান মাহবুব আলী এবং কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। পেশোয়ার থেকে সম্মেলন শেষে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুসারে তরুণ এবং উদ্যোগীকর্মী হিসেবে মোনায়েম সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রবীণ নেতৃবৃন্দদেরকে নিয়ে করাচি থেকে নৌপথে ৭ দিন ৭ রাত সাগর পাড়ি দিয়ে অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরে অবতরণ। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে ১০০জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন। মোনায়েম সরকার ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে বাঙালির আন্দোলনকে প্রতিহত করার লক্ষে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ সময় ছিল বেপরোয়া, হিংস্র, উন্মাদ। বাঙালিদের ওপর নির্যাতন কঠোর থেকে কঠোরতর হতে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ আন্ডারগ্রাউন্ডে। বাম-রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যতায় কমিউনিস্ট আন্দোলন স্তিমিত। এ সময় ২৩ চামেলীবাগে কবি জসীমউদ্দীনকে সভাপতি এবং চার্টার্ড একাউন্টেন্ট মুজাফফর আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘নির্ঝর’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং এই ঠিকানা থেকেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু হয়। সংগঠনের সহসভাপতি ছিলেন- আবদুল মান্নান (বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী) ও আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম। এই সংগঠনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অরাজনৈতিকভাবে প্রচারে মোনায়েম সরকারের ভূমিকা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই সংগঠন থেকে মহান একুশ উপলক্ষে ‘নির্ঝর’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকবৃন্দ পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে দিশেহারা। বঙ্গবন্ধুসহ সকল জাতীয় নেতৃবৃন্দ জেলে। ন্যাপনেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেনসহ অন্যেরা আন্ডারগ্রাউন্ডে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন মিজানুর রহমান, তিনিও আন্ডারগ্রাউন্ডে। এমনি অবস্থায় সিদ্ধান্ত হয় রাজবন্দি মুক্তিদিবস পালন করবার। কিন্তু দিবসটি পালন করবার জন্য একটি বিবৃতি দরকার, সেখানে পার্টির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার সই দরকার। কর্মী দরকার। অথচ পাকিস্তানি খবরদারিতে সকলেই পলায়নরত অবস্থায়। এমন পরিস্থিতিতে দৈনিক পত্রিকায় ‘রাজবন্দি মুক্তিদিবস’ পালনকর্মে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের যৌথ বিবৃতি প্রকাশে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং পীর হাবিবুর রহমানের সাথে একনিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন মোনায়েম সরকার। রাজবন্দি মুক্তি দিবস উপলক্ষে মিছিল বের করা হয়, যার সম্মুখসারিতে ছিলেন- জোহরা তাজউদ্দিন ও সুফিয়া কামাল।
১৯৬৯ পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম আরও ব্যাপকতর করার জন্য আট দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ (ডাক)। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার সাথে ছাত্রদের নিজস্ব দাবি সন্নিবেশ করে ১১ দফা রচিত হয়। এই দাবির সমর্থনে ডাক-এর সহযোগী সদস্য হিসেবে ন্যাপের কার্যক্রম সক্রিয় রাখার মূল ব্যক্তি ছিলেন বজলুর রহমান ও মোনায়েম সরকার।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সমগ্র দেশ উত্তাল। চারিদিকে আন্দোলন সংগ্রামে জনজীবন মুখরিত। তারই অংশ হিসেবে ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র ছাত্র-গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে প্রথম সারির সকল ছাত্রনেতৃবৃন্দ গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারির নেতৃবৃন্দ হাল ধরেন এই সমাবেশ সফল করার জন্যে। শত ঝুঁকির মধ্য থেকেও এই সমাবেশ সফল করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন মোনায়েম সরকার। এই সমাবেশ থেকেই প্রস্তাব এবং সমর্থন করা হয়- আইয়ুব নগরের নাম ‘শের-এ-বাংলা নগর’, আইয়ুব গেইটের নাম ‘শহীদ আসাদ গেইট’ এবং আইয়ুব চিলড্রেনস পার্কের নাম ‘শহীদ মতিউর পার্ক’।
এই বছরই ২৩ চামেলীবাগে বাংলা সংস্ড়্গৃতির অন্যতম চর্চাকারী প্রতিষ্ঠান উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে সত্যেন সেনের পরামর্শে কামরুল আহসান খানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়। মোনায়েম সরকারের হাতের লেখা কমিটির এই তালিকায় অন্যরা ছিলেন- সত্যেন সেন, রণেশ দাসগুপ্ত, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মঞ্জুরুল আহসান খান, মোস্তফা ওয়াহিদ, একরাম আহমেদ এবং হেলেন করিমসহ অনেকে। পরবর্তীতে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সত্যেন সেন সভাপতি এবং মোস্তফা ওয়াহিদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ ন্যাপের সহযোগিতায় কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক যুগবাণী- পত্রিকা প্রকাশের নেপথ্যে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক শফি আহমেদ এবং মোনায়েম সরকার।
১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের দিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সাথে উপস্থিত ছিলেন মোনায়েম সরকার ও স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। তাঁরা সেদিনের ভাষণটি ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ড করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে বলা হয়েছিল ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেকো।’ এ ভাষণে অনুপ্রণিত হয়ে ৮ মার্চ হাতবোমা, পেট্রোলবোমা ইত্যাদি তৈরি এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সমগ্র দেশের জনমানুষের সাথে সাথে মোনায়েম সরকার-ও। গ্রেনেড তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, নটরডেম কলেজের আইরিশ অধ্যাপক চার্লস টাকার। বন্ধু হিসেবে সাথে ছিলেন অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্র ও ড· আবদুল্লাহ। বোমা বানানোর স্থান ছিল বুয়েটের আহসান উল্লাহ হল। বোমা কার্যকর কি-না তা পরীক্ষা করার স্থান ছিল চারুকলার পুকুর।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ১ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট স্থগিত করে দেন। সমগ্র দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। জনতা পথে নেমে আসে। রাজনৈতিক- অরাজনৈতিক সকল স্তরের মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথ উত্তপ্ত করে তোলে। এমনি সময়ে ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে ন্যাপের সভায় মোনায়েম সরকার উপস্থাপকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বলেন- এখন বক্তৃতা করবেন- ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ।’ বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করায়, সে সময় তিনি দল কর্তৃক তিরস্ড়্গৃত হয়েছিলেন। যদিও তখন পূর্ব পাকিস্তানের সকল জনগণ ‘বাংলাদেশ’ শব্দের সাথে প্রবলভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে এবং মনেপ্রাণে বাংলাদেশ শব্দটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
