List

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা
ড· মো· আনোয়ার হোসেন

১৯৭০-এর নির্বাচনের পর গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষ তাদের রায় দিয়েছে এবং সে রায় তারা সোজাসুজি, স্পষ্ট ও নির্ধারকভাবেই দিয়েছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত, সুশিল সমাজ, সমাজের মান্যজন, নীতি-প্রণেতা, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, সশস্ত্র বাহিনী-আমলাতন্ত্র-গোয়েন্দা সংস্থার কর্ণধারেরা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিদেশী কুটনীতিক এবং খোদ ডান-বাম-মধ্য পন্থার রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিক – এদের সকল হিসেব, অংক এবং ভবিষ্যতবাণীকে ভুল প্রমাণ করে দেশের লাঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ তাদের একান্ত নিজস্ব ভাবনা ও বিবেচনায় এক নীরব ব্যালট বিপ্লবে তাদের নির্ধারক রায়টি দিয়ে দিয়েছে।
নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য চিরচেনা কৌশল যেমন কালো টাকার বেসাতি, ইসলামী জুজু, ভারত ভীতি এবং নির্জলা মিথ্যাচার এবারেও কম ব্যবহৃত হয়নি। নির্বাচকে বানচাল করা অথবা যথাসময়ে তা না হতে দেয়ার জন্য কম ষড়যন্ত্র করেনি চিরচেনা সিভিল-মিলিটারী বুরোক্রেসী এবং বিশেষ সংস্থা। কিন্তু ১৯৭০-এর বঙ্গবন্ধুর মতো ২০০৮-এর ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সময়োচিত সাহসী পদক্ষেপে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষ দৃঢ়বদ্ধ থেকে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্রের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো নারী-পুরুষ এবং নতুন ভোটারদের এক শান্ত, অনমনীয় এবং আশ্চর্য দৃঢ়তার কাছে সব অপকৌশলই ব্যর্থ হয়ে গেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্ধারক রায়ের পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত পলিমাটির বাংলাদেশের হাজার বছরের ভাগ্যহত মানুষ এমন এক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যা শৌর্যে বীর্যে এবং আপন স্বকীয়তায় গোটা ভারতবর্ষ উপ-মহাদেশে অনন্য। শস্য-শ্যামলা অপার সৌন্দয্যের মাতৃভূমিকে বিদেশী শাসক- শোষকদের হাত থেকে শুধু মুক্ত করা নয়, সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার যুগ যুগের প্রবল প্রত্যাশা এবং দুঃখ-বঞ্চনার চির অবসান ঘটিয়ে বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার সোনালী স্বপ্নকে বুকের গভীরে ধারণ করে প্রধাণত সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে অকাতরে জীবন দিয়েছে। সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি মাথা পেতে নিয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যবান এই অর্থে যে ঐ মুক্তিযুদ্ধে তারা জয়ী হয়েছিল এবং মাতৃভূমিকে একটি স্বাধীন দেশে পরিণত করতে পেরেছিল। এই সৌভাগ্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য এ কারণে যে এই পৃথিবীর আরও অনেক জাতি আছে, যাদের সে সৌভাগ্য হয়নি। ফিলিস্তিনি এবং কুর্দি জাতিদের কথা উল্লেখ করা যায়, যারা বহু বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও নিজ নিজ আবাসভূমিতে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। গাজা উপত্যকায় অল্প কিছুদিন আগেও গণহত্যা চলেছে। রক্ত ঝরেছে ফিলিস্তিনি শিশু-নারী-পুরুষদের। তাদের তুলনায় এমন অপার সৌভাগ্যের অধিকারী বাংলাদেশের মানুষের জীবনে হতাশা-বঞ্চনা-নিপীড়ন-অপমানের জগদ্দল পাথর চেপে বসলো কেন? মুক্তিযুদ্ধে যে চেতনা ও স্বপ্নকে বুকে ধারণ করেছে তারা তা ক্রমাগত গভীর নিরাশায় নিমজ্জিত হলো কেন? তার কারণ খুঁজে বের করা এবং বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে অর্জিত মহাবিজয়কে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের অপুরিত স্বপ্নপূরণের কাজে লাগানো যাবে তা অনুসন্ধান করাই হবে বক্ষমান কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতার উপজীব্য।
হাজার বছরের বাঙালির একান্ত নিজস্ব চিন্তা-চেতনার স্বার্থক পতাকাবাহী, আজীবন প্রগতিশীল বাঙালি, গণতন্ত্রকে ক্রমে আরও প্রসারমান, গভীর ও অর্থবহ করে তোলার সংগ্রামে নিরন্তর নিয়োজিত; অনুভবের, বিশ্বাসের শব্দ উচ্চারণে মৃদু কিন্তু প্রয়োগে, প্রভাবে তা থেকে গভীর কম্পনের সৃষ্টি যিনি করেছেন; এক আধুনিক, অনমনীয়, দৃঢ়চেতা, সত্যিকারের সুশিল মানুষের প্রতিচ্ছবি শহীদ কিবরিয়ার চিন্তা-ভাবনার মূল সুরটিকে ভিত্তি করে বক্তৃতাটি প্রণিত হবে। একটি ক্রমপ্রসারমান গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ যার মূল কথা।
১৯৫৪ এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি জনগোষ্ঠির নির্ধারক রায়ের ধারাবাহিকতায় সৌভাগ্যবান বাঙালি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ২০০৮-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায়ের ফলশ্রুতিতে কোন মহা অর্জন অপেক্ষা করছে দেশবাসীর জন্য; কিভাবে তা সম্্‌ভব হবে; রাষ্ট্রের নীতি প্রণেতা, সরকার-বিরোধী দল, সমাজের সকল শুভ শক্তিকে তা অর্জনে কি কি লক্ষ্য স্থীর করতে হবে তার রূপরেখা থাকবে এই বক্তৃতায়।
এই ভূমিকার পর ফিরে যাই ঐ বহু উচ্চারিত প্রশ্নের কাছে। “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্ন করেছেন। ভাগ্যবঞ্চিত মানুষ তা শুনেছে শুধু নয়, দিন বদলের জন্য, ভাগ্য বদলের জন্য তাঁর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এক টানে এঁকে ফেলা বাংলাদেশের মানচিত্র শুধু কাগজে নয়, লাল-সবুজের পতাকা আর সোনার বাংলাকে ভালবাসার জাতীয় সংগীতসহ স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। এ সবই বিশাল অর্জন। তারপরও মানুষের ভাগ্যাহত জীবনের দিন বদল হলোনা কেন? সোজাসুজি তার উত্তর হলো স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো পত্তনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি সে রাষ্ট্র গঠনে প্রাথমিক কাজগুলো আমরা শুরু করতে পারিনি। তার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। স্বৈর রাষ্ট্র দেশের মেহনতী উৎপাদক শ্রেনীর ভাগ্য বদলের জন্য কোন কাজ করেনি। গত ৩৭ বছর ধরে প্রতি ক্ষণ, দিন ও মাস বাংলাদেশের রাষ্ট্র তার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক যারা শ্রমে, ঘামে, আত্মত্যাগে দেশটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে – তাদের স্বার্থরক্ষা করেনি। করেছে সমাজের ঐ শোষক শ্রেনীর যারা সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে, ’৭১-এ স্বাধীন সোনার বাংলা কায়েমের লড়াইয়ে মানুষের প্রতিপক্ষ হয়েছে। ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যায়, কয়েক লক্ষ নারীর সম্্‌ভ্রম হরণে এবং সম্পদ ধ্বংসে পাকিস্তানী বাহিনীর দালাল, সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে, করেছে যুদ্ধাপরাধ।
এ কোন রাষ্ট্র? এটি হচ্ছে ঐ রাষ্ট্রকাঠামোর ধারাবাহিকতা যা বৃটিশ রাজ এবং তারপরে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্যবহার করেছে জনগণের উপর তাদের শাসন-শোষণ বজায় রাখতে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ অর্জনের জন্য জীবন দেয়নি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রতি নিয়ত উৎপাদনকারী নিপীড়িত মানুষ লড়াই করেছে গণবিরোধী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই নিরন্তর এই লড়াই চলছে। মার্কস যেমন বলেছেন, ‘অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে, অবিরাম লড়াই চালিয়েছে কখনও আড়ালে কখনও বা প্রকাশ্যে, যে লড়াই প্রতিবার শেষ হয়েছে গোটা সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনে অথবা দ্বন্দ্বরত শ্রেণীগুলোর সকলের ধ্বংস প্রাপ্তিতে’।
খৃস্টপূর্ব ৪০০০ শতাব্দীতে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর নিম্ন অববাহিকায় মানব সভ্যতার প্রথম নিদর্শন মেলে। প্রায় ২০০০ বছর ধরে চলা সুমেরিয় সভ্যতার এই কালে উৎপাদক মানুষেরা তৈরী করেছে চাকা, লাঙ্গল, লিখন পদ্ধতি। সময়কে তারা ভাগ করে ২৪ ঘন্টার দিন-রাত্রীতে এবং ঘন্টাকে মিনিটে। গড়ে তোলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন। খৃস্টপূর্ব ২০০০ শতাব্দীতে সুমেরিয় সভ্যতা বিলীন হয়ে যায় সেমেটিকদের সামরিক আধিপত্যে। পরপর আসা আসিরিয়, ব্যাবিলন, মিশরিয়, হরাপ্পা-মহেঞ্জদারো এবং কে জানে এই ঢাকার অদূরে উন্মোচিত উয়ারী-বটেশ্বর-এর নগর সভ্যতা ঐ সুমেরিয় সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
সভ্যতার সাথে জড়িয়ে আছে বেঁচে থাকার উপায়, জীবন যাত্রার পদ্ধতি, বসতির বিন্যাস, সরকাররের ধরণ, সামাজিক শ্রেণী বিন্যাস, অর্থপদ্ধতি, শিক্ষা এবং সংস্ড়্গৃতি এবং সবার উপরে রাষ্ট্রকাঠামো। সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ অস্তিত্বের জন্য সর্বপ্রথম নির্ভর করেছে কৃষির উপর। লাঙ্গল-এর ব্যবহার, সেচ, শষ্যের অদল-বদল চাষ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত শষ্য সভ্যতার প্রসারে সাহায্য করেছে। মৃৎ শিল্পী, কামার, পটুয়া, ধর্মযাজক ইত্যাদি নানা অকৃষিজ বৃত্তিতে মানুষ নিয়োজিত হয়েছে। সভ্যতার সাথে রাষ্ট্রের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাষ্ট্রের সাথে এসেছে শাসক শ্রেণীর কথা যারা মুখ্যত বাস করতো নগরে। কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতে।
