List

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে একঝাঁক লড়াকু নেতার অংশগ্রহণে এই দলটির জন্ম হয়। দেখতে দেখতে বৃহৎ এই রাজনৈতিক দল ৬৮ বছর অতিক্রম করল। এই ৬৮ বছরে দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অনন্য নেতৃবৃন্দ। এখন এই দলের হাল ধরে আছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। যারা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে তাদের একমাত্র ভরসা আওয়ামী লীগই। বাংলাদেশের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগেরই ইতিহাস। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা শুধু অকল্পনীয় বিষয়ই নয়, অযৌক্তিকও। দারুণ এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই ভগ্নদশা থেকে দল ও দেশকে টেনে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে মডেল। বিগত আট বছরে বাংলাদেশে যে অসম্ভব উন্নয়ন হয়েছে আগামী দিনের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ ছিল একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। এই রাজনৈতিক প্লাটফর্ম পরে রূপ নেয় সাহসী রাজনৈতিক পার্টিতে। সূচনালগ্নে নেতা ও নীতিই ছিল এই দলের অমূল্য সম্পদ। এখন নেতা আছেন কিন্তু নীতির প্রশ্নে নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে। নীতির প্রশ্নে দলটি যদি অনড় ও অবিচল না থাকে, তাহলে এই পার্টি জনগণের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সমর্থন পেতে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। আগামী নির্বাচনে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে ৫১ শতাংশ ভোট ও ৫১ শতাংশ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশভাবে সরকার গঠন করতে হবে। অতীতে আওয়ামী লীগ যতবার সরকার গঠন করেছে, ততবারই কোনো না কোনো দলের কাঁধে তাকে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। অন্য দলের কাঁধে ভর দিয়ে নয়, নিজের পায়েই আওয়ামী লীগকে দাঁড়ানো শিখতে হবে। মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী সকল নেতাকর্মীকে এই জন্যে যার যার জায়গা থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।
আগামী নির্বাচন হবে এমন এক মুহূর্তে যখন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বর্ণযুগ পার করছে। এই যুগকে আরও দীর্ঘ করতে হলে তাকে আগামী নির্বাচনে কৌশলগত অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নির্বাচনপূর্ব সেই বার্তাও পেয়েছে দলীয় নেতাকর্মীরা ও দেশের সাধারণ মানুষ। যারা দুর্নীতিবাজ, লোভী, সুযোগসন্ধানী (হাইব্রিড) ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী এই নির্বাচনে তারা ঝরে পড়বে। অপরদিকে যারা বিনয়ী, ভদ্র, পরিশ্রমী তরুণ ও প্রগতিশীল, তাদের বেশি বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা পর্যালোচনা এবং দলটিকে জঞ্জালমুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি করাও এই নির্বাচনের অন্যতম লক্ষ্য বলেই আমরা মনে করি। আওয়ামী লীগ থেকে এবার যারা মনোনয়ন পেতে বঞ্চিত হবেন, এটা তাদের কর্মফলের কারণে হবেন। এমনকি যারা নতুন করে মনোনয়ন পাবেন, তারা তা কর্মফলের কারণেই পাবেন।
বর্তমান বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তা কল্পনারও বাইরে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি দেশে নেই। তাছাড়া দলটি গত আট বছরে বেশকিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকা- করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের আপেক্ষিক হার হ্রাস, আট বছর ধরে অব্যাহতভাবে ছয় ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা (বর্তমানে যা ৭.১১ শতাংশ), বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতার মুখেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন তথা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর প্রভৃতি সাফল্য আওয়ামী লীগকে দিয়েছে ব্যাপক গণভিত্তি। এর পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবেও বর্তমান সরকারের সাফল্য শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি কেড়েছে। ভারত-চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হলেও এই চারটি শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। এই কথাগুলো সাধারণ মানুষকে বারবার বোঝাতে হবে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যের হার এখন ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২.৪ শতাংশ। বর্তমানে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩১.৩২ বিলিয়ন ডলার। এই সরকারের আমলে দেশে-বিদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা, আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার, দুস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অসংখ্য সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ, উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সড়ক, নৌ, রেল, বিমানসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান সত্য।
পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে বানিয়েছিল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের কারখানা। সে সময় যেখানে-সেখানে বোমা হামলা হতো, এমনকি ৬৩টি জেলায়ও একসঙ্গে বোমা হামলার নজির রয়েছে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এ কথা মনে রাখা দরকার।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং আওয়ামী লীগের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা। যখনই বাংলাদেশের মাটিতে ঘাতকচক্র ও বিরোধী শিবিরের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত হয়েছে তখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম
অশান্তি কিংবা সামরিক থাবা। বাংলাদেশের জন্য লড়েছে আওয়ামী লীগ, বর্তমানে দেশও গড়ছে আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে স্বচ্ছ, সুন্দর ও আত্মসমীক্ষার মুখোমুখি হওয়া দরকার। দল এখন ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে কিন্তু পর্যবেক্ষণ শক্তি কমে। আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বে অতুলনীয় নেত্রী। আন্তর্জাতিক বহু সম্মাননা ও পদবি তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি একাই আওয়ামী লীগের ভার বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনা যতই ক্লিন ইমেজ তৈরি করুন না কেন যদি তার দলীয় লোকজন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, দলীয় নীতি বিসর্জন দিয়ে অবৈধভাবে মানুষকে হয়রানি করে, তাহলে সামনে ভরাডুবি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। অনেক নেতারই মাঠে জনপ্রিয়তা নেই, অনেকেই এলাকায় তেমন কোনো কাজ করছেন না, অনেকেই শুধু ধান্ধায় আছেন কীভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানাবেন ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হবেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিরুদ্ধেই সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আছে। কেউ কেউ শুধু নিজে নয়, পুত্র ও জামাতাকেও ব্যবহার করেছে দুর্নীতি করতে। এগুলো জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছায়। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এমনকি পৌরসভার নির্বাচনেও কোনো কোনো নেতা দলীয় প্রতীক নৌকা টাকার বিনিময়ে বিএনপি ও জামায়াতের লোকের হাতে তুলে দিয়েছে। এসব নির্বাচন বাণিজ্যে তারা লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দাপট লক্ষণীয়। তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কথাও মাঝে মাঝে প্রকাশ হচ্ছে পত্রিকায়।
এসব ব্যাপারে এখনই সচেতন হওয়া দরকার। তা না হলে আগামী নির্বাচনে দলের ভাগ্যে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আরও কন্ট্রোল করা দরকার। এদের বিরুদ্ধে মানুষের অনেক অভিযোগ রয়েছে। গত আট বছরে এই তিন সংগঠনের আটটি ভালো কাজের দৃষ্টান্ত আছে কিনা সন্দেহ। তবে তাদের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ তৈরি হয়েছে জনমনে। দলীয় শৃঙ্খলা যারা ভঙ্গ করবে, যারা দলের সুনাম-সুখ্যাতি নষ্ট করবে, তাদের দলে না রাখাই সমীচীন হবে। নির্বাচনের আগে মনোনয়ন দেওয়ার মুহূর্তে তাদেরই মনোনয়ন দিতে হবে, যাদের বিজয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ থাকবে না। এজন্য অবশ্য দলীয় প্রধানকে কঠোর হতে হবে। আমরা জানি তিনি অতটুকু কঠোর হওয়ার মানসিকতা পোষণ করেন।
ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্বের সেরা ৪৪টি বক্তৃতা নিয়ে জেকব এফ ফিল্ড যে বক্তৃতা সংকলন বের করেছেন, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা স্থান পেয়েছে। যা ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। জেকব তাঁর সংকলনের নাম দিয়েছিলেন চার্চিলের বক্তৃতার অংশ থেকে We shall fight on the Beaches (The speeches that inspired History)। সেই চার্চিলও পরবর্তী নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। আমাদের দেশেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথাও দলীয় নেতা-কর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সে কথা মনে রেখে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে দল ও সরকার পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘ তেইশ বছর সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে নিয়ে যেতে হবে। মৌলবাদী ও পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে মানুষের ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি এটাও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। এখন মানুষের মাঝে অনেক আশা তৈরি হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এজন্যই রাজপথে বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং জনশূন্য। কেউ আর অকারণে রাজনীতি নিয়ে ভাবছে না। এটা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। কিন্তু আগামী নির্বাচনে যদি কোনো কারণে বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার সব উন্নয়ন সূচক হারাবে ঠিকই, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই হবেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সব দিক সামাল দিয়ে এখন ঠান্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদকেও স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান সেখানে নিতে গেলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সঠিক ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