সমগ্র দেশ উত্তপ্ত। পাকিস্তানি সৈন্যরা গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে এসে অবস্থান করছে। রাজপথে সৈন্যবাহিনীর টহল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কিছুতেই বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বাঙালিও পাকিস্তানি শাসন কিছুতেই মেনে নিবে না। শহরে গুজব রটে গেছে··· সামরিক বাহিনী শহরে বাঙালিদের ওপর হামলা চালাবে। সমগ্র শহরে বিভিন্ন স্থানে বাঙালি-ছাত্র-যুবক-শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ প্রতিরোধ-ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। পাকিস্তানিদের সম্্ভাব্য হামলার প্রতিরক্ষা ব্যূহ হিসেবে হাতিরপুলে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের সাথে প্রতিরোধ ব্যারিকেডে মোনায়েম সরকারের অংশগ্রহণ।
ঢাকায় জোর গুজব, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজপথে নেমে আসবে। সমগ্র শহর স্তব্ধ। শংকা সারা দেশবাসীর মনে। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে আছেন। কিন্তু তাঁর কি অবস্থা তা সরেজমিনে পরখ করার জন্যে সন্ধ্যার পরপর শোভা আপার বাড়ি থেকে বের হয়ে জনশূন্যহীন ৩২ নম্বর রোডে মোনায়েম সরকারের নিশ্চুপ অবস্থান। আবদুর রাজ্জাক এবং শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানের একটি লাল গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু বাড়ি থেকে চলে গেলেন কি রয়ে গেলেন এ সম্পর্কে উৎসুক এবং উদ্বিগ্ন মোনায়েম সরকারের ধারণা অস্পষ্ট। অনেকটা হতাশ হয়ে ধানমণ্ডি ২৪ নং রোডে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাড়িতে গমন। সেখানে তাঁর পরামর্শে শুুøটিং ক্লাবের কিছু অস্ত্র তাঁর বাসা থেকে মাজহারুল ইসলামের স্ত্রী বেবী আপার বড়ভাই কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় গোপনে গাড়িতে করে পৌঁছে দিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এবং মোনায়েম সরকার- কারণ যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে এসব প্রয়োজন হবে বাঙালির। এমনই মানসিক প্রস্তুতি ছিল মোনায়েম সরকার-এর। এই রাতেই শুরু হয়ে যায় বাঙালি নিধনের রক্তাক্ত অধ্যায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবি) ব্যারাক আক্রমণের শিকার হয়। শুরু হয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির স্বাধিকারের লড়াই। স্বাধীনতার লড়াই।
২ দিনের নির্মম হত্যযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানিরা কারফিউ শিথিল করে ২৭ মার্চ। এইদিন বন্ধু অধ্যাপক গৌরাঙ্গ মিত্রের মোটর সাইকেলে করে শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রদক্ষিণ। তাঁর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হত্যাযজ্ঞ পরিদর্শন ছিল ভয়াবহ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে নির্মম। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতোই ছিল এই সেনাবাহিনীর নিমর্মতা। চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। পোড়ামাটির গন্ধ। আগুন জ্বলছে। এমন অবস্থায় সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে জগন্নাথ হল থেকে মোটর সাইকেলে পলায়ন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সমগ্র দেশ আক্রান্ত। পাকিস্তানিরা ঢাকাকে নরক বানিয়ে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধু বন্দি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। সুতরাং বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে সবাইকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমনিতর সিদ্ধান্তের কারণে নেতাদের সীমান্ত অতিক্রমের পার্টির নির্দেশনা সবার কাছে পৌঁছে দিয়ে অবশেষে স্বাধীনতার অভিপ্রায়ে ৩০ এপ্রিল ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে মোনায়েম সরকারের ঢাকা শহর ত্যাগ। কুমিল্লা দেবীদ্বার, ফতেহাবাদ গ্রামের বাড়ি হয়ে, প্রিয় বোনের দেয়া ৫০০ টাকা এবং মায়ের অশ্রুজলের বেদনা সম্বল করে হাজারো বঙ্গসন্তানের সাথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা ক্রাফট হোস্টেলে অবস্থান। সেখানে গিয়ে দেখা হয়- জ্ঞান চক্রবর্তী, সরদার আবদুল হালিম, মতিয়া চৌধুরী, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বজলুর রহমান, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, ডা· সারোয়ার আলী, স্থপতি আলমগীর কবীর, মালেকা বেগম, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মোর্শেদ আলী, কমান্ডার আবদুর রউফ, আয়শা খানম, মুনিরা বেগম, রোকেয়া কবীরসহ অনেকের সাথে।
ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে আগরতলা থেকে ধর্মনগর। সেখান থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে ট্রেনে যাত্রা। সাথে সান্জীদা খাতুন (তাঁর দুই কন্যা, এক ছেলেসহ), কাশীনাথ রায়, লায়লা হাসান (তাঁর কন্যা সঙ্গীতাসহ), আবুল মঞ্জুর, হাসান আলী ও সরদার দবীরউদ্দিন।
তিনদিন তিনরাত্রি রেলযাত্রার পর অবশেষে কলকাতা। কলকাতা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে হাসান ইমাম সবাইকে নিয়ে গেলেন, তাঁর মামা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের স্পিকার মনসুর হাবিবুল্লাহ-র বাড়ি। সেখান থেকে মোনায়েম সরকার, সরদার দবীরউদ্দিন এবং হাসান আলী এলেন নাচোলকন্যা ইলা মিত্র-র বাড়ি। আপাতত মোনায়েম সরকারের এই বাড়িতেই প্রাথমিক আশ্রয়। অন্যেরা অন্যত্র।
পরবর্তীতে শ্যামবাজার। অধ্যাপক কমল এবং অধ্যাপিকা ঊষা গাঙ্গুলির (প্রখ্যাত নাট্য নির্দেশক, অভিনেত্রী) বাসায় থাকার ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে মোনায়েম সরকারের পরিচিতি লাভ বকুল সরকার হিসেবে।
আবার জায়গা বদল। এবার ১৮৩ পার্ক স্ট্রিটে কল্যাণী ধর-এর বাসায় রাত্রি যাপন। ডা· এমএ গণি সাহেবের বাসায় হয় আহারের ব্যবস্থা। এই বাসাতেই বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ মুজতবা আলী-র সাথে পরিচয়। তিনি এই বাসার তিন তলাতে থাকতেন। এবং পেয়িং গেস্ট হিসেবে ডা· গনি’র বাসায় খাওয়াপর্ব সারতেন। পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন ডা· গণি’র ছোট ভাই আবু সাইয়িদ আইয়ুব ও তাঁর স্ত্রী গৌরী আইয়ুব। পরিচয় ঘটেছিল তাদের সাথেও। এই দুজনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
কলকাতায় ন্যাপ (বাংলাদেশ) অফিসের যাত্রা শুরু। অফিস সম্পাদক হিসেবে মোনায়েম সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, জাকির আহমেদ (বিচারপতি), সন্তোষ গুপ্ত, হাসান আলী ও সরদার দবীরউদ্দিনসহ আরও অনেকে পার্টির কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। পরবর্তীতে মতিয়া চৌধুরী এবং বজলুল রহমানের অংশগ্রহণ।
সমগ্র দেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা আক্রমণ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুখোমুখি লড়ছে। পাকিস্তানিদের নৃশংসতা বাঙালির চেতনাকে করছে আরও উদ্দীপ্ত। জীবন উৎসর্গ করবার জন্য প্রতিটি দেশপ্রেমী বাঙালি অপেক্ষমাণ। আর্মস ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাবে, এমন মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করবার জন্য মোনায়েম সরকারের মালদা ও বালুঘাটে গমন। বালুঘাটে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করতে গিয়ে এক আগ্রহী প্রশিক্ষণার্থী অশ্রুসজল কণ্ঠে মোনায়েম সরকারের পা জড়িয়ে ধরে বলে, তাকে প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্যে। সে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধ করতে দেশের অভ্যন্তরে যেতে চায়। আবেগাক্রান্ত মোনায়েম সরকার তাকে প্রশিক্ষণের জন্যে নির্বাচিত করে। দেশের জন্যে অকাতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করার এমন উদাহরণ সত্যি বিরল।