শিকারী, চাষের সাথে সংযুক্ত মানুষ, উত্তরাধিকারসূত্রে নির্ধারিত শ্রেণী যেমন রাজা, অভিজাতবর্গ, মুক্ত প্রজা, ভূমিদাস এবং দাস – শ্রেণী বিভক্ত সমাজ হয়ে সভ্য সমাজের উৎপত্তি ঘটেছে জটিল সামাজিক বিন্যাস, সংগঠন ও সরকার পদ্ধতির সমন্বয়ে। সভ্যতার সাথে সম্পত্তি, কর ব্যবস্থা, শুল্ক, বাজার, ব্যবসা এবং পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে টাকার ব্যবহার এসেছে। বিধিবদ্ধ ধর্ম, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সভ্যতার ক্রমবিকাশে অবদান রেখেছে। এসেছে স্টিম ইঞ্জিনের আবিস্ড়্গারের হাত ধরে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতা। গতির ত্বরণের সূত্র অনুসরণ করে সভ্যতার বিকাশের গতি হয়েছে তীব্রতর।
গত শতাব্দীর ইলেকট্রনিক বিজ্ঞানের পর বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর প্রাণ প্রকৌশল এবং প্রাণ প্রযুক্তি ও তথ্য প্রযুক্তি এক অবিশ্বাস্য গতিতে চালিত করেছে মানব সভ্যতাকে। তার ছায়া পড়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে সেখানে। মানব সভ্যতার এই অভিযাত্রায় এসেছে গণতন্ত্রের ধারণা। খৃস্টপূর্ব সাড়ে চারশ বছর পূর্বে গ্রীসের নগর রাষ্ট্র বিশেষ করে এথেন্সে নাগরিকদের জনপ্রিয় সরকার হিসেবে গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে উঠতে দেখি আমরা। ভারতবর্ষে কি ঘটেছে? এ ভূখন্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষ পরিচয় দিয়েছে অগ্রবর্তি চিন্তার। বহু পরে বাংলা সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে – “আজ বাংলা যা চিন্তা করে ভারত তা করে আগামীকাল”- তা সত্য ছিল আজ থেকে প্রায় তেরশত বছর পূর্বে এই বাংলায়। গৌড়ের অধিপতি রাজা শশাঙ্কের মৃতুøর পর শতাব্দীব্যাপী বাংলায় হানাহানী, লুণ্ঠন, চরম বিশৃংখলা – মাৎস্যন্যায় অর্থাৎ বড় মাছ কর্তৃক ছোট মাছকে খেয়ে ফেলা – তা থেকে মুক্তির জন্য ৭৫০ খৃস্টাব্দে বাংলার মানুষ ভারতবর্ষ উপ-মহাদেশে সর্বপ্রথম বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে গণতান্তিকভাবে নির্বাচন করে সাধারণ নিম্ন শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করা গোপালকে। শুরু হয় পালদের গৌরবময় প্রায় চারশত বছরের শাসন।
নিতান্ত পরিতাপের বিষয় অগ্রসর চিন্তায় এবং তার অনুশীলনে সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশের মানুষ যারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করে তাদের গৌরবের ইতিহাসকে নিয়ে গিয়েছিল হিমালয়ের উচ্চতায় সেই দেশের মানুষকে স্বাধীনতা পরবর্তী ৩৭ বছরের মধ্যে প্রায় সাড়ে আটাশ বছর কাটাতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী স্বৈর সামরিক বা ছদ্মসামরিক শাসনের কঠিন নিগড়ে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণেই তা সম্্‌ভব হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নয়, প্রয়োজন ছিল ঐ রাষ্ট্রটির স্থলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা।
১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট-নিরপেক্ষ দেশসমূহের সম্মেলনে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস এবং ব্যক্তিত্বে এই মানুষটি হিমালয়সম। তাই তাঁকে দেখে আমার হিমালয় দেখা হয়ে গেছে।” বঙ্গবন্ধুকে তিনি আপন অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান থেকে পাওয়া রাষ্ট্র প্রশাসনকে ভেঙ্গে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে তা গড়ে তুলতে।
বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন তার ক্ষমা এবং মহত্বের দাম দেবে পরাজিত শক্তি। পরবর্তীতে বাংলার দূর্ভাগ্যের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় শত্রু-মিত্র সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ও ঔদার্যকে বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি কাজে লাগিয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে নিজেদের সংগঠিত করতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্্‌ভসমূহ – প্রশাসন, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ বিনির্মান করা হয়নি বলে এই প্রতিটি শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী শক্তি ক্রমাগত নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকে না যখন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালোরাত্রিতে সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজনদের নৃসংশতমভাবে হত্যা করছে তখন রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পদের মধ্যে শুধুমাত্র সেনা প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ ছাড়া বাকি ৮টিতে সমাসীন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের হয়ে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ। বঙ্গবন্ধুকে এবং তারপর জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করে। এরপর থেকে দীর্ঘ সামরিক শাসন বা বেসামরিক শাসনের আড়ালে সামরিক শাসনকালে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের কেন্দ্রসমূহে নিজেদের অবস্থান পাকা করতে থাকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন হয় যুদ্ধাপরাধীরা। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা পুরস্ড়্গৃত হয়। ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের দামে কেনা লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে যুদ্ধাপরাধীর রাষ্ট্রীয় গাড়ীতে। বিএনপি-জামাত জোটের দুঃশাসনে দেশে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বিএনপি-জামাত জোট আমলে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতি শক্তি এতই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, রাষ্ট্র শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণ ও হত্যাকাণ্ড এরা চালাতে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে ১০ ট্রাক অত্যাধুনিক অস্ত্র আনয়ন, ৬৩ জেলায় একযোগে ৫৭৩টি বোমা বিস্ফোরণসহ আরও নানা জায়গায় গ্রেনেড ও বোমা বিস্ফোরণ তারা ঘটায়। কবি জীবনানন্দের ‘অদ্‌ভুত আঁধারে’ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য হয় মহৎ সত্য বা রীতিতে বিশ্বাসী সংবেদনশীল মানুষ। নিহত হন শাহ এ এস এম কিবরিয়া, আহসানউল্লা মাস্টারসহ আরও কতজন। প্রকাশ্য দিবালোকে বাংলার মানুষের শেষ ভরসা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য তাঁর জনসভায় গ্রেনেড আক্রমন চলে রাষ্ট্রীয় সহায়তায়। দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের আত্মত্যাগে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন মানুষ। বাংলার জনপদে নেমে আসে তেরশত বছর পূর্বের মাৎস্যন্যায় অবস্থা। উপরে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনায় রাষ্ট্রের সবচাইতে শক্তিশালী সংস্থাসমূহের সংশ্লিষ্টতার নানা তথ্য বিভিন্নভাবে সচেতন দেশবাসীর নজরে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসবই হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-সমৃদ্ধ জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পত্তন না করার কারণে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আরো একবার ঘুরে দাড়িয়েছে। গত ৩৭ বছর ধরে গণবিরোধী রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের দেশের শাসক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আসাকে তারা মেনে নেয়নি। নির্বাচনের পরদিন তাঁর লেখায় আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী যথার্থ বলেছেন, “২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলার মানুষ একটি ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা প্রতিরোধ শক্তি হারায়নি ও সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পন করেনি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো, তাদের গাড়ীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো তারা মেনে নেয়নি। হাওয়া ভবনের সন্ত্রাস ও দুর্নীতি, দ্রব্যমূলের অসহ বোঝা দিনের পর দিন বহন, বিদুøৎ বিম্্‌ভ্রাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার ব্যবস্থা সর্বত্র অরাজকতা ও লুটপাট বিনা প্রতিবাদে চলতে থাকায় অনেকে মনে করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ বুঝি একেবারেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা ভুলে গিয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বরের একদিন আগেও গণবিরোধী চক্র ও জোট হয়তো টের পায়নি, বাংলার গণবিসুøভিয়াসের বুকে কত আগুন, কত ক্রোধের লাভা তৈরী হয়েছে। একদিনের এই অগ্নুৎগিরণে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মৌলবাদী চক্রান্তের ঘাঁটি মনে হয় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। প্রচুর টাকা ছড়িয়েও এবার জামায়াতিরা ভোট কিনতে পারেনি। ···দেশের কোন সরকার তাদের বিচার করেনি, শাস্তি দেয়নি। দেশের গণমানুষ তাদের বিচার করেছে।”
জনাব আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী এরপর ১০ জানুয়ারী, ২০০৯ তারিখে তাঁর লেখায় সাবধান বাণী উচ্চারণ করেন এভাবে – “পঞ্চাশের নির্বাচন ও সত্তরের নির্বাচন থেকে শেখ হাসিনার এই শিক্ষা নেওয়া উচিত যে, কেবল নির্বাচনে মহাবিজয়ের অধিকারী হলেই শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ পরাজিত হয়না। শক্রপক্ষ পশ্চাদপসরণ করে মাত্র। সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত যে গণবিরোধী শক্তি সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে মনে করা হয়েছিল, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তারা শক্তি সঞ্চয় করে তাদের পরাজয়কে জয়ে পরিণত করেছে।
