List

এএইচএম কামারুজ্জামান বাংলাদেশের স্বনামধন্য পুরুষ। তার আসল নাম আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। ডাক নাম ‘হেনা’। হেনা নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে। ১৯২৩ সালের ২৬ জুন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার বাগাতিপাড়া থানার নূরপুর গ্রামে তার জন্ম হয়। নূরপুর গ্রামটি ছিল মালঞ্চী রেল স্টেশনের নিকটবর্তী। অনেকের মতো আমি এএইচএম কামারুজ্জামানকে ‘হেনা ভাই’ বলেই ডাকতাম। পারিবারিকভাবে হেনা ভাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতামহ হাজী লাল মোহাম্মদ সরদার (১৮৪৮-১৯৩৬) ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তার পিতা আবদুল হামিদ মিয়াও (১৮৮৭-১৯৭৬) বরেণ্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ-রাজনীতির এই ধারাক্রম রাজশাহীর সরদার পরিবারে চর্চিত ছিল, আজো সেই ধারা বহমান।
হেনা ভাই বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন বছরের ছোট ছিলেন। তবু তিনি বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন। হেনা ভাইকে আমি ঢাকা শহরে বেশ কয়েকবার দেখলেও তার সঙ্গে তেমন সখ্য গড়ে তোলার অবসর পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কলকাতায় ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কর্মকা-ে যোগ দিতে বেশ কয়েকটি যুব শিবির পরিদর্শন করি আমি। হেনা ভাই মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। সেই সুবাদে যুব শিবিরে যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে এবং আলাপ হয়েছে। তিনি খুব মিষ্টভাষী এবং সুবক্তা ছিলেন। তার বক্তব্য শুনলে মানুষ উজ্জীবিত হয়ে উঠতো। তিনি যখন কথা বলতেন তার সেই কথা অন্তর ছুঁয়ে যেতো।
হেনা ভাই পান খেতে ভীষণ পছন্দ করতেন। তিনি বিদেশে সফরে গেলেও তার জন্য প্লেনে করে পান পাঠানো হতো। একবার কথা প্রসঙ্গে তার পান খাওয়ার অভ্যাস কিভাবে হলো তা জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তার পান খাওয়ার অভ্যাস উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তার দাদা হাজী লাল মোহাম্মদ সরদার পান খেতে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় তার দাদা তার মুখ লাল করার জন্য হেনা ভাইয়ের মুখে পান তুলে দিতেন। সেই থেকে তার পান খাওয়া শুরু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পান খেয়ে গেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হয়ে হেনা ভাইকে মিনিস্টারের পদমর্যাদা দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করেন। এর আগে তিনি পাকিস্তান আমলে সমগ্র পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দলের সভাপতি হয়েও তার ভেতরে কখনো কোনো অহংকার দেখিনি, চিরদিনই তাকে হাসিমুখে কথা বলতে দেখেছি।
আমি তখন ন্যাপ করি। ন্যাপ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করি ‘সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক করা হয় আমাকে। পরিচালক হিসেবে কেন্দ্রের দেখাশুনা আমিই করতাম। কে ক্লাস নিবে, কি পড়ানো হবেÑ এসব কিছু মূলত আমিই ঠিক করে দিতাম। একদিন রাজশাহীর ন্যাপ নেতা অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান এলেন আমার কাছে। আতা ভাই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আতা ভাই বললেন, তোমাকে হেনা ভাইর কাছে যেতে হবে। তিনি তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি জন্য যেতে বলেছেন, আতা ভাই ঠিক মতো গুছিয়ে বলতে না পারলেও আমি বুঝতে পারলাম রাজনীতি বিষয়েই তিনি হয়তো আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আমি যেভাবে ছিলাম সেভাবেই হেনা ভাইর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। তখন আমার সঙ্গে সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের একটি ছাপানো সিলেবাস ছিল। আমাকে দেখেই হেনা ভাই বললেন, আসো, আসো, তোমাকেই আমি মনে মনে খুঁজছি। আমি বললাম, কি কারণে খুঁজছেন বলেন। হেনা ভাই বললেন, বঙ্গবন্ধু বিপদে ফেলে দিয়েছেন, তুমি আমাকে এবার উদ্ধার করো। বলেই তিনি একগাল মিষ্টি হাসি দিলেন। এরপর তিনি বললেন, জানো তো বঙ্গবন্ধু আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করেছেন। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। শুনলাম তুমি নাকি প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, তাই তোমাকে খুঁজে বের করেছি। এবার তুমি আমাকে প্রশিক্ষণ বিষয়ক সিলেবাসসহ অন্যান্য কাজের একটা ড্রাফট করে দাও। আমার হাতেই যেহেতু সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সিলেবাস ছিল তাই ওটাই তাকে আমি দিয়ে আসলাম। সিলেবাসটি পেয়ে হেনা ভাই সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ভেঙে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)’ প্রতিষ্ঠা করলে হেনা ভাই কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। তখন তিনি শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য যেমন হেনা ভাই সিলেবাস তৈরি করেন তেমনি বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হলেও তিনি আমাকে একদিন তার বাসায় ডেকে নেন। আমি গিয়ে হাজির হলাম। তিনি বললেন, আবার তোমার সাহায্য চাই। ‘কি সাহায্য লাগবে হেনা ভাই’Ñ বলতেই তিনি বললেন, বাকশালের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এই জন্য আবার নতুন করে প্রশিক্ষণ সিলেবাস তৈরি করতে হবে। আমি রাজি হলাম এবং তার হাতে বাকশালের প্রশিক্ষণ সিলেবাস তুলে দিলাম। তবে সেই সিলেবাসের ড্রাফট আমি একা করিনি, আরো দুই-একজনের সাহায্য নিয়ে ছিলাম। আমি নিজেও জাতীয় যুবলীগের সদস্য ছিলাম। তখন জাতীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ, এমপি। ২৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় যুবলীগের গর্বিত সদস্য হিসেবে সেদিন আমার ভেতরেও অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করেছিল।
পূর্বেই বলেছি হেনা ভাই একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার রক্তের ভেতরেই ছিলো রাজনীতির শিক্ষা। এরপর লেখাপড়া সূত্রে তিনি বেশ কিছুদিন চট্টগ্রামে ছিলেন। তখন চট্টগ্রাম ছিল অগ্নিগর্ভ শহর। সেই শহরে হেনা ভাই’র সময়েও মাস্টার দা সূর্যসেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারসহ সকলের নাম ছিল মুখে মুখে। বিপ্লবের সূতিকাগার চট্টগ্রামে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায় হেনা ভাই’র। চট্টগ্রাম-রাজশাহীর পাঠ চুকিয়ে তিনি লেখাপড়া করতে যান কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে গিয়েও তিনি অর্থনীতি শাস্ত্রে লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত করেন। দেশপ্রেম ও মানবতাবাদে দীক্ষা হেনা ভাই বাল্যকাল থেকেই পেয়েছিলেন। তাই দেশের দুঃসময় ও সুসময়Ñ দুই সময়ই তাকে মানুষের পাশে থাকতে দেখেছি। তার ভাবনাজুড়ে ছিলো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মঙ্গল যাতে হয় এই চিন্তাই তিনি সব সময় করতেন।
হেনা ভাইর সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। তিনি মন্ত্রী ছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তবু কোনোদিন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে রশিদ-ফারুক ঘাতকচক্রের চক্রান্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গভীর রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় হেনা ভাইকে। সেদিন তার সঙ্গে আরো হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত তিন অনুসারীকে। জাতীয় চারনেতা হত্যা অত্যন্ত নির্মম ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ’৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বর ট্র্যাজেডি চিরদিন কালো অক্ষরে লেখা থাকবে।
হেনা ভাই যদি কম্প্রোমাইজ করতেন তৎকালীন খলনায়ক খোন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে, তাহলে তিনি মন্ত্রী হতে পারতেন। আবার ফিরে পেতেন তার স্বাভাবিক জীবন, কিন্তু জেলবন্দি অন্যান্য নেতার মতো তিনি খলনায়কদের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এই জন্যই তাকে প্রথমে গুলি পরে বেয়নেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতক চক্র, তার নামে কোনো কুৎসা রটনা করা যায় কিনা, সেই ফন্দিও আটতে থাকে। মোশতাক সরকার অনেক তত্ত্ব-তালাশ করে তিনটি ব্যাংক একাউন্ট আবিষ্কার করেন হেনা ভাইয়ের। ওই তিনটি ব্যাংক একাউন্টে তখন মোট পাওয়া যায় পনেরো হাজার টাকা।
আমি নিজে বহুবার দেখেছি সততার মাপকাঠিতে হেনা ভাই আসলেই উচ্চমাপের ছিলেন। হেনা ভাইয়ের জীবনযাপন আসলেই অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয়। ও রকম মানুষ আজকের দিনের রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলতেন, ‘বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছিলেন। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তার অন্যতম চার সহচর, চারদিগন্তের চার আলোকস্তম্ভÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানও তাদের বুকের রক্ত ঢেলে জীবনে ও মরণে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে গেছেন।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 5 6 7 12
January 1st, 2018