আগরতলা, মেঘালয়, বনগাঁ, বশিরহাট, মালদহ, বালুরঘাট এলাকায় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়নের জেলাভিত্তিক অভ্যর্থনা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা। এমনি একটি ক্যাম্প পরিদর্শনে আগরতলায় অক্টোবর মাসে পুনরায় গমন। সাথে ইলা মিত্রের স্বামী নাচোল কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক রমেন মিত্র। সেখানে মতিয়া চৌধুরী, মুর্তজা খান, মোর্শেদ আলী, সরদার হালিম, মালেকা বেগম, মুনিরা আক্তার, ফওজিয়া মুসলেম, আয়েশা খানম এবং রোকেয়া কবীরের সাথে সাক্ষাৎ।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্যে তখন বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত। তেমনি একটি বিষয় ছিল প্রকাশনা। তখন প্রায় নিয়মিত ন্যাপ অফিসে আসতেন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পী মোস্তফা আজিজ এবং সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত। মোনায়েম সরকার তখন গ্রেনেড হাতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার একটি দৃশ্য সম্বলিত ‘মুক্তিযুদ্ধের জয়ের কৌশল’ নামে একটি বই-এর কভার এঁকে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান-কে। তিনি এ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে বরং উত্তেজিত হয়ে মোনায়েম সরকারকে বলেন- ‘ইডিয়েট, কামরুলের কী গ্রানেড আঁকার জন্যে জন্ম হয়েছে? যেকোনো আর্মির বইয়ে গ্রানেডের ছবি পাবে তাই নিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে নাও।’ এই বলে হনহন করে চলে যান। পরের দিন ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি’ (ANNIHILATE, THESE DEMONS)- সম্বলিত ক্যাপশন সহযোগে ইয়াহিয়ার দানবাকৃতি মুখের-রক্তাক্ত ছবি সহযোগে একটি পোস্টার ডিজাইন করে নিয়ে আসেন, যা পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয় এবং বিশ্বে আলোড়ন তোলে। এই পোস্টার দেখে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত খুশি হন এবং পটুয়া কামরুল হাসানকে আর্থিকভাবে পুরস্ড়্গৃত করেন।
জুন মাসে বিজ্ঞানী সত্যেন বোস-এর সাথে পরিচয়। মোনায়েম সরকারকে ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার কাজে যোগদানের আমন্ত্রণ। মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানিরা নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করছে। স্বাধীনতা অবশ্যই আসবে। এই যুদ্ধে তিনিও একজন সমান অংশীদার- এই মর্মে বিজ্ঞানী সত্যেন বোস-এর বিজ্ঞান গবেষণার আমন্ত্রণ বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে তাঁর আবাসস্থলে যাওয়া এবং তাঁকে স্বচক্ষে প্রথম দেখা। জন্মদিন উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র ঘর ফুলে ফুলে আবৃত। কাজী নজরুল ইসলাম নিবিষ্ট মনে কাগজ টুকরোটুকরো করছেন। আঙ্গুরবালা গান গাইছেন- ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি।’ সমগ্র ঘর মানুষে, ফুলে এবং গানের ছন্দে মুখরিত। বাংলাদেশের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী লাখো বাঙালির পক্ষ থেকে কবিকে তাঁর জন্মদিনের ফুল উপহার দিলেন মোনায়েম সরকার।
জুলাই মাসে মুজিবনগর সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের হাতে নতুন বাংলা পত্রিকার কপি প্রদান করেন মোনায়েম সরকার। সাথে ছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। এই পত্রিকা প্রকাশে মূল দায়িত্ব পালন করেছিলেন- হাসান আলী, সরদার দবীরউদ্দিন এবং মোনায়েম সরকার।
মুজিবনগর সরকারের ‘উপদেষ্টা পরিষদে’র সভাপতি ছিলেন- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সদস্য ছিলেন- কমরেড মণি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, মন্ত্রী এম মনসুর আলী ও মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান। এই পরিষদের সভা শুরু হওয়ার খানিকটা আগে মোজাফফর আহমদ, মাজহারুল ইসলাম এবং মোনায়েম সরকার উপস্থিত হলেন। মওলানা ভাসানী পরিষদের সদস্যদের ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়াবেন, তাঁর প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। এমনি সময়ে মোজাফফর আহমদ বললেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর আসছে, আর আপনি ইলিশ মাছ ভাজছেন?’ উত্তরে ভাসানী বললেন, ‘মোজাফফর তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন? তুমি-আমি অস্থির হয়ে কিছু করতে পারব? যা করার জওহরলালের বেটিই করবে।’
১৪ ডিসেম্বর যশোরে সার্কিট হাউজের মাঠে ন্যাপ একটি জনসভার আয়োজন করে। যদিও তখনো দেশ মুক্ত হয়নি। তবে জয় যে অনিবার্য তা পাকিস্তানিদের পিছু হটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল। এই জনসভায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, গীতা মুখার্জিসহ অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ অনেকে এই সভায় বক্তব্য রাখেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন- যশোর জেলা ন্যাপ সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক। মোনায়েম সরকারও যোগদান করেন এই সভায় এবং জনসভা শেষে সকলে কলকাতায় ফিরে যান। উল্লেখ্য মুজিবনগর সরকারের আয়োজনে এই সার্কিট হাউজ ময়দানে ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকহানাদার থেকে মুক্ত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মা-মাটি-মানুষ আজ মুক্ত। সমগ্র দেশ আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। ৯-সি নাসির উদ্দিন রোডে ন্যাপ অফিসে বসে কর্মরত অবস্থায় নিবেদিত কর্মী মোনায়েম সরকার এই খবর পেয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন। স্বদেশ মুক্তির খবরে চোখে জল এসে যায়। কলকাতাও মেতে ওঠে উচ্ছ্বাসে। চারদিক থেকে জয় বাংলা ধ্বনি শোনা যায়। ন্যাপ অফিসে স্থানীয় বাসিন্দারা এসে ফুল এবং মিষ্টি দিয়ে যায়।
২১ ডিসেম্বর স্বাধীন স্বদেশের পথে মোনায়েম সরকার-এর যাত্রা, প্রথমে যশোর। সাথে অধ্যাপক শান্তিময় রায়, নন্দিতা হাকসার, আলী হায়দার খান। সেখান থেকে খুলনা। তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার কামাল সিদ্দিকীর সাথে সাক্ষাৎ। দেশ ভাসছে আনন্দে। যশোর যাওয়ার পথে পথে মানুষের উচ্ছ্বাস। আবেগে আক্রান্ত গাড়ির যাত্রীবৃন্দ। তৎকালীন ডিসি কামাল সিদ্দিকী মেজর জলিলের কু-কীর্তির ১৬ পৃষ্ঠার একটি দলিল মোনায়েম সরকারের হাতে তুলে দিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে।
পরদিন পুনরায় কলকাতায় ফিরে যাওয়া। সেখানে ন্যাপের বনগাঁ, বশিরহাট, মালদহ, বালুর ঘাট, শিলং, তুরা, আগরতলাসহ বিভিন্ন স্থানের ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের জেলাওয়ারি যৌথক্যাম্প গোটানোর কাজে মোনায়েম সরকার ও জাকির আহমদের আরও কিছুদিন অবস্থান।
২৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মন্ত্রী এম মনসুর আলীর স্ত্রী এবং জাকির আহমদসহ ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ।
৩০ ডিসেম্বর পুনরায় সড়কপথে কলকাতা যাত্রা। সাথে মাতৃসমা খালাম্মা রহিমা চৌধুরানী ও তাঁর ছেলে আবদুর রহিম চৌধুরী (চন্দন চৌধুরী)।
১৬ জানুয়ারি কলকাতার কাজ শেষে স্থায়ীভাবে স্বদেশের পথে পুনরায় যাত্রা। ১টি ট্রাকে করে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা অফিসের এবং ন্যাপ অফিসের সকল দলিলদস্তাবেজ এবং ১টি বাসে করে সস্ত্রীক দিলীপ বোস, পঞ্চানন সাহা, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, তরুণ সান্ন্যাল, ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন ও শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র সঞ্জীব দত্তের স্ত্রী প্রতীতি দত্ত, তাদের মেয়ে এ্যারোমা দত্ত, সস্ত্রীক সন্তোষ গুপ্ত এবং মা রহিমা চৌধুরানীসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পথে। দেশকে বিশ্বমানবিকতামুখী এক সফল রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে মোনায়েম সরকারের বাংলাদেশে একেবারেই ফিরে আসা।