২০০৮ সালেও মহাজোট যে ঐতিহাসিক নির্বাচন বিজয়ের অধিকারী হয়েছে, তাতে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শক্ররা সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি। তাদের সম্মুখভাগের রাজনৈতিক ফ্রন্টটি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে মাত্র। কিন্তু প্রশাসনে, আর্থ-সামাজিক অবস্থায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বত্র তাদের ঘাঁটি অভগ্ন ও অটুট। তারা দ্রুত সংগঠিত হবে, শক্তি সঞ্চয় করবে এবং পঁচাত্তরের মতো আবার ভয়াবহ আঘাত আনতে চাইবে।”
তেরশত বছর আগে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের শাসক বেছে নেয়ার যে রীতি বাংলার সাধারণ মানুষ শুরু করেছিল; যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য তারা বারবার লড়াই করেছে, কখনও বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে, কখনও দেশীয় স্বৈর সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে; রক্ত, অস্থি, মজ্জা, চেতনায় মিশে থাকা গণতান্ত্রিক শাসনের সে বোধকে কেউ হরণ করতে পারেনি। তাই আরও একবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দিন বদলের সনদের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে বাংলার গণমানুষ ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে বিশাল বিজয় এনে দিয়েছে। সাথে সাথে তারা অর্পণ করেছে বিশাল দায়িত্বের বোঝা। জনগণের সেই আস্থাকে পূর্ণ সম্মান দিয়ে, তাদের উপর ভরসা করে, তাদেরকে সাথে নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করে ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের স্বপ্ন পূরণে সাহসী, দৃঢ় এবং সুনিশ্চিত পদক্ষেপে এখন এগিয়ে যেতে হবে।
বক্তৃতার এই পর্বে সেসব লক্ষ্য এবং তা বাস্তবায়নের রূপরেখা সম্পর্কে বলবো।
দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং সন্ত্রাস দমন করে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে আসা বর্তমান সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দায়িত্ব। আমি নিশ্চিত যে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ একেবারে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতিকে সচল করতে গিয়ে দেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বারবার ফিরে তাকাবেন বাংলাদেশের সফল অর্থমন্ত্রী গণমানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে যিনি বাজেট প্রণয়নসহ তার সকল নীতি ও কৌশল ঠিক করেছিলেন সেই শহীদ কিবরিয়ার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ভাণ্ডারের দিকে। স্মারক বক্তৃতা প্রসঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম এ এস এম কিবরিয়ার সুযোগ্য সহধর্মিনী আসমা কিবরিয়া এবং তাদের আলোকিত পুত্র অফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান স্নাতক ও ডক্টরেট রেজা কিবরিয়ার সাথে। আসমা কিবরিয়া এবং রেজা কিবরিয়া এ এস এম কিবরিয়ার জীবন দর্শন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বারবার স্মরণ করেছিলেন দূর অতীত থেকে মৃতুøর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ঐসব কথা যা থেকে বাংলাদেশের অতি সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর আত্মিক টান এবং তাদের সংগ্রামী জীবনের নানা দিক সম্পর্কে তাঁর সহজবোধ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়তো তাদের চোখে। রেজা বলছিলেন, তার বয়স তখন আট। বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে ওয়াশিংটনের নিরপদ্রব, আয়েশী বাসস্থানে খাবার টেবিলে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে তার পিতা বলছেন তার নিভৃত গ্রামের জেলের কথা। ভাত খাওয়ার সময় যে তার কোমরের লুঙ্গির গিটে বাধা শুটকি মাছ বের করে শুকে নিয়ে খাবার শেষে আবার তা গিটবদ্ধ করে রাখতো। মেহনতী মানুষের কঠিন জীবন সংগ্রামের কথা যিনি বিস্মৃত হননি। এবং সে কারণে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রি হওয়ার পর সব সময় গরীব জনসাধারণের আয়কে ভাগ করেছেন মোটা চালের কেজি প্রতি দাম দিয়ে। আর তা থেকে মানুষের প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতা নির্ণয় করেছেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে শুধুমাত্র বাজারের উপর ছেড়ে না দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার জন্য গরিব হিতৈষী সুনির্দিষ্ট লক্ষধর্মী অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল তিনি প্রণয়ন করেছেন। দরীদ্র প্রবীণদের জন্য বয়স্ড়্গভাতা, অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা, দূঃস্থ, বিধবা ও পরিত্যক্তাদের জন্য অর্থ তহবিল, গরীবদের জন্য আশ্রায়ণ এবং নারীদের নামে তা বরাদ্দ, পে-কমিশনে প্রতি শ্রমিকদের পরিবারের সংখ্যা পাঁচ ধরে প্রত্যেকের জন্য গড়ে ২২০০ ক্যালরি সম্পন্ন খাদ্যের মূল্য ধরে বেতন কাঠামোর সুপারিশ তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৮ সালের দীর্ঘ প্রলম্বিত বিধ্বংসী বন্যা যার কারণে দুর্ভিক্ষে কোটি মানুষের প্রাণহানির আশংকা করেছিল আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ-সেই মহা দূর্যোগকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি মোকাবেলা করেছেন তাঁর দূঃস্থ-বান্ধব কর্মসূচি দিয়ে। ভিজিএফ কার্ড, বর্গা চাষিদের কৃষি ঋণের আওতায় আনা, সার-বিদুøৎ ও ডিজেলে উচ্চহারে ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণের ব্যাপক সম্প্রসারণ তেমনি কিছু সফল কর্মসূচি যা বাস্তবায়নের ফলে কোন প্রাণহানী ঘটেনি অনাহারে। সংগ্রামী কৃষককূল ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে এবং পরবর্তী কয়েক বছরে খাদ্যে ঘাটতি বাংলাদেশকে পরিণত করেছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে। প্রধানত কৃষিতে এই সাফল্যের কারণে আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনে দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদেরা অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করেন পৃথিবীর দরীদ্রতম একটি দেশে একই সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি যাত্রা।
ব্যালট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় সমাসীন শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালে তাঁর সরকারের এইসব গণমুখী কর্মসূচির আরও সম্প্রসারণ করবেন এবং তাদের ঘোষিত দিন বদলের সনদ আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বর্ণিত লক্ষসমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশে স্বৈর সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসনে যেভাবে অর্থ ব্যবস্থায় দূর্বৃত্তায়ন হয়েছে, কালো টাকার মালিক ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী জঙ্গী-জামাত চক্র তাদের বিশাল অর্থ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তার দুষ্ট খপ্পর থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রেখে অর্থনীতিতে গতিবেগ নিয়ে আসা সম্্‌ভব হবে না। তাই শুরু থেকেই এ বিষয়ে তৎপর হতে হবে। মন্ত্রীত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকে একাধিক মন্ত্রী সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ফেলা সম্পর্কে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন তা দ্রুত কাজে বাস্তবায়ন করতে হবে। জঙ্গী-জামায়েতি দুষ্টগ্রহের অর্থের উৎসসমূহ কেটে ফেলতে হবে। তার ফলে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতি ঐ রাহু থেকে মুক্তি পাবে, অন্যদিকে জঙ্গী তৎপরতা অর্থের জোগান বন্ধ হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়বে এবং শুকিয়ে মরে যাবে।
সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি অতি দ্রুত করতে হবে, তা হলো বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার কাজ দ্রুত শেষ করে দণ্ড কার্যকর এবং বিশেষ ট্রাইবুøনালে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করে দেয়া। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে ভোট বিপ্লবে নতুন ভোটাররা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিপুলভাবে ভোট দিয়েছে। স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর নতুন প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের এই নবচেতনার মূল্য দিতেই হবে। একই সাথে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, জঙ্গীদের সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ, আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ এ এস এম কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, একুশে আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড আক্রমনসহ সকল সন্ত্রাসী ঘটনার মূল উৎস, মদদদাতা, অর্থায়নের উৎস এবং বিশেষ করে এই প্রতিটি ঘটনার সাথে রাষ্ট্রীয় বিশেষ সংস্থার সংশ্লিষ্টতা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মহাজোট এবং এমনকি এককভাবে আওয়ামী লীগকে সংসদে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতিয়ে এনে বাংলার মেহনতি মানুষ আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও যা স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়নি তেমন কিছু মৌলিক বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সরকারকে গণরায় দিয়েছে। মুখ্যত এইসব নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো পত্তনের সূচনা হবে। তেমন কয়েকটি বিষয়ের উপর এবার আলোকপাত করবো।