List

বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকুক

মোনায়েম সরকার
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঞ্চাশের দশক ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা বিকাশের কাল আর ষাটের দশক ছিল গণতন্ত্র অর্জন ও আইনের ভেতর দিয়ে জাতীয় চেতনা বহিঃপ্রকাশের প্রচেষ্টা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরূপতা এবং রবীন্দ্রবিরোধিতা যত প্রবল হয়েছে, ততই বাঙালিদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনাও জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালোভাবেই উন্মেষ ঘটতে থাকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার। স্বায়ত্তশাসনের জন্য ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং এর সমর্থনে ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকেন। পরবর্তীকালে ৬-দফা ছাত্র সমাজের ১১-দফার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ’৬৯-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবির অংশ হয়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যতই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করেছে, ততই বিরোধী দলগুলো অসাম্প্রদায়িক হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, আওয়ামী লীগ-আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে ১৯৪৯ সালে আবির্ভূত হয়। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর অভিজ্ঞতার আলোকেই ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির সমর্থন পাওয়ার পথ সুগম হয় এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
১৯৫২ কিংবা ১৯৪৮ থেকেই যে ভাষা আন্দোলন বিকশিত হতে শুরু করে তা মূলত বাঙালিদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্যÑ সেখানে ধর্মের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পরিবেশটা পুরোপুরি পাল্টে যায়। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের জনপ্রিয় আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্র। আর সময়ের ধারাবাহিকতায় যোগ হলো সমাজতন্ত্র। জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের পরিবর্তে এলো জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই অধ্যায়ের শেষ হলো।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি খুব দুঃখজনক রূপ ধারণ করে। উগ্র বামপন্থী স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্ট ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। প্রচ- সরকার-বিরোধী ভূমিকা নিয়ে তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও প্রকারান্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থানের পথ প্রস্তুত করে। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে নতুন দেশের সংবিধান প্রণীত হয় এবং ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দলসমূহের কোনো অস্তিত্ব বা অংশগ্রহণ ছিল না। নির্বাচনে সরকার প্রায় সব ক’টি আসনে জয়ী হয়। আর দ্বিতীয় বৃহৎ সংসদীয় গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাÑ তারা ১১টি আসনে জয়ী হয়। গোটা পাকিস্তান আমল জুড়েই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে পারেনি। তবে তারা প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তারা স্বনামে প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। ফলে স্বাধীনতার পর বাস্তব কারণেই কমিউনিস্ট পার্টির তেমন গণভিত্তি ছিল না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছেÑ এটা বলা যাবে না। একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলা-বারুদ বাইরে রয়ে গেল, অন্যদিকে জাসদ সৃষ্টি হওয়ার পর সরকার দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। জাসদ ছাড়াও অন্যান্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চীনপন্থী গোপন দলগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে বামপন্থী খোলসে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা খুব সহজ ব্যাপার হয়ে ওঠে। গোপন সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়তে থাকে। অসংখ্য থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা ও লুট করা হয়। বেশ কয়েকটি পাটের গুদামে আগুন ধরানো হয়।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতার সাথে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের উপর্যুপরি বন্যা এবং আমেরিকার ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতীয় দলের নাম ঘোষণা করেনÑ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ Ñ সংক্ষেপে ‘বাকশাল’। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। থানা লুটের সংখ্যাও কমে আসে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে যবনিকাপাত ঘটে বাকশালের এবং সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাধারণকারী রাজনৈতিক ধারার।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের মধ্যে অনৈক্যের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা হয় তার শিরোমণি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি পর্যায়ক্রমে সামরিক ফরমান বলে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করে জামায়াতসহ নিষিদ্ধ দলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারী, চীনপন্থী রাজনৈতিক দল, মুসলিম লীগসহ অন্যান্য ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
এটা ঠিক যে, প্রবণতার দিক থেকে ভাবতে গেলে এই প্রবণতা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ প্রথম ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। এ ছাড়াও ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর নাম ‘রেডিও পাকিস্তানের’ আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও তার প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন স্ব-মূর্তিতে আবির্ভূত হন, তখন নতুন উত্থিত রাজনৈতিক সরকারের রাজনীতি ও আদর্শ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি এতই প্রতিক্রিয়াশীল ও নেতিবাচক হয়ে ওঠে যে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের ভারতীয়দের এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা আমদানি করা হয়। যারা যত সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তারাই তত দেশপ্রেমিক। জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর রইলো না; জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠলো ‘বাংলাদেশী’ যা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’-এর নামান্তর। সমন্বয় ও সমঝোতার রাজনীতির নামে জিয়াউর রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী বানালেন একজন কুখ্যাত ‘রাজাকার’ শাহ আজিজুর রহমানকে ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমকে দেশে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের হত্যার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক ধারার সমাপ্তি না হয়ে বরং সেটাকে পুঁজি করে আজও তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’ শক্তি বেঁচে আছে। আর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রায় ৮ বছর দেশ শাসন করেন আরেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-কেই আদর্শ করে পথ চলেছেন। তবে এটা বলতে হয় যে, জিয়ার মতো তিনি ‘রাজাকার-পুনর্বাসন’ কর্মসূচি গ্রহণ না করলেও তাদের প্রতিপালনের কর্মসূচি তারও ছিল। নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে সামরিক ফরমান বলে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাথায় কুঠারাঘাত করেন এবং স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে রেখে যান। এরশাদ তার শাসনামলে জনভিত্তি বাড়ানোর জন্য বার বারই ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। এমনকি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বিভক্ত করার জন্য ১৯৯০ সালের নভেম্বরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বাঁধিয়েছেন।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে উগ্র-সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় দল জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে। সেটা হয়তো খানিকটা স্বাভাবিক ছিল, কেননা আদর্শিক দিক দিয়ে তারা একে অপরের অনেক কাছাকাছি। বিএনপি-জামায়াতের যৌথ রাজনীতি দেশে সাম্প্রদায়িক ও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাকে দুর্বল করার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদে নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৎপরতা শুরু করে।
২০০১ সালে এই দুই অপশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় বসার পর পরই পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাঠে নামে ‘বাংলা ভাই’। তারা রাজশাহীর বাগমারায় তা-ব সৃষ্টি করে এবং পরে তাদের ‘আন্দোলন’ দেশের তেষট্টিটি জেলায় পাঁচশত বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত চারদলীয় সরকার ‘বাংলা ভাই’ ও তার কথিত আধ্যাত্মিক গুরু শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। এক-এগারোর পর ফখরুদ্দিনের ‘বিশেষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর বাংলা ভাই ও তার গুরুর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়।
সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্য থেকেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার শেকড় গজানোর সহায়ক পরিবেশ থাকাটাই স্বাভাবিক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করলাম সেই দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আরো বিকাশ ঘটবে বলে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল। কারণ সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্র-দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এই ভূখ-ের জনগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সকল নাগরিক। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় অন্যতম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। অবশ্য এটাও ঠিক যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দেশের সব মানুষ রাতারাতি গ্রহণ করে ফেলার মতো বিষয় নয়। তাছাড়া দীর্ঘদিন দেশের মানুষ একটি ধর্মীয় আবহে বেড়ে উঠেছে, মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বঞ্চনাবোধ কাজ করায় তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে এক ধরনের ‘মাইন্ডসেট’ তৈরি হয়েছিল। হিন্দু ও ভারত বিরোধিতা ছিল যার বহিঃপ্রকাশ। সেখানে পরিবর্তন আনার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণ করা দরকার ছিল সেটা সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই করা হয়নি। দেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যখন ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির বিরোধিতা করেছে তখন বরং ধর্মের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে নানা যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থানের অভাবে তা কার্যকর হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করা না হলে দেশে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয়যাত্রা শুরু হতো না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র আমূল পরিবর্তন করে একটি তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র এগিয়ে যেতে পারতো না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে আমাদের আজও পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে হতো সেই পাঞ্জাবি সামরিক শাসকদের দ্বারা শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্যে। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা কি তা-ও আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। পাকিস্তান এখন একটি ল-ভ- দেশ। ধর্মের নাম করে মসজিদের ঢুকে নামাজরত মুসল্লিদেরও হত্যা করছে জঙ্গিরা। মানুষের জীবন সেখানে নিরাপদ নয়। ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য একেবারেই কল্যাণকর হতে পারে না, পাকিস্তান তার বড় উদাহরণ।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বার বার বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি দেশি-বিদেশি অপশক্তি রোধ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাঙালির লড়াকু মনোভাবের কারণে তারা তা পারেনি। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ কোনোদিনই বাঙালির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পারবে না। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এই নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত নেতাকর্মী ও দেশবিরোধী শক্তি যত কথাই বলুক না কেন, যত জোট-ফ্রন্ট তৈরি করুক না কেন, এই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনালালনকারী দল আওয়ামী লীগকে এককভাবে বিজয়ী করে বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অটুট রাখতে আজ আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১০ নভেম্বর, ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 5 6 7 12
January 1st, 2018