১৯৭২ মোনায়েম সরকার পার্টি অফিস সেক্রেটারি কাম পাবলিক রিলেশন্স সেক্রেটারি। অর্থাৎ হোল টাইমার্। এই হোল্ টাইমার্-এর মধ্যে আরও ছিলেন- পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী ও নির্মল বিশ্বাস। সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন।
‘এসো দেশ গড়ি’ এই ্লোগান দিয়ে ন্যাপ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ন্যাপ সিপিবিকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়। এমন কি পতিত জায়গায় ধান ফলাও এই ্ল্লোগান নিয়ে ন্যাপ রমনা রেসকোর্স (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ চাষের উদ্যোগ নেয়। সেখানে বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল, যাতে কৃষকের ধানের চারার অভাব না হয়। মোনায়েম সরকার সম্পূর্ণ উদ্যোগের সাথে ছিলেন সম্পৃক্ত।
ন্যাপ কর্তৃক প্রথমে ঢাকার শ্যামলীতে এবং পরে মিরপুরে সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা। মোনায়েম সরকার এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭৩ ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদে যারা ছিলেন সোচ্চার তাদের জন্য নির্মিত হয় নির্যাতন কেন্দ্র আন্দামান সেলুলার জেল। ভারত সরকার আন্দামান সেলুলার জেলকে রূপান্তরিত করে মিউজিয়ামে। এই ঐতিহাসিক স্থানকে মিউজিয়ামে রূপান্তরের উদ্যোগকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল মোনায়েম সরকার-এর। নেতাজি সুভাষ বোসের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার মাঠে আয়োজন হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মিউজিয়াম উদ্বোধন করেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে· আর গনেশ। উপস্থিত ছিলেন বরিশালের প্রখ্যাত বিপ্লবী নিখিল রঞ্জন গুহ রায়। আরও ছিলেন- খোকা রায়, জুঁই ফুল রায়, নলিনী দাশ, আশু ভরদ্বাজ, মনোরমা বসু, রবি নিয়োগী, কল্পনা যোশী, গণেশ ঘোষ, পৃথ্বী সিং আজাদ, মন্মথনাথ গুপ্ত, মায়া গুপ্তা, খুশু দত্ত রায়সহ প্রায় ৩০০ বিপ্লবী।
মোনায়েম সরকার-এর প্রথম বই রচনা – ন্যাপ ও ন্যাপের প্রশিক্ষণ। ন্যাপ কর্তৃক বইটি প্রকাশিত হয়।
১৯৭৪ পরিবার পরিজনসহ ব্রিটিশযুগের প্রায় ২০০জন বিপ্লবীর আগমন ঘটে ১৯৭৪ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশে। বিপ্লবীদের আগমন উপলক্ষে একটি অভ্যর্থনা কমিটি করা হয়। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, কোষাধ্যক্ষর দায়িত্ব পালন করেন কমিউনিস্ট পার্টির জ্ঞান চক্রবর্তী এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ন্যাপের মোনায়েম সরকার। এই অভ্যর্থনা পার্টিতে ফণিভূষণ মজুমদার বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই আগমনে বিপ্লবীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ ছিল, বিপ্লবীদের জন্য সত্যিকার অর্থে ভিন্ন অনুভূতি।
সমগ্র দেশে অস্থিরতা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সমগ্র দেশ দ্বিধাবিভক্ত। এমনি সময় জাতীয় ঐক্য জোট গড়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টি মিলে ত্রিদলীয় ঐক্য জোট গড়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে মির্জা সামাদ এবং মোনায়েম সরকার সহযোগে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদানের জন্যে একটি খসড়া তৈরি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জেলা নেতৃবৃন্দের অনাগ্রহের কারণে বঙ্গবন্ধু বললেন, থ্রি লেগিড রেইস দিয়ে হবে না। ফলে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট বেশি দূর এগুতে পারেনি। মাত্র তিন মাস ছিল এই জোটের আয়ু। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষে সর্বদল সমন্বয়ে তৈরি করেন- বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। এই রাজনৈতিক দলের জাতীয় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে মোনায়েম সরকারের যোগদান। কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন তোফায়েল আহমেদ।
বাকশাল তৈরি হওয়ার পর গভর্নর এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্যে একটি নিয়মতান্ত্রিক সিলেবাস প্রণয়ন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই সিলেবাস প্রণয়ন করেন- প্রফেসর আবদুল হালিম, মীর্জা সামাদ, সন্তোষ গুপ্ত এবং মোনায়েম সরকার। ২৩ চামেলীবাগে বসে খসড়া সিলেবাস তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু, জিল্লুর রহমান এবং আবদুর রাজ্জাকের কাছে মোনায়েম সরকার হস্তান্তর করেন। খসড়া সিলেবাস পরবর্তী মূল সিলেবাস হয়। যা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রশিক্ষণের জন্যে ব্যবহার হয়েছিল।
১৯৭৫ ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলেন, বাংলাদেশের কতিপয় বিপথগামী মোনাফেক দ্বারা। সমগ্র দেশ স্তম্্িভত। হতবাক। চারদিকে চরম নৈরাজ্য। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা গর্ত থেকে বের হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত থমথমে পরিবেশের মধ্যে মোনায়েম সরকার, অধ্যাপক নূরুল আমীন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড· ম· আখতারুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর স্বপক্ষে প্রথমে সাইক্লোস্টাইলে, পরে টাইডাল প্রেসে প্রিন্ট করে লিফলেট প্রকাশ করেন। লিফলেটের হেডলাইন ছিল ‘মীরজাফর হুঁশিয়ার।’ চারদিকে শত্রুর ভয়ংকর অবস্থানের মধ্য দিয়ে এমন একটি লিফলেট প্রকাশ করা ছিল মৃতুøর সাথে রীতিমতো পাঞ্জা লড়া। যা এই সময়ে চিন্তাও করা যাবে না। এই লিফলেট সমগ্র দেশে বিতরণ করা হয়েছিল। ডাকযোগে সকল মন্ত্রী, এমপি, ডিসি, এসপি, এসডিও সহ সকল সরকারি কর্মকর্তা ও দালালদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল।
দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে মোনায়েম সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশ ত্যাগ করবেন। পরবর্তী সময়ে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে এইসব ঘাতক-শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়বেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। মোজাফফর আহমদের কাছে গেলেন। তিনি মোনায়েম সরকারের দেশ ত্যাগে বাধা দিলেন। মোনায়েম সরকার মোজাফফর আহমদের বাধা উপেক্ষা করে বড় কিছু করবার আশায় দেশ ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমালেন অক্টোবরের ১৪ তারিখ। ন্যাপনেতা মোজাফফর আহমদের দেশ ত্যাগ না করার নির্দেশ উপেক্ষা করে মোনায়েম সরকারের দেশত্যাগ ছিল একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। এবং কলকাতায় কল্যাণী ধরের বাসায় প্রাথমিক আশ্রয়।
দেশ গভীর সংকটে নিমজ্জিত। সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক অশুভশক্তির খপ্পরে দেশ। মোনায়েম সরকার ভারতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। এমনি একদিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কলকাতা শাখার একজন কর্মকর্তা মোনায়েম সরকারের কাছে এসে অকস্মাৎ বললেন- ‘বাংলাদেশের সেন্ট্রাল জেলে চার থেকে ষোলোজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কে হতে পারে?’ হঠাৎ এমন কথা শুনে মোনায়েম সরকার কিংকর্তব্যবিমূঢ়, স্তম্্িভত। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন- যদি চারজন হয়, তবে ‘তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামান।’ পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মোনায়েম সরকারকে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘মি· সরকার প্রফেটিক প্রফেটিক। তোমার কথাই সঠিক।’ এ সময়ে প্রফেসর শান্তিময় রায়ের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন মোনায়েম সরকার। মোনায়েম সরকার এবং ইন্দিরা গান্ধীর দীর্ঘ আলাপচারিতা হলো। মোনায়েম সরকার দেশের এই অরাজকতা নিবৃত্তে একটি প্রস্তাবনা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পেশ করলেন, যা ছিল আলফা-বিটা নামে একটি সুইসাইড কমান্ডো প্রজেক্ট। ইন্দিরা গান্ধী সব শুনে বললেন-Professor Roy, this sort of things are not dealt in PM level. Talk to Professor PN Dhar.· যদিও পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত যোগাযোগ, অন্যান্য সমস্যা এবং সদস্য অপ্রতুলতায় বাতিল হয়ে যায়।