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পূনরায় বাংলাদেশকে নিয়ে আসতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের ফসল সংবিধানকে তার স্বমহিমায় পূণরুজ্জীবিত করা। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তি পবিত্র সংবিধানের গায়ে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনটিকে লাইনচুøত করেছে, তার নিরাময় হবে এবং দেশ ফিরে আসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। সেটিই হবে স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরের গণরায়ের সবচেয়ে বড় অর্জন। যাবতীয় সংশোধনী-মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের আবাসভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় প্রতিষ্ঠা করার সবল ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করবে। অগণতান্ত্রিক, মানবতাবিরোধী এবং মূল সংবিধানের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক সকল সংশোধনী থেকে সংবিধান মুক্ত হবে। এই সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গসমূহে গণতন্ত্রায়নের কাজগুলো গুরুত্বের সাথে শুরু করে দিতে হবে।
শুরুতেই প্রশাসন সম্পর্কে বলবো। পাকিস্তানী ধাচের প্রশাসনের স্থলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণপ্রশাসন গড়ে তোলার সুযোগ আমরা হারিয়েছি। তাই বর্তমান প্রশাসনে ব্যাপক সংস্ড়্গার সাধন করেই আমাদের এগুতে হবে। এক্ষেত্রে দৃঢ়তার সাথে যা করতে হবে তা হলো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অবস্থানকারী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ব্যক্তিদের অবিলম্বে অপসারণ করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাবান, দক্ষ, সাহসী এবং সৎ প্রশাসক দ্বারা সেসব জায়গা পূরণ করা। সংস্ড়্গারের নীতিগত অবস্থান হবে প্রশাসনের এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এই প্রশাসন জনগণের কাছে জবাবদিহিও নয়। টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায়ই নীতির কথা বলেন এমন একজন প্রাক্তন আমলা সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন যেন আমলা প্রশাসকদের দুদকের কাছে জবাবদিহি থাকতে না হয়। এক্ষেত্রে নীতি হবে অত্যন্ত পরিষ্ড়্গার। একদিকে প্রশাসনকে যেমন জবাবদিহি থাকতে হবে জনগণের কাছে, তেমনি প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, মেধা-যোগ্যতা-দক্ষতা এবং সর্বোপরি সততা হবে প্রশাসনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার একমাত্র মাপকাঠি। অন্যদিকে সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত। এর সাথে সংসদ এবং স্থানীয় সরকারসমূহকে শক্তিশালী করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যন্ত নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অর্থ দাঁড়াবে ঐসব সংস্থার নির্বাচিতদের হাতে উন্নয়নের অর্থ প্রদান করা। এক্ষেত্রে নারী কোটায় নির্বাচিতদেরকেও সমভাবে ক্ষমতাবান করতে হবে যার মধ্যে থাকবে উন্নয়নকাজে পুরুষদের মত অর্থ খরচের সম অধিকার। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইউনিয়ন পরিষদে নারী কোটায় সরাসরি ভোটে গ্রামীণ মহিলাদের নির্বাচন গ্রাম বাংলার নারীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দিপনার সৃষ্টি করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় গ্রামীণ উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদের পুরুষ সদস্যদের মত নারী সদস্যের হাতে গ্রামীণ প্রকল্পে অর্থ বণ্টনের অধিকার দেয়া হয়নি এই হাস্যকর যুক্তিতে যে, এসব কাজে নারীরা পুরুষদের সমকক্ষ নয়। বাস্তবে বিষয়টি ঠিক উল্টো। হাজার বছর ধরে নারীরাই অভাবী সংসারে সবচেয়ে সুচারুভাবে উপার্জিত আয় ব্যয় করে সংসারকে টিকিয়ে রেখেছে। বর্তমানেও ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় নারীরাই সবচাইতে দক্ষতার সাথে প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করে থাকে। তাই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার সময় অত্যন্ত সচেতনভাবে নারীর ক্ষমতায়নের কাজগুলো করে যেতে হবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত সৎ এবং দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। এই প্রতিষ্ঠানটি বিগত বিএনপি-জামাত জোট আমলে মুখ্যতঃ জামাত-বিএনপি দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগের সংস্থা হয়ে দাড়িয়েছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস সহ নানা গুরুতর অনিয়মের পাকে নিমজ্জিত সংবিধিবদ্ধ এই সংস্থাটির ব্যাপক সংস্ড়্গার করতে হবে। এর সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়বে প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ন এবং তার গণমুখী চরিত্র অর্জনের ক্ষেত্রে।
রাষ্ট্রের অপর শক্তিশালী স্তম্্‌ভ প্রতিরক্ষা বাহিনী যার মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী এবং সাহায্যকারী বাহিনী যেমন বিডিআর এবং সাম্প্রতিক সময়ে মহাশক্তিশালী হয়ে উঠা সেনা গোয়েন্দা সংস্থাও রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্ড়্গার সাধন করা। প্রতিরক্ষা বাহিনীর একমাত্র কাজ বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। যে প্রশ্ন খোদ সেনা বাহিনীসহ সচেতন দেশবাসীকে চিন্তিত করে, তা হলো বাংলাদেশের বর্তমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে কি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা সম্্‌ভব হবে? এবিষয়ে আলোকপাত করার জন্য সংক্ষেপে হলেও বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা প্রয়োজন।
১৯৭১ সালে যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভুøদয় ঘটেছিল তা কোন প্রচলিত যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ থাকে বলে মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলা হয়। জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি জনগণ-নির্ভর সেনাবাহিনী গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক হলেও তার বদলে আমরা পেয়েছি এমন একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী, যা বৃটিশ প্রবর্তিত এবং পাকিস্তান কর্তৃক ব্যবহৃত বাহিনীর হুবহু প্রতিরূপ। এর অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই নিহিত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া জনযুদ্ধ তথা গেরিলা যুদ্ধ কখনও বিকাশ পেতে পারে না। গেরিলা যুদ্ধের এই তাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে সামরিক নেতৃত্বের কোন ধারণাই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত সামরিক কাঠামোর অফিসারদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই ছিলেন যারা গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে সংগঠন করতে হয় সে সম্পর্কে কোন ধারণা রাখতেন। গেরিলা যুদ্ধের স্বাভাবিক বিকাশের পথে বড় বাধা ছিল এসব প্রচলিত অফিসার আর তাদের প্রচলিত সামরিক ভাবনা। এদের একমাত্র চিন্তা ছিল ভারতের মাটিতে নিরাপদ অবস্থানে থেকে কিভাবে একটি নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলে দেশের ভবিষ্যত প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নিজেদের ক্ষমতার ভিত পাকাপোক্ত করা যায়। মেজর জিয়া, মেজর শফিউল্লাহ এবং মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে তিন ব্রিগেড সুশিক্ষিত সৈন্য ছিল তাদের যদি ভারতের মাটিতে কেন্দ্রীভূত না রেখে জনগণের সাথে গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত করা হতো তাহলে সাত আট মাসের মধ্যেই দেশের মাটিতে ক্ষেত মজুর-কৃষক ও ছাত্রদের নিয়ে ২০ ডিভিশনের এক বিশাল গেরিলা বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যেত।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণ থেকে উঠে আসা এমন একটি বাহিনীই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারতো। বাস্তবে তা হয়নি। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা হয় ১৯৫২ সালের পাকিস্তান আর্মি অ্যাক্টের পুরোপুরি অনুসরণের মাধ্যমে, যা ইংরেজ প্রবর্তিত ১৯১১ সালের ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যাক্টের উত্তরাধিকার মাত্র। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর ক্ষেত্রে কেবল পাকিস্তান শব্দটি বাংলাদেশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
প্রচলিত এই প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে কেন্দ্রীভূত ব্যারাক আর্মি হিসেবে পরিচিত বিরাট এই বাহিনী দেশের উৎপাদন কর্মের সাথে তেমন জড়িত থাকে না বলে তার প্রতিপালনে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। গঠন কাঠামোর কারণে প্রতিরক্ষা বাহিনীর নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বময় কর্তৃত্ব অত্যন্ত ক্ষমতাধর অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের স্বচ্ছতা থাকে না এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর জবাবদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক কোন সুস্পষ্ট বাধা নিষেধ নেই বলে এমন হস্তক্ষেপের ক্ষতিকর ঘটনা ঘটে থাকে।