১০ জানুয়ারি ’৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ […]

January 1st, 2018

প্রিয়তম বাংলা ভাষা চিরজীবী হোক

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর […]

December 11th, 2017

Bangladesh Entering ‘NUCLEAR CLUB’

Nuclear power plans Building a nuclear power plant in Bangladesh was proposed in 1961. Since then a number of reports […]

December 5th, 2017

বাংলাদেশ ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়

ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মাত্র নয় মাস সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি এত তাজা প্রাণ আর […]

November 21st, 2017

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধি

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃত দিয়ে তিনি যে ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন, এ […]

November 21st, 2017

এককভাবে সরকার গঠন করতে মুজিব-আদর্শের সৈনিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ […]

November 1st, 2017

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু প-িত সম্মান পান সর্বত্রÑ এমন একটি কথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কথাটি মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে […]

November 1st, 2017

খালেদা জিয়ার অতীত-ভুলই বর্তমানে কান্নার কারণ

পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললেই এখন খালেদা জিয়ার অশ্রুসজল ছবি দেখা যায়। এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার […]

October 8th, 2017

Cold War Past & Present

Mikhail Gorbachev’s perestroika of a decent standard of living for all Soviet People was misunderstood. This is the man who […]

October 5th, 2017

স্ব-ভূমে সসম্মানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন হোক

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্বের ভৌগোলিক বলয়। একদিন যেসব জাতিগোষ্ঠী বীরদর্পে পৃথিবীকে শাসন করতো, আজ তারা অনেকে নিজের […]