৭ নভেম্বর মোনায়েম সরকার-এর খোঁজে ঢাকা ২৩ চামেলীবাগে হানা দেয় সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। না পেয়ে মা রহিমা চৌধুরানী, চন্দন চৌধুরী ও তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। সাথে নিয়ে যায় লুণ্ঠিত অর্থ সোনাদানা। যদিও ওই দিনই তাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যা, আওয়ামী রাজনীতি নির্মূলকরণের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যেখানে যত আওয়ামী লীগ অনুরাগী, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক আছেন তাঁরা তাদের মতো করে রাজনৈতিক সংগঠন, পত্রিকা বা সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। কলকাতা থেকে মাহফুজুল বারী, নজিবুর রহমান, রেজাউল হক প্রকাশ করতেন বজ্রকণ্ঠ। এই পত্রিকার নেপথ্যের একটি বড় খরচ বহন করতেন মোনায়েম সরকার।
গণ-আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা বিশেষ করে লন্ডনের পত্রিকাগুলো ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে প্রতিরোধ, বাংলার ডাক, সোনার বাংলা (বাংলা ও ইংরেজি) এবং সানরাইজ, মোনায়েম সরকারের কাছে আসতো এবং তিনি তা জনমত গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করতেন- যা পরবর্তীতে সমগ্র দেশে বিলি হতো। আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় অবস্থানরত বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত রাজনৈতিক কর্মীদের কাছেও প্রেরণ করতেন তিনি।
১৯৭৬ বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যাসহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানে সমগ্র দেশ আতঙ্কিত। আতঙ্কিত বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীবৃন্দ, যারা বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরাও। দেশের এহেন পরিস্থিতি, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যা ও সমসাময়িক রাজনীতির আগ্রাসীরূপ বিশ্ববাসীর নজরে আনবার জন্যে তাঁরা প্রকাশ করেন Bangladesh victim of imperialist conspiracy নামক একটি বুকলেট। ৩০০০ কপি ছাপা হয়। বইটির প্রকাশক পিস ফোর্সেস অব বাংলাদেশ। এই বই-এর প্রকাশনার যাবতীয় সকল কর্ম সম্পাদন করেন মোনায়েম সরকার। বাংলাদেশ পিস কাউন্সিল-এর জেনারেল সেক্রেটারি আলী আকসাদ কলম্বো ও বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত পিস কাউন্সিল সম্মেলনে আগত সকল প্রতিনিধির কাছে এই বুকলেট বিলি করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শোকদিবস পালন অনুষ্ঠানে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এই বুকলেট বিলি করেন লন্ডনে।
৭ ফেব্রুয়ারি ভারতে নির্বাসিত অবস্থায় মোনায়েম সরকারের পিতা ১০০ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। এই সংবাদ পিতার মৃতুøর তিন মাস পর মোনায়েম সরকার জানতে পারেন।
১৯৭৭ ভারতবর্ষে ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে ৭৫ পরবর্তী প্রতিরোধ আন্দোলনকে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা এই সংগঠন করে। সংগঠনটির শাখা দুটি ছিল। একটি কলকাতায়, আরেকটি দিল্লিতে। কলকাতার শাখার আহ্বায়ক ছিলেন- অধ্যাপক শান্তিময় রায় এবং দিল্লি শাখার আহ্বায়ক ছিলেন- সুব্রত ব্যানার্জি। সংগঠন তৈরি নেপথ্য কারিগর ছিলেন মোনায়েম সরকার। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের উদ্যোগে দিল্লিতে গান্ধী মেমোরিয়াল হলে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবস পালিত হয়। শাহাদাত দিবস উপলক্ষে মোনায়েম সরকারের দিল্লি যাত্রা। এই শোক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- কংগ্রেস নেতা চন্দ্রজিৎ যাদব, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা নন্দিনী সৎপথি, কংগ্রেস সেক্রেটারি ভিভি রাজু, রাজ্যসভার সদস্য আর কে মিশ্রা, জনতা পার্টির কৃষ্ণকান্ত, সিপিআই-এর এন কে কৃষ্ণান, সিপিএমএ-র বাসব পূর্ণাইয়া, বিশ্বশান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশ চন্দ্র ও এমপি শশিভূষণ। সভাপতিত্ব করেন- ব্রিটিশযুগের বিপ্লবী মন্মথ নাথ গুপ্ত।
ভারতে মোরারজী দেশাই ক্ষমতায়। বাংলাদেশের বিষয়ে মোরারজী সরকার উদাসীন। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস নানা সংকটে নিমজ্জিত। এমনতর সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন মোনায়েম সরকার। তাকে বাংলাদেশের সকল বিষয় অবগত করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটে মোরারজী সরকারের উদাসীনতায়, যারা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিল তাদের ত্রাহি অবস্থা। এই সরকার বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মীদেরকে পুশব্যাক করেছে ভারত থেকে বাংলাদেশে। মোনায়েম সরকারও এই পুশব্যাকের ভয়ে পলায়নরত অবস্থায় বারবার জায়গা বদল করে গঙ্গার ধারে বেলুড় মঠের পাশে সিপিআই নেতা দিলীপ বোসের বাবার বাগানবাড়িতে আত্মগোপনরত।
’৭৫-এর পট পরিবর্তনে কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী ও তাঁর বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এমন সময়ে সংবাদ হয়, যে কাদের সিদ্দিকী বাহিনীর কিছু সদস্যকে ভারতীয় সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। এই ঘটনা জানার পর শওকত ওসমান, রণেশ দাশগুপ্ত, সঞ্জীব দত্ত ও জাওয়াদুল করিমসহ সিদ্ধান্ত নিয়ে এককভাবে দিল্লি পৌঁছান মোনায়েম সরকার। সেখানে কংগ্রেস নেতা- চন্দ্রজিৎ যাদব, শশীভূষণ, আর কে মিশ্রা, নন্দিনী সৎপথি এবং কে আর গণেশসহ ৪০জন এমপি-র স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করা হয় সংবাদপত্রে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এমন অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মোনায়েম সরকার জনতা পার্টির এমপি অধ্যাপক সমর গুহ ও চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখর-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এহেন কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান।
ইংল্যান্ডেও চরম তিক্ততা তৈরি হয় আওয়ামীপন্থিদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে। একদিকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অন্যদিকে এম আর আখতার মুকুল। পরম ধৈর্যের সাথে এই দুপক্ষকে এক করার চেষ্টা করেন মোনায়েম সরকার ভারতে বসে। এমন সময়ে রাজনৈতিক বিভ্রান্তিতে যাতে কেউ না পড়ে তাঁর জন্যে নিয়মিত এরোগ্রাম পোস্ট করেন- ড· কামাল হোসেন, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন, প্রফেসর রেহমান সোবহান এবং প্রফেসর নুরুল ইসলাম প্রমুখদের কাছে। তাঁরা তখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে ছিলেন। এই চিঠিগুলির সন্ধান পাওয়া যাবে বিভুরঞ্জন সরকার সম্পাদিত বই- মোনায়েম সরকার যখন নির্বাসনে।