বাংলাদেশের অভুøদয়ের পর ঔপনিবেশিক ধাঁচের প্রচলিত প্রতিরক্ষা বাহিনীর স্থলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসিক্ত সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়নি। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান সেনা কাঠামো থেকে যে সমস্ত অফিসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তারা জনগণ-নির্ভর সেনাবাহিনীর ধারণা ও প্রয়োজনীয়তার সংগে একমত ছিলেন না। পরবর্তীকালে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আত্মীকৃত পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসারবৃন্দও পুরোনো আমলাতান্ত্রিক ব্যারাক আর্মির কাঠামোকে আরও পাকাপোক্ত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
সত্যিকার অর্থে দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে সচেতন জনগণ। বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত কর্তৃক তিনদিক থেকে পরিবেষ্টিত বিরাট জনগোষ্ঠী অধুøষিত দরিদ্র বাংলাদেশের জন্য তা আরও বেশী সত্য। বাংলাদেশে একটি ছোট আকারের স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করে তার মূল দায়িত্ব হতো দেশের কর্মক্ষম নর-নারীকে মৌলিক সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। পৃথিবীর বহু দেশে এই ব্যবস্থা চালু আছে। এভাবে সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে উঠতো। আমাদের ক্যান্টনমেন্টগুলো এক একটি সুশৃংখল শিক্ষায়তন হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো।
ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার মতো বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সর্বাত্মক কোন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত সামিল হতে হয়নি। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে এক দীর্ঘ এবং সীমাবদ্ধ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। দেশের অভ্যন্তরে এই যুদ্ধাবস্থা কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। শেষ পর্যন্ত গত শেখ হাসিনা সরকার আমলে যুদ্ধের বদলে শাস্তি চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য জাতিসত্তা সমস্যার বাস্তব সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। গৃহযুদ্ধ চলছে এমন কয়েকটি দেশে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সদস্যদের শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সরাসরি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না হলেও যুদ্ধপীড়িত মানুষের পূনর্বাসন এবং তাদের বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সহায়তা দানের মাধ্যমে শান্তিরক্ষী বাহিনীর ঐ সদস্যরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছেন। পরবর্তিতে দেশে ফিরে ঐসব শিক্ষা যে দেশের কাজে লেগেছে তার একটি উজ্জল নিদর্শন হলো একটি গ্রহনযোগ্য এবং প্রায় নির্ভুল ভোটার তালিকা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নে নির্বাচন কমিশন ও বেসামরিক প্রশাসনকে সক্রিয় সাহায্য করার সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে।
বাংলাদেশের মোট সীমান্তের বেশীর ভাগ ভারত দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিন-পূর্ব সীমান্তের অল্প কিছু অংশে রয়েছে মিয়ানমার। বাস্তব কারণেই পার্শ্ববর্তি এই দুটি দেশ থেকেই আমাদের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি হতে পারে। ভারতের বিশাল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দু’এক লাখ সৈন্যের প্রচলিত বাহিনী দিয়ে মোকাবেলা করার কথা দেশের প্রতিরক্ষা নীতি নির্ধারকরাও নিশ্চয়ই চিন্তা করেন না। অন্যদিকে স্থায়ী প্রচলিত বাহিনীর আধুনিকায়ন ও শক্তিবৃদ্ধি দ্বারা ভারতকে মোকাবেলা করার মতো প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অর্জনও বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে কখনই সম্্‌ভব হবে না।
তাহলে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কোন কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্্‌ভব নয়? দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়, তা অবশ্যই সম্্‌ভব। তার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণেতাদের এই নীতিগত সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, কার্যকর জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের জনগণভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদের থাকবেঃ
১· একটি ক্ষুদ্র এবং বিশেষায়িত স্থায়ী বাহিনী এবং
২· সুবিশাল জনগণের বাহিনী, যাতে শামিল হবে কয়েক কোটি সদস্য যারা দেশের উৎপাদনসহ সকল আর্ধ-সামাজিক কর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকবে।
মোট কথা, শিক্ষায়তন, কল-কারখানা, ক্ষেত-খামার, অফিস-আদালতসহ প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সকল সক্ষম নর-নারীকে মৌলিক সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করা হবে। স্থায়ী বাহিনীর অন্যতম কাজ হবে এই প্রশিক্ষণ প্রদান।
এই বিশাল উদ্যোগ গ্রহণ করা কি সম্্‌ভব হবে? এর জন্যতো প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এই অর্থব্যয়ের মাধ্যমে দেশ একটি কার্যকর জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে যাতে যুক্ত থাকবে দেশের জনশক্তির মূল অংশ। অন্যদিকে সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনুৎপাদনশীল প্রতিরক্ষা খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, স্থায়ী বাহিনীল আকার ধাপে ধাপে বহুগুণ ছোট হয়ে আসার ফলে তা থেকে সাশ্রয়কৃত অর্থ দিয়ে জনগণভিত্তিক বাহিনী গড়ে তোলা অসম্্‌ভব হবে না।
বিগত ৩৭ বছরে বাংলাদেশে যে ব্যাপক বিস্তৃত প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাঠামো গড়ে উঠেছে তার আকার স্বল্প সময়ে কমিয়ে আনা সম্্‌ভব হবে না। ১০ থেকে ১৫ বছর ব্যাপী এক দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমেই তা করতে হবে। এই সময়ে স্থায়ী সেনাবাহিনীতে নতুন নিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় রাখতে হবে। প্রাথমিকভাবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করা যায়। ধাপে ধাপে তা সম্প্রসারিত হবে গারমেন্টস সহ অন্যান্য কল-কারখানায়, অফিস-আদালতে এবং গ্রাম পর্যায়ে কর্মরত জনগণের মধ্যে। আমাদের সেনানিবাসগুলোতে গড়ে ওঠা সুযোগ-সুবিধা ও পরিকাঠামোসমূহকে ব্যবহার করা হবে বিভিন্নমূখী প্রশিক্ষন প্রদানের কাজে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্প ব্যবস্থার সঙ্গে থাকবে তাদের ওতপ্রোত সম্পর্ক। আমাদের সেনা সদস্যরা এসব কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। কালক্রমে এই সেনানিবাসগুলোই পরিণত হবে আদর্শ স্থানীয় উচ্চতর শিক্ষায়তনে। শুধুমাত্র দেশের নাগরিকবৃন্দ নয়, এসব বিশেষায়িত শিক্ষায়তনে প্রশিক্ষন নিতে আসবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষজন।
একটি সবল অর্থনীতি একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম পূর্বশর্ত। সবল অর্থনীতির জন্যই প্রয়োজন হয় মানব সম্পদের উন্নয়নের। জনগণ-নির্ভর জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি বাস্তবায়ন দ্বারা আমরা সেই অভিমুখে আমাদের মূল সামর্থøকে নিয়োজিত করতে পারবো। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্যবান ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দেশের জনগোষ্ঠি সত্যিকার অর্থেই দেশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে, কারণ একই সঙ্গে তাদের থাকবে ব্যাপক বিস্তৃত জনগণের বাহিনী। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে অস্ত্রের চাইতেও বড় শক্তি হিসেবে কাজ করবে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ সৃষ্ট একটি সবল ও টেকসই অর্থনীতি। সেই উদ্যোগে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে দেশ রক্ষা এবং দেশ গড়ার কাজে সবচেয়ে সুন্দরভাবে কাজে লাগাতে পারবে।
গণতান্ত্রিক শাসন ও বিধিব্যবস্থা জাতীয় প্রতিরক্ষার আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী সামরিক স্বৈর শাসকরা গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থাকে পদদলিত করে সামরিক শাসন কায়েম করে। এই সামরিক শাসন শেষ বিচারে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা শুধু বিঘ্নিতই করেনি, তাদের নিক্ষিপ্ত করেছে সীমাহীন দূর্দশা ও দুঃখ কষ্টে। প্রচলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গঠন কাঠামোর কারণে নানা অজুহাতে দেশের শাসন ব্যবস্থায় অনভিপ্রেত এইসব সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে থাকে। ফলে গণতন্ত্রের যাত্রা বাধাগ্রস্থ হয়। বাংলাদেশেও এই দুঃখজনক অধ্যায় আমরা একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছি। পাকিস্তানী ভাবধারায় গড়ে উঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করেছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায়। বিগত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনী এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থা দেশে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের অকেজো করে অনির্বাচিত, অসাংবিধানিক সরকার কায়েমের জন্য নানা চেষ্টা করেছে এবং দেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। ২০০৭ সালের আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উপর তাদের চণ্ডনীতি হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিপিড়নের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় হলো নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তারা ব্যাপক দূর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ আছে যে দামী গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি এবং বিশাল অঙ্কের অর্থের মালিক হয়েছে কিছু কিছু গোয়েন্দা এবং সেনা কর্মকর্তারা।
