জেল থেকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে বঙ্গবন্ধুর
রাজনৈতিক ও মানবিক প্রতিভার াঁক্ষর মেলে
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘকাল ধরে যে কঠিন সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে াঁধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তা আজ এক শাশ্বত ইতিহাস। নেতা হিসাবে, ব্যক্তিমানুষ হিসাবে, পিতামাতার অনুগত সন্তান হিসাবে, দায়িত্বশীল াঁমী ও স্নেহবৎসল পিতা হিসাবে এক অসাধারণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও ছিলেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ সহচর প্রত্যক্ষদর্শীরা, খুব কাছে থেকে যারা তাকে দেখেছেন, তারা যেমন এ সত্য উপলব্ধি করেন যে কঠিনে-কোমলে এক ব্যতিক্রমী পৌরুষের অধিকারী ছিলেন তিনি, তেমনি বিভিন্ন সময়ে কারাগার থেকে স্ঁজনাপনসহ বিভিন্নজনকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠিপত্রেও সেই কঠিনে-কোমলে গড়া মানুষটির আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের আলো প্রতিফলিত হয়েছে।
ছাত্রজীবন থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত জীবনের এক দীর্ঘ সময় কেটেছে তার কারাগারে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকেরা বাঙালির মুক্তিকামী এই দৃঢ়চিত্ত মহান নেতাকে কখনো সহ্য করতে পারেনি। বার বার তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। এমনকি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার তরুণতম সদস্য শেখ মুজিবকে ওরা কারাগারে পুরেছিল মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে, দুর্নীতির মিথ্যে অজুহাতে। পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে জেল থেকে লেখা ১৯৫৮ সালের এক চিঠিতে এই দৃঢ়চিত্ত মানুষটির যে তীব্র অভিমান প্রকাশ পেয়েছে এ জাতির প্রতি, তা আজকের প্রেক্ষাপটে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পিতা শেখ লুৎফর রহমানের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে, আমি ঘুষ খেতে পারি, সে দেশে কোন কাজই করা উচিত না।’ আসলে দেশের মানুষ তো তাকে অবিশ্বাস করেনি, করেছিল পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকরা এবং ষড়যন্ত্র করে তাকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পুরেছিল। কি‘ দেশের মানুষের প্রতি তীব্র ভালোবাসা সাময়িক অভিমান ভুলিয়ে তাকে আবারও ফিরিয়ে এনেছিল রাজনীতিতে। জেল থেকে লেখা চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায় কী অসাধারণ ছিল তার ব্যক্তিত্ব। ১৯৫০ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জেল থেকে যে চিঠি লেখেন, সে চিঠির এক জায়গায় সেদিনের যুবনেতা শেখ মুজিব এক অসাধারণ উক্তি করেছিলেন। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠিতে তিনি লিখলেনঃ আই নো, দোজ হু প্রিপ্রেয়ার্ড টু ডাই ফর এনি কজ আর সেলডম ডিফিটেড। গ্রেট দিংস আর এচিভড থ্রু গ্রেট সেক্রিফাইস’। এই চিঠিতেই তার বই পড়ার যে নেশা, তারও সন্ধান মেলে। বই পড়ার জন্য কী আকুতি হলে অমন করে লিখতে পারেন বইয়ের কথা! স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে লেখা চিঠিতে (স্ত্রীকে তিনি ডাক নাম রেনু বলে সোঁধন করেছেন) এক হ্নদবান দায়িত্বশীল াঁমীর পরিচয় যেমন পাওয়া যায়, যেখানে জেলে থেকেও সন্তানদের ঈদে আনন্দ হয়নি বলে আক্ষেপ করেন, তেমনই সহকর্মী অনুজ প্রতিম তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা চিঠিতে এক বন্ধুবাৎসল্যপূর্ণ মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে প্রবাসে থাকা মেয়ে শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে পাওয়া যায় একজন মহৎ হ্নদয় স্নেহশীল পিতৃহ্নদয়ের পরিচয়। কি‘ জাতির চরম দুর্ভাগ্য, এমন এক মহৎপ্রাণ মানুষকে পাকিস্তানি ধর্মান্ধ সামরিক শাসকরা যাকে শত্রু মনে করত, মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করতো, তাকে তারই কঠিন সাধনায় সংগ্রামে আর নেতৃত্বে াঁধীনতা পাওয়া প্রিয় জন্মভূমি বাংলার মাটিতে হত্যা করল পাকিস্তানিদেরই এ দেশীয় দোসরা। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই বাঙালির মীর জাফরীয় বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু তারই শিকার হলেন। জীবন দিয়ে জীবনের আর জাতির ইতিহাসের সেই পরিচয় উৎকীর্ণ করে গেলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর চিঠিগুলো এই দুঃসময়ে একালের পাঠককে নিশ্চয়ই নতুন করে তাকে মূল্যায়নে সহায়তা করবে।
শেখ মুজিবুর রহমান
সিকিউরিটি প্রিজনার, ডিস্ট্রিক্ট জেল
ফরিদপুর, ইস্ট বেঙ্গল
২১·১২·৫০
জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেব,