১৯৭৮ ধীরে ধীরে ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জিয়া সরকারের প্রলোভনে বা অনিশ্চিত জীবনের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে অথবা সামরিক সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন দলের তথাকথিত নেতাকর্মীবৃন্দ, ব্যতিক্রম মোনায়েম সরকার। তাঁর তখনো ইচ্ছা ঘরে-বাইরে প্রতিরোধ গড়ে তোলবার। তাঁর তখনো বিশ্বাস ছিল পরিবর্তন আসবেই।
১৯৭৯ বাংলাদেশে নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ন্যাপের উদ্যোগে ভারত থেকে বাংলাদেশে মোনায়েম সরকারের প্রত্যাগমন। ন্যাপ নেতা মোজাফফরের সাথে জেনারেল জিয়ার ঐকমত্য তৈরি। জিয়ার ১৯ দফায় ন্যাপের অকুণ্ঠ সমর্থন। এবং নির্বাচনে ন্যাপের অংশগ্রহণ। মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, রাশেদ খান মেনন, শাহজাহান সিরাজ সামরিক কূটচালনিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে এমপি হিসেবে নির্বাচিত। কিছুদিনের মধ্যে ন্যাপে ভাঙ্গনের শব্দ। মোনায়েম সরকার জিয়ার সাথে এই ঐকমত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। তাঁর ইচ্ছা ন্যাপ আওয়ামী লীগের সাথে মিশে যাক। কিন্তু সেখানেও কিছু স্বার্থান্বেষী কর্তৃক বাধা। ফলে দল থেকে বেরিয়ে হারুন-মতিয়া গ্রুপে মোনায়েম সরকারের যোগদান। এখানে সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি। পরবর্তীতে হারুন-মতিয়া গ্রুপেও ভাঙ্গন। এমনতর অবস্থায় ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন মতিয়া চৌধুরী, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, স্থপতি আলমগীর কবীর, ইয়াফেস ওসমান, সরদার দবীরউদ্দিন, ফখরুদ্দিন আহমদ এবং মোনায়েম সরকারসহ ১৭জন কেন্দ্রীয় নেতা।
১০১ জন বুদ্ধিজীবীর সমন্বয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন। আহ্বায়ক হলেন বোস প্রফেসর অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। এই পরিষদ গড়ে তোলার নেপথ্যে কারিগর মোনায়েম সরকার ও নূরুর রহমান।
’৭৫-পরবর্তী ১৯৭৯ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃতুøবার্ষিকী পালন করা ছিল একটি দুঃসাহসিক ভাবনা। অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ থেকে মোনায়েম সরকার এই দিনটি পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। প্রবল উৎকণ্ঠা এবং দীর্ঘ প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথম প্রকাশ্যে শোকসভা হয় টিএসসি-তে। জনমত সৃষ্টিতে এই জনসমাবেশ ছিল আওয়ামী রাজনীতির অবরুদ্ধ অবস্থার প্রাথমিক প্রকাশ্য উত্তরণ। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ সংবলিত বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন শীর্ষক বইটি ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ থেকে প্রকাশিত হয় এই দিন। এই বইটির বর্ধিত সংস্ড়্গরণ মোনায়েম সরকারের সম্পাদনায় পরবর্তীকালে আগামী প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত হয়। এবং এই বর্ধিত সংস্ড়্গরণে অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তান পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ।
১৯৮০ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ধীরে ধীরে আওয়ামী রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে অসম্প্রদায়িকতার দিকে ধাবিত হয়। আওয়ামীপন্থী নেতৃবৃন্দও তাদের ভীতিমূলক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মূল ধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার চর্চায় নিবেদিত হন। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাল ধরবে কে? এ নিয়ে ছিল প্রত্যেকের দ্বিধা। হাল ধরার কাণ্ডারিও ছিল অনেকজন। তাদের অনেকেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নামটিই সামনে চলে আসে। এক পারিবারিক পরিবেশে শেখ হাসিনার নাম প্রথম প্রস্তাব আকারে ভারতের রাজনীতির এক দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব পিএন হাকসারের কাছে তুলে ধরেন মোনায়েম সরকার। যদিও পিএন হাকসার ড· কামাল হোসেনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু মোনায়েম সরকারের প্রস্তাবনায় তিনি অকণ্ঠ সমর্থন দেন। এবং এও বলেন, ‘Yes, you can used the emotion of Bangabandhu.’- যা আবদুর রাজ্জাকও জানতেন। তিনদিন সম্মেলন চলে দুটি প্যানেল নিয়ে। কিন্তু ঐক্যমত হয়নি। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব হওয়ায় তা সর্বমহলে গৃহীত হয় সর্ব সম্মতিতে।
১৯৮১ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ড· কামাল হোসেনকে দল থেকে নমিনেশন দেয়া হল। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শফিক রেহমান ছিলেন প্রেস রিলিজের দায়িত্বে। এই নির্বাচনে মোনায়েম সরকার ছিলেন অর্থতহবিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত।
দিল্লিতে আফসো সম্মেলনে শেখ হাসিনা গেস্ট অব অনার হিসেবে আমন্ত্রিত। ডেলিগেট হিসেবে মোনায়েম সরকারের যোগদান। দিল্লির অশোকা হোটেলে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অনত্যম দুই সদস্য শেখ হাসিনা এবং মোনায়েম সরকারের অবস্থান।
১৯৮২ ১২ অক্টোবর, ১৯৮২ সালে মোনায়েম সরকারের মা ২৩ চামেলীবাগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মোনায়েম সরকারের উপস্থিতিতে। আর এক মা রহিমা চৌধুরানী ছিলেন এ সময় সার্বক্ষণিক মোনায়েম সরকারের পাশে।
বই সম্পাদনা করেন- রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি। প্রকাশকঃ বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
১৯৮৩ ১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে শিক্ষাভবন ঘেরাও করতে গিয়ে দুইজন ছাত্র নিহত হয়। পরবর্তী বছর ১৯৮২ সালে এই দিনকে স্মরণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এরশাদ সরকারের পেটুয়া বাহিনী সমাবেশ করতে দেবে না। দল থেকে গোপন মিটিং-এর আয়োজন হল ড· কামাল হোসেনের বাসায়। এই মিটিংএর সাফল্যের জন্য যাবতীয় আয়োজন এবং যোগাযোগ-এর দায়িত্ব পালন করেন মোনায়েম সরকার। মিটিংয়ে হাজির হলেন- শেখ হাসিনা, সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মান্নান, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, কমরেড ফরহাদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, দিলীপ বড়ুয়া, নির্মল সেন, মনজুরুল আহসান খান, নির্মল বিশ্বাস, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, লাইসুজ্জামানসহ ৩৪জন। গোপন খবরের ভিত্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই এরশাদের সরকারের সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি হলেন ১৫ দলের সকল নেতৃবৃন্দসহ মোনায়েম সরকার। তাঁদের প্রত্যেককে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ঢাকা ক্যান্টেনমেন্টের কারাগার থেকে ১৫ দিনের কারাবরণ শেষে, মুক্তি পেলেন ১ মার্চ। কারাগারে আবদুল জলিল ও মোনায়েম সরকার একই সেলে বন্দি ছিলেন।
১৯৮৪ ১৪ অক্টোবর মানিক মিয়া এভিনিউতে ১৫ দলের মহাসমাবেশ। মোনায়েম সরকারের ২৩ চামেলীবাগে তৈরি হয় ২১ দফা খসড়া কর্মসূচি। এই কর্মসূচি প্রণয়নে উপস্থিত ছিলেন- আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ ফরহাদ, নির্মল সেন, শাহজাহান সিরাজ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রাশেদ খান মেনন ও মোনায়েম সরকার। উপস্থিত সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে খসড়া কর্মসূচি লেখার দায়িত্বে ছিলেন রাশেদ খান মেনন।