দেশে সামরিক শাসন বা দেশ শাসনে সেনা হস্তক্ষেপ ও তাদের লুটপাট বন্ধ করে গণতন্ত্রকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য কার্যকর শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের সংবিধানে ঐসব অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিধান সংযুক্ত করার সুযোগ জনগণ বর্তমান সরকারকে দিয়েছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য তাকে কার্যকরভাবে বেসামরিক সরকারের কর্তৃত্বে থাকতে হবে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিকে সক্রিয় করতে হবে। তবে সেনা গোয়েন্দা বিভাগসহ প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্পর্কে দ্রুত যা করা প্রয়োজন তা হল বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতি মনোভাবাপন্ন যারা গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিপথে চালিত করেছে, জঙ্গীদের মদত দিয়েছে, দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মস্মাৎ করেছে, তাদের সনাক্ত করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর রাজনৈতিক শাখাকে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের উচিত হবে দ্রুত তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাথে ডিজিএফআই-এর সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। মনে রাখতে হবে এই সংস্থাটি এ যাবৎকাল পর্যন্ত তাদের একমাত্র কাজ দেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ে মনোযোগী না হয়ে অশুভ হস্তক্ষেপ করেছে গণতান্ত্রিক শাসনে। ২৯ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনী রায়ের পর এর চির অবসান করতেই হবে। আমি নিশ্চিত যে প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিপুল সংখ্যাধিক্য অফিসার ও সিপাহীদের দৃঢ় সায় থাকবে এ ধরনের শুভ পদক্ষেপের পক্ষে। ক্যান্টনমেন্টে ডিজিএফআই-এর নির্যাতন কেন্দ্রে রিমান্ডে থাকা কালে আমি শুভ শক্তির সন্ধান পেয়েছিলাম এবং আমার জবানবন্দিতে তাদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছি।
বর্তমান বিশ্বে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি কোন গোপন বিষয় নয়। ইতিপূর্বে একটি স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে প্রতিরক্ষা নীতিকে সকল উন্মুক্ত আলোচনার বাইরে রাখা হতো। ইদানিংকালে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন মতামত পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সেনা কর্মকর্তারাও তাদের ভাবনা চিন্তা প্রকাশ করছেন। এসবই আশার কথা। গত দু’বছরে বেসামরিক সরকারের পেছনে থেকে মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর নীতি-নির্ধারকরা নিশ্চয়ই এই উপলব্ধীতে উপনিত হয়েছেন যে, জনগণের সমর্থনপুষ্ট গণতান্ত্রিক শাসন ছাড়া দুর্নীতি-সন্ত্রাস দমন বা সংস্ড়্গার কর্মসূচি কোনটাই সফল হবে না। উপর থেকে তাদের চাপিয়ে দেয়া এসব সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত নিদারুণ ব্যর্থতায়ই পর্যবশিত হয়েছে। তা থেকে সেনাবাহিনীসহ সকলকেই শিক্ষা নিতে হবে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অপর এক গুরুত্বপূর্ণ অংগ বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তনের এবং গণতান্ত্রিক শাসন ও বিধি-ব্যবস্থা সুসংহত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ হয়েছে। তবে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল জনগণ পায়নি। ডিজিএফআই-এর সরাসরি হস্তক্ষেপ বিচারকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত সকল পর্যায়ে বিচারক নিয়োগে চরম দলীয়করণ এবং বিশেষ করে শিবির করে আসা ও জামায়েতি মনোভাবাপন্নদের ব্যাপকভাবে বিচারক নিয়োগ করে বিচার-ব্যবস্থাটি জামায়াত-বিএনপির দলীয় ফোরামে পরিণত করা হয়েছে। সে কারণেই একজন প্রধান বিচারপতি যথার্থই উল্লেখ করেছিলেন- “বিচার ব্যবস্থায় প্রলয় ঘটে গেছে।”
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন এবং দেশে সংবিধান সম্মত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দলীয় নাগপাশ থেকে বিচার বিভাগকে উদ্ধার করা একটি জরুরী কর্তব্য হবে বর্তমান সরকার বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয়ের। তবে বিচারকে সাধারণ জনগণের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত করতে হলে আরও কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন হবে।
৮০-র দশকে জেনারেল এরশাদ বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা সংবিধানে বর্ণিত ‘ডকট্রিন অব বেসিক স্ট্রাকচার’-এর পরিপন্থী এ যুক্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন সূচিত হয়। সাথে সাথে একথাও সত্য যে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী স্বৈর সামরিক একনায়ক এরশাদের উদ্দেশ্য ছিল বিচার বিভাগে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্বৈর শাসন বিরোধী আন্দোলন যেখানে ঐক্যবদ্ধ আইনজীবি সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন, তাদের দুর্বল করা। সে কারণেও এরশাদের উদ্যোগে কোন সমর্থন মেলেনি।
কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে দেশে। বিচারকার্যের খরচ বহুলাংশে কমিয়ে আনা এবং বিচারকে জনগণের কাছে নিয়ে আসার জন্য প্রথমত নতুন করে বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল যা বিচার প্রত্যাশী সাধারণ মানুষ এবং আদালতের মাঝখানে বড় দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে তা অপসারণ প্রয়োজন। আমলাতন্ত্রের বাধা সম্পর্কে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, “পরিবেশের দূষণের কারণে কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ঝঁুকির মুখে পড়লে, তা নিরসনের জন্য বা ক্ষতিপূরণ লাভের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত ফরমে মহাপরিচালক বরাবরে আবেদন করতে পারবেন। মহা পরিচালক সন্তুষ্ট হলে এ বিষয়ে গণ শুনানির ব্যবস্থা করবেন এবং প্রয়োজনে অভিযোগকারীর পক্ষ হয়ে আদালতে মামলা করতে পারবেন”। এই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার লাভ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফাঁদে পড়ে। আর একথাতো সত্য যে, “বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা বিচার না পাওয়ারই সামিল”। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী যেন সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন তার বিধান করা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত মামলা তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্্‌ভব হবে যদি আদালত পুলিশের মাধ্যমে তদন্ত কাজ পরিচালিত হয়। বর্তমানে আইন-শৃংখলা রক্ষার্থে নিয়োজিত পুলিশ তাদের কাজের বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে মামলা তদন্তের কাজ এবং তদন্ত রিপোর্ট তৈরীর কাজ করে। এতে তাদের সুনির্দিষ্ট কাজে যেমন ব্যাঘাত ঘটে তেমনি তদন্তের কাজটি দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অভিযোগকারী। এক্ষেত্রে কোর্ট পুলিশের মাধ্যমে তদন্ত কাজ সমাধা করলে তাতে দীর্ঘসূত্রিতা কমবে এবং তদন্ত কাজে বিশেষায়িত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কোর্ট পুলিশ অনেক বেশী দক্ষতায় তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে পারবে। তদন্ত কাজে সহায়তা হিসেবেই শুধুমাত্র পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করতে পারে।
মোট কথা আদালতকে হতে হবে গণমুখী এবং কল্যাণধর্মী। ছোট হলেও একটি কাজ অবিলম্বেই করা প্রয়োজন। তা হলো আদালত কক্ষের পাশে বিচার প্রত্যাশীদের জন্য অপেক্ষা কক্ষের ব্যবস্থা করা। স্টেশন, হাসপাতালসহ সকল জায়গায় অপেক্ষমাণদের বসার ব্যবস্থা থাকলেও বিচারালয়ে সে ব্যবস্থা নেই। অবিলম্বেই তা চালু করা যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে শিক্ষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
২০০৫ সালে থমাস ফ্রিডমেন The World is flat: A Breif History of the twentyfirst Century পুস্তকটি রচনা করেন। এই পুস্তকে তিনি সভ্যতার বর্তমান সময়ে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। পুস্তকটি পশ্চিমা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটস দেখান এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি চীন, ভারত এবং আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহে কিভাবে ফ্রিডমেনের শিক্ষায় বিনিয়োগের বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকরা সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন এবং তা কিভাবে অর্থনীতিতে গতিবেগ সঞ্চারে ভূমিকা রাখছে। বিল গেটস দেখান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযু্‌ক্তি খাতে বিনিয়োগ থেকে সবচেয়ে দ্রুত ফল লাভ সম্্‌ভব এবং যে সমস্ত দেশ এই সত্যটি যত দ্রুত অনুধাবন করবে, সেই দেশ তত দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে সামনে।