আমার সালাম নিবেন। শুনে খুব খুশি হয়েছি যে, মওলানা সাহেব জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। হাইপ্রেসার এবং হ্নগরোগে ভুগছেন তিনি। গত নভেম্ঁরে আমাকে ঢাকা জেল থেকে গোপালগঞ্জ জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখান থেকে আবার ফরিদপুর জেলে নেয়া হয়। কারণ গোপালগঞ্জ সাব জেলে রাজবন্দীদের থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। কেসের প্রতি তারিখে আমাকে ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ কোর্টে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জে যেতে প্রায় ৬০ ঘণ্টা সময় লাগে এবং যাওয়া-আসা খুবই কষ্টকর। জানি না কতদিন চলবে এ অবস্থা। তবে আমি এসব তোয়াক্কা করি না। মি· আবদুস সালাম খান আমাকে দেখতে ফরিদপুর জেলে এসেছিলেন। তিনি আমার পিটিশনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। মি· সালামও গোপালগঞ্জ কেইসের একজন আসামি। পাকিস্তানের ইতিহাসে এটি প্রথম ঘটনা যে, পুলিশ মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারত মানুষকে লাঠিপেটা করেছে। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি জানি, মৃতুøর জন্য যারা প্র‘ত থাকে তারা খুব কমই পরাজিত হয়। বড় কিছু পেতে হলে বড় কিছু ছাড়তেও হয়। আল্লাহ যে কোন মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং আমি তার কাছে বিচার চাই।
আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে? আমি জানি খুব ব্যস্ততার মাঝে আপনার দিন কাটছে। মওলানা নিয়াজি, মি· গোলাম মোহাম্মদ খান, নওয়াবজাদা জুলফিকার এবং অন্যান্য বন্ধুদের সালাম দিবেন। আমার প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং স্নেহের কথা আমি সব সময় স্মরণ করি। দয়া করে তাদের বলবেন, সময় সুযোগ হলে আমি লাহোরে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করব। গত অক্টোবরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেটে যখন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনি বলেছিলেন, আমাকে কিছু বই পাঠাবেন। কি‘ আমি কোন বই পাইনি। আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, আমি একা নই, আমার সঙ্গে বই আছে এবং বইগুলো আমার এখন সবচেয়ে ভালো সঙ্গী। কোন রকম দিন কেটে যাচ্ছে। দয়া করে শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন নেবেন।
আপনার স্নেহের মুজিবুর
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ইংরেজিতে লেখা বঙ্গবন্ধুর বাজেয়াপ্ত চিঠির অনুবাদ রাজনৈতিক বন্দী
ঢাকা জেল
১২·১১·৫৮
আব্বা *
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লা আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কি‘ ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবো না।
যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোনো কাজই করা উচিত না। এদেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভাল ভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।
আপনার স্নেহের
মুজিব
NB গোপালগঞ্জের বাসাটা ভাড়া দিয়া দেবেন। বাসার আর দরকার হবে না। – মুজিব।
Source : Govt. of East Pakistan, Home Poll, F/N. 606-48 PF Part-9
* পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে লেখা বঙ্গবন্ধুর বাজেয়াপ্ত চিঠি।
রেনু,*
আমার ভালবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কত দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার কবে মুক্তি হবে তার কোন ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের াঁস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি এঁকে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট ওকে কিছুদিন পরে স্ড়্গুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকতে একটু কষ্ট প্রথম প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি-
তোমার মুজিব
সূত্রঃ জাতির জনক প্রকাশনায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ ২১০
* বেগম ফজিলতুন্নেছা মুজিবকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি।
ঢাকা জেল
১৯/৮/৬৬ (সিল)
স্নেহের তাজুদ্দিন *
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। কেমন আছ? খবর জানি না। আমাকে খবর দিও। চিন্তা করিও না। সকলকে ছালাম দিও। শরীরটা বেশী ভাল না তবে কেটে যাচ্ছে। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি –
তোমার মুজিব ভাই
Source : Govt. of East Pakistan, Home Poll, F/N. 606-48 PF Part-26
* আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদকে লেখা বঙ্গবন্ধুর বাজেয়াপ্ত চিঠি।
ঢাকা
১৩·৬·৬৯
হাছু মনি *
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। ওয়াজেদের চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তরও দিয়েছি বোধ হয় পেয়ে থাকবে। জেল হতে বের হয়ে তোমাকে ভাল করে দেখতেও পারি নাই। শুধু তোমার শরীরের দিকে চেয়ে তোমাকে যেতে দিয়েছি। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ওয়াজেদের শরীর কেমন। আমরা সকলেই ভাল আছি। চিন্তা করে শরীর নষ্ট করিও না। বোধ হয় শুনেছ মানিকভাই পিন্ডিতে হঠাৎ মারা গিয়েছেন। বুঝতেই পার আমার অবস্থা। প্রফেসর হাই সাহেবও মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন কৃতি সন্তান আমরা হারালাম। চিন্তা করিও না। সুইডেন খুব সুন্দর দেশ। তোমাদের খুব ভাল লাগবে। চিঠি দিও।
তোমার
আব্বা
সূত্রঃ জাতির জনক, প্রকাশনায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ ২১১
* ইতালি প্রবাসী কন্যা শেখ হাসিনাকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি।
রচনাকালঃ ০৫ আগস্ট, ২০০৯
প্রকাশকালঃ আজকের সূর্যোদয়, ০৮·০৮·২০০৯
Leave a Reply