১৯৮৫ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই স্থানটিকে প্রজন্মের কাছে সুচিহ্নিত করে রাখার জন্যে ১৯৮৫ সালে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত কণ্ঠ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- মার্বেল পাথরে খোদাই করে রাখা হয়। এই কমিটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মোনায়েম সরকার ও স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। যা এখনো শিশু পার্কের পাশে দেয়াল ঘেষে বিদ্যমান। আজ সেখানে শিখা চিরন্তন ও স্বাধীনতাস্তম্্ভ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেছিলেন- সেই চিহ্নিত সূত্র থেকে বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত পদযাত্রা শুরু করে ৩২ নম্বর রোডে ফুল প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁর মৃতুøবার্ষিকী পালিত হত। উল্লেখ্য এই পরিকল্পনাও ছিল মোনায়েম সরকারের। এই পদযাত্রা প্রথম দিকে শহিদ মিনার থেকে খালি পায়ে শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত।
প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহ্মদকে সভাপতি করে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় ১১ সদস্যের প্রথম আহ্বায়ক কমিটি তৈরির প্রধান প্রস্তাবক ছিলেন মোনায়েম সরকার। এই প্রস্তাবের আন্তরিক সমর্থক ছিলেন শেখ হাসিনা। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষে এবং সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেশবন্ধু পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন রহিমা চৌধুরানী এবং নেপথ্যে কাজ করে গেছেন মোনায়েম সরকার। এ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রথম কয়েক বছর ২৩ চামেলীবাগ থেকে প্রকাশিত হত।
১৯৮৭ রচিত বই- বাংলাদেশে বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের উত্থান অনিবার্য।
১৯৮৮ এরশাদের পতনের দাবিতে সারা দেশ উত্তাল। এই আন্দোলনে এরশাদ সরকার ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন সরকারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একসাথে আন্দোলনে যাওয়ার আগের সমঝোতা প্রস্তুতিতে মোনায়েম সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ-পদক্ষেপ। দীর্ঘ আলোচনা সংলাপের পর একটি সময়ে দুই প্রধান নেত্রীর যৌথ বিবৃতির পরিবেশ তৈরি হয়। এই সমঝোতা সংযোগ-অবস্থান এবং আন্দোলনের যৌথ বিবৃতি তৈরিতে আবদুল জলিল এবং মোনায়েম সরকারের অবদান ছিল বিশেষভাবে অর্থবহ। যৌথ বিবৃতি শেখ হাসিনার নিজের হাতের লেখা ছিল। যেখানে খালেদা জিয়া স্বাক্ষর করেন।
১৯৯১ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র বিকাশে ঐক্য অপরিহার্য, গ্রন্থ প্রকাশ
১৯৯২ ইতিহাসের আলোকে বাঙালি জাতীয়তার বিকাশ ও বঙ্গবন্ধু, জাতীয় বিকাশের মূলস্রোত বনাম তৃতীয় ধারা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বামপন্থীদের করণীয়, গ্রন্থ প্রকাশ।
১৯৯৩ বামপন্থীদের সংকট ও বাংলাদেশের রাজনীতি প্রকাশিত হয়।
১৯৯৪ সম্পাদিত বইঃ ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু (যৌথভাবে)।
১৯৯৫ বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন করে জনবিরুদ্ধ সরকার গঠন করতে চাইছে। অওয়ামী লীগ এই গণবিচ্ছিন্ন প্রহসনের নির্বাচনকে মেনে নেয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারা দেশে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে। ঢাকায় আন্দোলন তুঙ্গে। জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন আরও তীব্রতর করার জন্য শেখ হাসিনার সমর্থনে জনতার মঞ্চ তৈরির প্রধান কারিগর ছিলেন- অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাঈদ ও মোনায়েম সরকার। এই মঞ্চ প্রতিষ্ঠার ফলে জনতার আন্দোলনের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এক পর্যায়ে বিএনপি প্রহসনের সরকার ভেঙ্গে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। পার্লামেন্টে কেয়ারটেকার সরকার বিল পাশ করা হলো। এই আন্দোলনের ফলে বিএনপি নেতা মান্নান ভূইঁয়া আওয়ামী লীগের মোনায়েম সরকারের সাথে দলীয়ভাবে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মোনায়েম সরকার শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে মান্নান ভূঁইয়ার সাথে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই কঠিন দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতার সাথে।
সম্পাদিত বইঃ মৃতুøঞ্জয়ী মুজিব (যৌথভাবে)। প্রকাশকঃ বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
১৯৯৬ জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনী কমিটি তৈরি করা হয়। যুগ্ম আহ্বায়ক- শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও গাজীউল হকসহ আরও অনেকে। কিন্তু নির্বাচনী পরিচালনার প্রথম সারির কারিগরের মধ্যে ছিলেন- শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং মোনায়েম সরকার। এই কমিটির নির্বাচনী পরিচালনার দক্ষতায় ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ দেশশাসন প্রক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত হয়।
সম্পাদিত বইঃ জাতীয় চারনেতা স্মারকগ্রন্থ (যৌথভাবে)। প্রকাশক- চারনেতা পরিষদ।
রচিত বইঃ বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং মোনায়েম সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্ড়্গৃতির মূলধারার গবেষণাগার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ চামেলীবাগে এই প্রতিষ্ঠানের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। গবেষণাগারের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব আমৃতুø পালন করেন- শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোনায়েম সরকার।
১৯৯৭ সম্পাদিত বইঃ বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস (যৌথভাবে)। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
সম্পাদিত বইঃ স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ (যৌথভাবে)। প্রকাশক- রজত জয়ন্তী উদযাপন কমিটি।
১৯৯৮ সম্পাদিত বইঃ শেখ মুজিব একটি লালগোলাপ (যৌথভাবে)। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
তথ্যচিত্রঃ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম (২২খণ্ড)। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। পরিচালনাঃ কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী।
২০০০ সম্পাদিত বইঃ বাঙালি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু (যৌথভাবে)। আগামী প্রকাশনী।
রচিত বইঃ বহতা নদীর মতো আওয়ামী লীগ। প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স।
২০০১ জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার অন্যতম সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে মোনায়েম সরকারের যোগদান। ৪২% ভোট পেয়েও নির্বাচনে হেরে যায় আওয়ামী লীগ।
পরাজয়ের সমস্ত দায়ভার আসে কমিটির অন্যতম সদস্য শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও মোনায়েম সরকার-এর ওপর।
সম্পাদিত বইঃ বাঙালির কণ্ঠ। প্রকাশকঃ আগামী প্রকাশনী।
২০০২ সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ পত্রিকা শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত। প্রকাশনার নেপথ্যে কারিগর মোনায়েম সরকার।
তথ্যচিত্রঃ Pentagon, The Ruthless Conspirator, গবেষণা ও পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
২০০৩ রচিত বইঃ একজন রাজনৈতিক কর্মীর প্রতিচ্ছবি। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
তথ্যচিত্রঃ ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশঃ শোষণ, নৃশংসতা ও সাংস্ড়্গৃতিক মূলোৎপাটন-এর ইতিহাস। গবেষণা ও পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
২০০৪ সম্পাদিত বইঃ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
তথ্যচিত্রঃ ভূ-রাজনৈতিক সমরসজ্জা, ইসরাইল-এর আনবিক অস্ত্রসম্্ভার। গবেষণা ও পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। চিত্রনাট্য ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