সবার মতো আমিও চাই, সৎ, যোগ্য, শিক্ষিত, জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের নির্বাচনী প্রার্থী হিসেবে স্থান দিতে হবে, সেই সাথে দলছুট, হাইব্রিড নেতাদের যথাসম্ভব পরীক্ষার ভেতর দিয়ে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের কথা মনে রাখা দরকার। সেই নির্বাচনে কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে ও বিএনপি-জামায়াতের আসন ভাগাভাগির চক্রান্তে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ভোট পেয়েও আসন সংখ্যায় হেরে ক্ষমতায় যেতে পারেনি।
এক সময় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। দলের অনেক নীতিনির্ধারণেরও অংশীদার ছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকলেও এটা ভুলে যাইনি, আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের নির্মাতা। আওয়ামী লীগের হাতেই বাংলাদেশ সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভার। আজ বঙ্গবন্ধুর পরে বিশ্বব্যাপী যে নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তার নাম ‘শেখ হাসিনা’। এ কথা আজ বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, দেশনায়ক বঙ্গবন্ধু ও দেশনায়ক শেখ হাসিনা দু-জনই আজ বিশ্ববরেণ্য। শুধু তা-ই নয়, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বঙ্গবন্ধুর পা ধরলেই সব অপরাধ ক্ষমা পেয়ে যেত, কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমা করেন বিচার-বিশ্লেষণ করে। কারণ বঙ্গবন্ধু ‘Was too good and gracious. It is dangerous to be for good.’
আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের বিএনপি ও জাতীয় পার্টি আঙুল ফুলে কলা গাছের মতো। প্রতি পার্টিই জন্ম হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে ও অন্ধকারে। তাদের পেছনে ছিল ক্ষমতার লোভ, নয়তো ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থতা। যার ফলে দেখা গেছে, সেসব পার্টি কিছুদিন ঢাকঢোল পেটালেও এক সময় ঠিকই নিস্তেজ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ থেকে ছুটে গিয়েও কেউ কেউ নতুন নতুন দল তৈরি করেছেন; নতুন পার্টির নেতা হয়ে পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য হলো, যেসব নেতা আওয়ামী লীগে থেকে এমপি-মন্ত্রী হতেন, রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন, তারা যখন নিজ নিজ দল গঠন করে নির্বাচন করতে লাগলেন, তখন তারা শুধু হারলেনই না, নির্বাচনে তাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।
এ থেকেই প্রমাণ হয়, আওয়ামী লীগ হলো বহতা নদীর মতো। এই বিশাল-বিপুল নদী থেকে দুই-এক ফোঁটা জল এদিক-সেদিক হলে নদীর অবয়বগত যেমন পরিবর্তন হয় না, তেমনি নদীর গতিপথও বদলায় না। বরং যে দুই-একটা ফোঁটা পানি এদিক-সেদিক হয়, তারাই কিছুদিন পরে শূন্যে মিলিয়ে যায়। উদাহরণ দিলে এমন দৃষ্টান্তের চারপাশে অভাব নেই।
আমরা জানি, বঙ্গীয় ভূখ-ে রাজনৈতিক দুরবস্থার অবসান ঘটাতে প্রথম যে দল জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়, তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর দল গঠিত হওয়ার মুহূর্তের আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এক নয়। সময়ের ব্যবধানের সঙ্গে সঙ্গে দলের অনেক কিছুই বদলেছে অথবা বদলাতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন পূর্ববঙ্গে গঠিত হয়, গঠনকালীন সময়েই তা বৃহৎ দল হিসাবে পরিচিত ছিল। আজকের বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সর্ববৃহৎ দল। কিন্তু এই সর্ববৃহৎ দলের ট্র্যাজেডিও অনেক বড়, অনেক বেশি নির্মম। ইতিহাসের অসংখ্য রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ঠিকই, তবে এজন্য আওয়ামী লীগের শরীর থেকেও কম রক্ত ঝরেনি। পৃথিবীর কোনো দেশের একটি রাজনৈতিক দল এত ভাঙাগড়া-দলন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে টিকে আছে কি না, তা আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের টিকে থাকার কারণ তার আদর্শবাদ, সাংগঠনিক শক্তি ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীবৃন্দ।
পরিশেষে মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইÑ আত্মকলহ ভুলে জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করুন। দল ক্ষমতায় থাকলে একদিন না একদিন আপনার মূল্যায়ন হবেইÑ সেদিন আপনি সুযোগ-সুবিধাও পাবেন। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা বিদ্বেষবশত দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি করে দলের সর্বনাশ করবেন না। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অবস্থা দেখে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সচেতন হওয়ার সময় এখনই। উল্লেখ্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ন্যাপকে ২০টি আসন দিতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু ন্যাপ ৪০টি আসন চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন নির্বাচনের পর দেখা যাবে। বর্তমানেও বামপন্থী ও প্রগতিশীল দলগুলি তাদের ভোটের সংখ্যা বুঝতে বার বার ভুল করছে। আপনারা সবাই মিলে ১৯৭০ সালের মতো নির্বাচনী জোয়ার তুলুন। তাহলে নৌকা যেমন বাঁচবেÑ বাঁচবে নৌকার মাঝি-মাল্লা ও বাংলাদেশ। এর ব্যত্যয় হলেই নেমে আসবে ভয়ঙ্কর বিপদ। আগাম বিপদের কথা ভেবে এখনই নৌকার পক্ষে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন।
১১ নভেম্বর, ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 3 4 5 12
September 29th, 2018

ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে কেন?

ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে কেন? মোনায়েম সরকার সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে অতি ধনীর […]

August 31st, 2018

জোট-ভোট ও আন্দোলনের আস্ফালন

জোট-ভোট ও আন্দোলনের আস্ফালন মোনায়েম সরকার বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তি থাকুক আর না থাকুক সবগুলো দলই জোট গঠনে ব্যস্ত হয়ে […]

August 27th, 2018

ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে আওয়ামী লীগকে উজান পথেই এগিয়ে যেতে হবে

ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে আওয়ামী লীগকে উজান পথেই এগিয়ে যেতে হবে মোনায়েম সরকার বঙ্গীয় ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দুরবস্থার অবসান ঘটাতে প্রথম যে […]

August 25th, 2018

আত্মপ্রচার নয়, মুজিব আদর্শ প্রচারে দৃষ্টি দিন

আত্মপ্রচার নয়, মুজিব আদর্শ প্রচারে দৃষ্টি দিন মোনায়েম সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি। তিনি শুধু বাংলাদেশের […]

July 19th, 2018

জোট ও ভোটের রাজনীতি

বর্তমানকালের রাজনীতিতে একটি বিষয় লক্ষণীয় তাহলো, সমমনা দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠন। জোট ছাড়া আজকাল ভোট হয় না বলেই মনে […]

July 15th, 2018

রাজনীতি ও ওল্ড ক্লাউনদের নির্বুদ্ধিতা

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে সকল প্রকার বাধাবিঘœ অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে। আজকের বাংলাদেশ আর অতীতের বাংলাদেশ এক […]

June 27th, 2018

’৭০-এ আওয়ামী লীগ শুধু অর্জনের বিবরণী নয়, আত্মসমালোচনাও দরকার

’৭০-এ আওয়ামী লীগ শুধু অর্জনের বিবরণী নয়, আত্মসমালোচনাও দরকার মোনায়েম সরকার বঙ্গীয় ইতিহাসে ২৩ জুন অন্তত দুটি কারণে বাঙালির মনে […]

June 27th, 2018

২৫ মার্চ, ১৯৭১ : অপারেশন সার্চ লাইটের অতর্কিত গণহত্যা

২৫ মার্চ, ১৯৭১ : অপারেশন সার্চ লাইটের অতর্কিত গণহত্যা মোনায়েম সরকার ২৪ মার্চ একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায়। সবাই বলাবলি […]

May 25th, 2018

অসম সরকারি নীতিমালার পরিণাম ক্ষোভ আর সর্বনাশ

বর্তমান সরকারের আমলে দেশ অনেক এগিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সাফল্যে এখনই তৃপ্তির ঢেঁকুর গেলা ঠিক হবে না। আমরা যদি […]

May 17th, 2018

Now Bangabandhu Shine like the Polestar in Space

After 47 years of existance Bangladesh has entered into a new era, launching successfully its first communication satellite Bangabandhu-1 to […]