বিপুল জন-সমর্থিত শেষ হাসিনার সরকার তাঁর বর্তমান দেশ শাসনের শুরু থেকেই এ বিষয়ে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবেন। বিশাল বিনিয়োগ ছাড়াও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ব্যাপক সংস্ড়্গার কার্যক্রমও তাঁর সরকারকে চালাতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট চরম দলীয়করণ ও দুর্নীতির দ্বারা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে, তা থেকে উদ্ধার লাভের জন্য ব্যাপক সংস্ড়্গার কর্মসূচি এবং বলিষ্ঠভাবে তা সম্পাদনের জন্য দক্ষ, যোগ্য, সৎ, নিষ্ঠাবান ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োজিত করতে হবে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে। শাস্তি প্রদান করতে হবে ঐ শীর্ষ পদাধিকারীদের যারা শিক্ষার মত মহান পেশায় যুক্ত থেকেও দুর্নীতি এবং অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন তার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার এই সংস্ড়্গার কর্মসূচি ও তার দ্রুত বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিয়ে করতেই হবে।
এই বক্তৃতা শেষ করার পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বলবো। গণতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত একটি অবাধ, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। জিয়া-এরশাদ স্বৈর সামরিক শাসকেরা রাষ্ট্র প্রশাসন যার মধ্যে বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্র এবং গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে- তাদের নির্বাচনী কারচুপিতে ব্যবহার করে নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করে দেয়। গণতন্ত্র চর্চার একটি মাত্র সুযোগ নির্বাচনে ভোট দেয়া যা ভোটারদের হাতে ছিল, তাও কেড়ে নেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াও নির্বাচনে সন্ত্রাস এবং কালো টাকার ব্যবহার সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে। সামরিক শাসকদের সৃষ্ট এই প্রহসনমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা বিএনপি-বেসামরিক সরকার অব্যাহত রাখে। মাগুরার উপ-নির্বাচনে এবং তারপরে ১৯৯৬ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ভোটারশুন্য একদলীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা সবার চোখে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলসমূহের ধারাবাহিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে একটি স্বচ্ছ, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।
২০০৫ সনের ৩১ জানুয়ারি সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভলপমেন্ট রিসার্চ’ আয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্ড়্গারের উপর নীতি নির্ধারণী বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল এ এস এম কিবরিয়ার। সে বক্তৃতা তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু ২৭ জানুয়ারি ঘাতকদের গ্রেনেড আক্রমণে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যায়, বক্তৃতা দেয়া হয় না। সে বক্তৃতা অবশ্য পরে অনুষ্ঠিত হয়েছে শহীদ কিবরিয়ার স্মরণ সভায়।Reform of the Caretaker Government শীর্ষক বক্তৃতায় শামস কিবরিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি দেখান কিভাবে একটি নির্বাচিত সরকার স্বৈর শাসকের গণবিরোধী চরিত্র ধারণ করে। কিভাবে নির্বাচনী পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে এমন নির্বাচিত সরকারের প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থা থেকেই একটি অনির্বাচিত, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং প্রচণ্ড আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বৈর দলীয় সরকারের নীল-নকশা ও কারচুপির নির্বাচন থেকে উদ্ধার লাভের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলেও সংবিধানের মৌলিক ধারণার সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সাংঘর্ষিক এ কারণে যে, এই ব্যবস্থায় একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দেয়া হয়।
শামস কিবরিয়া তাঁর ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্ড়্গার’ প্রবন্ধে দেখান, একেবারে শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনের মারাত্মক ত্রুটিসমূহ কিভাবে এই রক্ষা ব্যবস্থাটিকে অকার্যকর করে দিতে পারে। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের দক্ষ, নিরপেক্ষ এবং দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে ১৯৯৬ সনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও রাষ্ট্রপতির হাতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণসহ একচ্ছত্র ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় কিভাবে এক পর্যায়ে এমনকি ঐ নির্বাচনও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল, যখন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস সেনা প্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করেছিলেন। শুধুমাত্র প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের দৃঢ়তার কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সনের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্্‌ভব হয়। কিবরিয়া দেখান কিভাবে ২০০১ সনের নির্বাচনে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপি-জামাত জোটকে নির্বাচনে জয়ী করার জন্য চরম পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দূর্বলতাসমূহ পরিহার করার জন্য শামস কিবরিয়া সংস্ড়্গার পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরেন তার প্রবন্ধে। রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ঘাতকদের হাতে নিহত না হলে তিনি দেখে যেতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে তার আশংকা কত সত্য ছিল। কিভাবে বিএনপি-জামাত জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তাদের ক্রীড়নকে পরিণত করেছিল এবং তারপর কিভাবে একটি অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক সেনা চালিত সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান না করে দুই বছর স্বৈর শাসন চালিয়েছে।
শামস কিবরিয়া আজ বেঁচে থাকলে বলতেন, অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর প্রয়োজন নেই। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী এবং সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন করে দেশে অর্থবহ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের সংবিধানের পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে অন্যান্য অগণতান্ত্রিক সংশোধনী বাতিলের সাথে সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ত্রয়োদশ সংশোধনীটিও বিদায় নেবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথে তা হবে একটি অগ্র পদক্ষেপ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের ভাগ্যহত মানুষকে সোনার বাংলা কায়েমের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়নি বলে সে স্বপ্ন অপুরিতই রয়ে গেছে। আমরা হারিয়ে ফেলেছি বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোগী বহু নিবেদিত প্রাণ আলোকিত মানুষকে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী দু’হাজার বিশ এবং একুশ সালে উদযাপিত হবে। সেই সময়কে লক্ষ্য স্থির করে দিন বদলের সনদ প্রণয়ন করেছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থভাবে তরুণ প্রজন্ম যারা প্রথমবারের মত ভোটার হয়েছে, তাদের স্ড়্গন্ধে অর্পণ করেছেন দিন বদলের সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব। কালের সীমাবদ্ধতার জন্য এই প্রজন্ম ১৯৭১-এর গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মহা গৌরবের ও মহা সৌভাগ্যের বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ। তাহলো অনার্জিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করে অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করা। গণতান্ত্রিক সেই রাষ্ট্রটি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের ঘনীভূত রূপ। সেটিই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে তরুণ প্রজন্মকে সেই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং অগনিত শহীদ যাদের কাফেলায় একটি উজ্জ্বল নাম শাহ এ এস এম কিবরিয়া- তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হবে। ২০২১ সালের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করাই হবে বর্তমান প্রজন্মের ইতিহাস নির্দিষ্ট কতর্বø।
স্মারক বক্তৃতা শেষ করার আগে শহীদ শাহ এ এস এম কিবরিয়ার স্মৃতির প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই। জন নন্দিত বর্তমান সরকার তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সকল অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবেন এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের। “মানুষ রবে না যবে, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন”- প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতার এই চরণ উচ্চারণ করে বলবো বঙ্গবন্ধু, কিবরিয়া এবং লক্ষ শহীদের স্বপ্ন বেঁচে থাকবে এই বাংলায়, বাংলার মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
২৮ জানুয়ারি ২০০৯