সেমিনারঃ International Terrorism : Bangladesh Context- প্রবন্ধ পাঠঃ CM Shafi Sami আয়োজকঃ মোনায়েম সরকার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ।
২০০৬ ২০০৫ সালে শাহ এ এম এস কিবরিয়া গ্রেনেড হামলায় নিহত হওয়ার পর ২০০৬ সালে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কিবরিয়া স্মরণে মোনায়েম সরকার সম্পাদনা করেনঃ শামস কিবরিয়াঃ নিরন্তর প্রেরণা। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
তথ্যচিত্রঃ মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশ (২৩ খণ্ড)। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
তথ্যচিত্রঃ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
২০০৭ সম্পাদিত বইঃ যুক্তফ্রন্ট থেকে মহাজোট। প্রকাশক- নালন্দা।
সম্পাদিত বইঃ জেগে ওঠার এখনই সময়। প্রকাশক- নালন্দা।
রচিত বইঃ জাগো বাঙালি কোনঠে সবায়। প্রকাশক- নালন্দা।
সম্পাদিত বইঃ একবিংশ শতাব্দীতে মুজিবের প্রাসঙ্গিকতা। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ও আগামী প্রকাশনী।
সম্পাদিত বইঃ স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টঃ চুয়ান্নর অভিজ্ঞতা (চুয়ান্নর নির্বাচনের অপ্রকাশিত দলিল)। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
তথ্যচিত্রঃ ভাষা আন্দোলন। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
২০০৮ মোনায়েম সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জীবন ও রাজনীতি। প্রকাশক- বাংলা একাডেমি।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক শেখ হাসিনা বন্দি। তাঁর জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত। তাঁকে হত্যা করা হতে পারে বলে জোর গুজব। এমনি উৎকণ্ঠা নিয়ে মোনায়েম সরকার-এর ভারতে যাত্রা। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের সাথে যোগাযোগ। উৎকণ্ঠিত মোনায়েম সরকার শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিধানে এবং শেখ হাসিনার মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্ব জনমত গঠনে আইকে গুজরালের সহযোগিতা কামনা করেন।
রচিত বইঃ রাজনীতির চালচিত্র। প্রকাশক- নালন্দা।
তথ্যচিত্রঃ উদয়ের পথে। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
২০০৯ রচিত বইঃ বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণের সমস্যা ও সম্্ভাবনা। প্রকাশক- মিজান পাবলিসার্স।
রচিত বইঃ Left Democratic Humane World Order· প্রকাশক- মিজান পাবলিসার্স।
আশফাক-উল-আলম সম্পাদিত বইঃ মোনায়েম সরকারের নির্বাচিত রাজনৈতিক রচনা। প্রকাশক- নালন্দা।
সেমিনারঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। প্রবন্ধ পাঠঃ ড· মো· আনোয়ার হোসেন। আয়োজকঃ মোনায়েম সরকার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ।
সেমিনারঃ বিশ্ব শান্তির জন্য ন্যাটো বিলুপ্তি অপরিহার্য। প্রবন্ধ পাঠঃ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। আয়োজকঃ মোনায়েম সরকার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
তথ্যচিত্রঃ স্বাধিকার আন্দোলন। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
তথ্যচিত্রঃ ’৬৯-এর গণঅভুøত্থান। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
তথ্যচিত্রঃ নির্বাচনী আন্দোলন। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
তথ্যচিত্রঃ অসহযোগ আন্দোলন। গবেষণাঃ ড· রফিকুল ইসলাম। পরিকল্পনাঃ মোনায়েম সরকার। গ্রন্থনা ও পরিচালনাঃ বাবুল বিশ্বাস।
২০১০ ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় এবং পরাজয়ের সকল দায় নিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনের দীর্ঘ ১০ বছর পর রাষ্ট্রপতি ভবনে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ।
রচিত বইঃ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারঃ গণজাগরণই হবে নিয়ামক শক্তি।
রচিত বইঃUnited Nations & Global Crises· প্রকাশক- ঝিনুক প্রকাশনী।
সম্পাদিত বইঃ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
রচিত বইঃ বাঙালির ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ। প্রকাশক- বিউটি বুক হাউজ।
রচিত বইঃ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। প্রকাশক- শিখা প্রকাশনী।
রচিত বইঃ প্রবন্ধ সমগ্র-১। প্রকাশক- শোভা প্রকাশ।
সেমিনারঃ দিন বদলের অঙ্গীকারের আলোকে বাংলাদেশের বিদেশনীতি। প্রবন্ধ পাঠঃ ফারুক চৌধুরী। আয়োজকঃ মোনায়েম সরকার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ।
২০১১ রচিত বইঃ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও শেখ হাসিনা। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
রচিত বইঃ বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতির সংকট ও সম্্ভাবনা। প্রকাশক- নিউ শিখা প্রকাশনী।
সম্পাদিত বইঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (যৌথভাবে)। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
সেমিনারঃ বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির অন্বেষায় বঙ্গবন্ধু- প্রবন্ধ পাঠঃ ড· মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। আয়োজকঃ মোনায়েম সরকার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ।
সেমিনারঃ Microcredit : A Panacea or A Villain. প্রবন্ধ পাঠঃ Qazi Kholiquzzaman Ahmad আয়োজকঃ মোনায়েম সরকার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ।
২০১২ সম্পাদিত বইঃ বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ও আগামী প্রকাশনী।
সম্পাদিত বইঃ কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা (যৌথভাবে)। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ও আগামী প্রকাশনী।
রচিত বইঃ সময় গেলে সাধন হবে না। প্রকাশক- আলেয়া বুক ডিপো।
সম্পাদিত বইঃ শ্রেষ্ঠ বাঙালি। প্রকাশক- বিশ্ব সাহিত্য ভবন।
রচিত বইঃ Global and Regional Crises প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ও আগামী প্রকাশনী।
রচিত বইঃ বাংলাদেশের সমাজ প্রগতির ধারা। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
২০১৩ বিভুরঞ্জন সরকার সম্পাদিত বইঃ মোনায়েম সরকার যখন নির্বাসনে। প্রকাশক- বিশ্বসাহিত্য ভবন।
সঞ্চিতা রচিত বইঃ মোনায়েম সরকারঃ বাংলাদেশের রাজনীতির নেপথ্যকর্মী। প্রকাশক- বিশ্বসাহিত্য ভবন।
রচিত বইঃ মোনায়েম সরকারের নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ। প্রকাশক- বিশ্বসাহিত্য ভবন।
রচিত বইঃ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দিতে চাই। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
রচিত বইঃ বিএনপি-কে কেন ভোট দেবো না। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধু শীর্ষক গবেষণাকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত ফেলোশিপ অর্জন।
২০১৪ রচিত বইঃ একাত্তরের চেতনায় জেগে ওঠার সময়। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
রচিত বইঃ আত্মজৈবনিক। প্রকাশক – ভাষাচিত্র।
রচিত বইঃ বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু। প্রকাশক – ভাষাচিত্র।
সম্পাদিত বইঃ হাজার বছরের বাংলা গান। প্রকাশক- বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
সম্পাদিত বইঃ একবিংশ শতাব্দীতে শেখ মুজিবের প্রাসঙ্গিকতা। প্রকাশক- আগামী প্রকাশনী।
২০১৫ রচিত বইঃ বর্ধিত সংস্ড়্গরণঃ আত্মজৈবনিক। প্রকাশক – ভাষাচিত্র।
সম্পাদিত বইঃ মুজিব মানে মুক্তি। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতাসংকলন। প্রকাশক – পারিজাত প্রকাশনী।
তথ্যসংগ্রহ ও বিন্যাসঃ বাবুল বিশ্বাস
Leave a Reply