রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু প-িত সম্মান পান সর্বত্রÑ এমন একটি কথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কথাটি মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে এমন অনেক প-িত মানুষ আছেন যারা স্বদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিদেশের মাটিতেও সমান শ্রদ্ধেয় আর জনপ্রিয়। যে রাজার মনীষায় পা-িত্য যোগ হয় তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ব বরেণ্য, চিরনমস্য। এমন রাজা বা নেতার উদাহরণ হলেন প-িত জওহরলাল নেহরু, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটন, ভ. ই. লেলিন, নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু প্রমুখ।
এই মানুষগুলো শুধু নেতাই ছিলেন না, জ্ঞানী হিসাবেও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সংবেদনশীলতা তাদের কাল থেকে মহাকাল জয়ী করে তুলেছে। তারা জন্মেছিল কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূখ-ে কিন্তু লালন করতেন বিশ্বমানবতা, পৃথিবীর আর্ত ও পরাধীন মানুষের মুক্তির জন্য তাদের মন সবসময় বেদনাতুর হয়ে থাকত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও মুক্তিদাতা। একাধারে তিনি নেতা, মনীষী ও মানবতাবাদী কর্মী পুরুষ। পরাধীন বাঙালি জাতিকে তিনিই দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নই দেখাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিশ্ব সভায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন অসংখ্য ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু যে ভাষণ দিয়ে তিনি নিপীড়িত বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, সেটি হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ। এটি তিনি ঢাকার বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ৭ মার্চের ভাষণ দান কালে রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ লোক উপস্থিত হয়েছিল। মাত্র আঠারো মিনিটের জ্বালাময়ী ভাষণ শুধু সেদিনের মুক্তিপাগল মানুষকেই মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করেনিÑ মেজর জিয়া, মেজর শফিউল্লাহসহ, আর্মি, ইপিআর, পুলিশ অনেকেই বলেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল। তার ৭ মার্চের ভাষণ পরবর্তীতে নতুন প্রজন্মকেও দারুণভাবে নাড়া দেয়। এখনও তার ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে শৃঙ্খল ভাঙার প্রেরণা জোগায়। এ প্রসঙ্গে আমার দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। বর্তমান জাসদ নেতা মহীউদ্দীন খান বাদলের ছেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিল যে, সে তার বাবাকে (মহীউদ্দীন খান বাদলকে) বলেছিল, ‘বাবা তোমরা কি এই লোকটার বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন দল জাসদ করেছিলে? ‘আই হেট টু টক টু ইউ ফাদার’Ñ এ কথার সত্যতা কতটুকু তা জানার জন্য আমি বাদলের সাথে কথা বলে জেনেছি, ঘটনাটা সত্য। প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের লেখায়ও এই গল্পটি পড়েছিলাম।
আরেকটি ঘটনাও ঠিক একই রকমের। আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে আনান নামের এক কিশোর মাঝে মাঝে আসে। সে ভালোবেসে আমাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকে। একদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সে তার মাকে বলে, ‘মা জান বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমার রক্ত গরম হয়ে যায়; আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।’ যে ভাষণের সংগ্রামী বাণী নাবালক শিশুকেও আলোড়িত করে, সেই ভাষণ পরাধীন মানুষকে শেকল ভাঙার শক্তি জোগাবে এটাইতো স্বাভাবিক।
জ্যাকব এফ ফিল্ড ২০১৩ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে একটি বই প্রকাশ করেন ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস’ (ডব ংযধষষ ভরমযঃ ড়হ ঃযব ইবধপযবং) নামে। এই বইটির উপশিরোনাম হলো ‘ঞযব ংঢ়ববপযবং ঃযধঃ রহংঢ়রৎবফ যরংঃড়ৎু’. এই বইয়ে জ্যাকব এফ. ফিল্ড বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের ৪১টি ভাষণ সংকলিত করে ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ অব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বনেতৃবৃন্দের ঐতিহাসিক ভাষণগুলো এতে স্থান পেয়েছে। বইটির নামকরণ করা হয়েছে ১৯৪০ সালে প্রদত্ত উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত ভাষণের শিরোনাম অবলম্বনে। এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ এতগুলো ভাষায় অনূদিত হয়েছে কি-না, এই মুহূর্তে তা আমার জানা নেই। পৃথিবীর এতগুলো ভাষায় যে ভাষণ অনূদিত হতে পারে সে ভাষণের গুরুত্ব কতখানি তা সহেজই অনুমেয়।
৭ মার্চের সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু পুরো বাঙালি জাতির ইতিহাসকে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। একটি জাতির সমগ্র ইতিহাসকে ধারণ করে এমন আবেগময়ী ভাষা ও ভঙ্গিতে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভাষণ দিতে পারেননি। আমরা আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা বলি আর মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিমের’ কথাই বলি, পৃথিবীর কোনো নেতার ভাষণই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো এত আলোড়ন আর স্বাধীনতার স্বপ্ন তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এমন ইতিহাসসমৃদ্ধ কাব্যিক ভাষণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেওয়াই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে আর কোনো বাঙালির ভাষণ বিশ্ববাসীর এত মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। বঙ্গবন্ধুই সেই বাঙালি নেতা, যিনি একটি ভাষণেই একটি পরাধীন জাতিকে অমূল্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।
মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। যেগুলো একজন বাঙালির জন্য অত্যন্ত অহংকারের ও গর্বের। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি।
আজ আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ঐতিহাসিক সংগ্রাম ইউনেস্কো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় বিভূষিত। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে বঙ্গবন্ধু সোচ্চার ছিলেন এবং তিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তারই সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিগণিত হয়। বাংলাদেশের ষোলো কোটি বাঙালি ও পৃথিবীর বাংলাভাষী জনগণের পক্ষ থেকে আজ দাবি জানাতে চাইÑ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকেই ইউনেস্কোঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যে ভাষণ একটি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন জাতিতে পরিণত করেছে, যে ভাষণ বিশ্বের ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যে ভাষণ শুনে এখনও আবেগতাড়িত হয় অবুঝ কিশোররা, সে ভাষণ সংগত কারণেই ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অংশ হওয়ার দাবিদার। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বঐতিহ্যে স্থান পাওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। তাহলে আমাদের দেশ ও জাতি সম্মানিত হবে। মহিমান্বিত হবে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলা ভাষা ও সোনার বাংলাদেশ।
৪ মার্চ, ২০১৬
Leave a Reply