১০ জানুয়ারি ’৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ […]

January 1st, 2018

প্রিয়তম বাংলা ভাষা চিরজীবী হোক

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর […]

December 11th, 2017

Bangladesh Entering ‘NUCLEAR CLUB’

Nuclear power plans Building a nuclear power plant in Bangladesh was proposed in 1961. Since then a number of reports […]

December 5th, 2017

বাংলাদেশ ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়

ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মাত্র নয় মাস সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি এত তাজা প্রাণ আর […]

November 21st, 2017

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধি

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃত দিয়ে তিনি যে ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন, এ […]

November 21st, 2017

এককভাবে সরকার গঠন করতে মুজিব-আদর্শের সৈনিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ […]

November 1st, 2017

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু প-িত সম্মান পান সর্বত্রÑ এমন একটি কথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কথাটি মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে […]

November 1st, 2017

খালেদা জিয়ার অতীত-ভুলই বর্তমানে কান্নার কারণ

পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললেই এখন খালেদা জিয়ার অশ্রুসজল ছবি দেখা যায়। এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার […]

October 8th, 2017

Cold War Past & Present

Mikhail Gorbachev’s perestroika of a decent standard of living for all Soviet People was misunderstood. This is the man who […]

October 5th, 2017

স্ব-ভূমে সসম্মানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন হোক

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্বের ভৌগোলিক বলয়। একদিন যেসব জাতিগোষ্ঠী বীরদর্পে পৃথিবীকে শাসন করতো, আজ তারা অনেকে নিজের […]