 

বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ আয়োজিত কিবরিয়া স্মারক বক্তৃতা; ২৮ জানুয়ারি ২০০৯, বিকাল ৪ টায় শাহবাগস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে পঠিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 2 3 4 12
January 1st, 2019

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম মোনায়েম সরকার বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। একদিন এদেশের হাতে ছিল পরাধীনতার হাতকড়া। শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন ছিল এই […]

January 1st, 2019

যেসব কারণে আওয়ামী লীগের জয় অবশ্যম্ভাবী

যেসব কারণে আওয়ামী লীগের জয় অবশ্যম্ভাবী মোনায়েম সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কি হবে এটা নিয়ে এখনই নানা মনে […]

December 10th, 2018

ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ : কতিপয় বিপথগামী রাজনীতিকের অতীত-বর্তমান

ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ : কতিপয় বিপথগামী রাজনীতিকের অতীত-বর্তমান মোনায়েম সরকার পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনীতি আজ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। সবদেশে এখন […]

December 2nd, 2018

আওয়ামী লীগের বিজয় কেন জরুরি

আওয়ামী লীগের বিজয় কেন জরুরি মোনায়েম সরকার আমি একজন রাজনীতি-সচেতন নাগরিক এবং ভোটার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় […]

November 26th, 2018

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচিত করবেন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচিত করবেন মোনায়েম সরকার বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ২৩, চামেলীবাগ, ঢাকা-১২১৭ ফোন […]

November 11th, 2018

বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকুক

বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকুক মোনায়েম সরকার স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঞ্চাশের দশক ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা বিকাশের কাল আর ষাটের […]

November 1st, 2018

আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দিতে হবে

আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দিতে হবে মোনায়েম সরকার সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। […]

October 31st, 2018

ঐতিহাসিক রায়ে স্পষ্ট হলো বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল

কয়েকদিন আগে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন কোন পক্ষে যাবেন’Ñ শিরোনামে। যেখানে আমি নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখানোর চেষ্টা […]

October 31st, 2018

নিজেকে প্রশ্ন করুন কোন পক্ষে যাবেন

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলে পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশ ব্রিটিশ উপনিবেশের খপ্পর থেকে পাকিস্তানি উপনিবেশের খপ্পরে পড়ে। যেই মানুষটিকে […]

September 29th, 2018

মহাত্মা গান্ধী : শান্তিকামী মানুষের পথপ্রদর্শক

দৃষ্টি আকর্ষণ : মহত্মা গান্ধীর জন্মদিন উপলক্ষে [২ অক্টোবর,২০১৮] মহাত্মা গান্ধী : শান্তিকামী মানুষের পথপ্রদর্শক মোনায়েম সরকার পৃথিবী ক্রমে ক্রমেই […]