List

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক

মোনায়েম সরকার
পুঁজিবাদ ও সাম্ররাজ্যবাদ রাজনৈতিক দর্শনের দুটো বিপদজনক শব্দ। এই শব্দ দুটিই পৃথিবীতে অনাসৃষ্টির মূল কারণ। পুঁজিবাদী ও সাম্ররাজ্যবাদীরা পুঁজির বিকাশ-বৃদ্ধি এবং সাম্ররাজ্যসম্প্রসারণের জন্য এমন কোনো ফন্দি-ফিকির নেই যে না করতে পারে। তারা নিজেদের স্বার্থে দিনকে রাত করতে পারে। বন্ধুকে শত্রুতে পরিণত করে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারে, ধার্মিকের গায়ে পরিয়ে দিতে পারে জঙ্গির আলখাল্লা। যদি আমরা মোহের চশমা খুলে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে এই মুহূর্তের পৃথিবীকে এক পলক অবলোকন করি, তাহলে দেখবোÑ বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষমতাধর পুঁজিবাদী ও সাম্ররাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো এখন এই কাজগুলোই অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে করে বেড়াচ্ছে।
আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ কেন যুদ্ধবাজ হবে এই প্রশ্ন অনেকের মতো আমাকেও তাড়া করে। যুদ্ধ জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে, জীবনকে বিপন্ন করে তোলে, সভ্যতার জন্য রচনা করে কলঙ্কের মহাকাব্য। এতসব বুঝেও মানুষ কেন যুদ্ধ-উন্মত্ত হয়ে উঠছে অনেকেই এই হিসাব মেলাতে পারছে না। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বারবার বলার চেষ্টা করছেÑ ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই’, কিন্তু সেই শান্তির বাণী যেন কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। পৃথিবীর চারদিকেই আজ শোনা যাচ্ছে মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি। মারণাস্ত্রই মানুষের জন্য এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো বিক্রির জন্য হন্যে হয়ে উঠছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। জঙ্গিবাদ মূলত যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে ও হচ্ছে। এই বিষয়টি বুঝতে না পেরে জঙ্গিদের উপর দোষারোপ করে মূল সমস্যা সমাধান করা যাবে না।
বর্তমান সময়ে জঙ্গিবাদ বিশ্ববাসীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলোÑ ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি বিশেষ কোনো ধর্মীয় মতবাদ না হলেও জঙ্গিবাদের সকল দায়দায়িত্বই এসে পড়ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঘাড়ে। ব্যাপার যেন এমন ‘জঙ্গি’ মানেই মুসলমান, ‘জঙ্গি’ মানেই মৌলবাদী, ইসলাম ধর্মের অনুসারী। কিন্তু এখানে দারুণ একটি চালাকি আছে বলেই আমার মনে হয়। ইসলাম ধর্ম নতুন কোনো ধর্মীয় মতবাদ নয়। প্রায় পনেরো শত বছর হতে চলল এই ধর্ম পৃথিবীতে টিকে আছে। এতদিনের একটি প্রাচীন ধর্মের হঠাৎ করে এমন কী সমস্যা হলো যে এই ধর্মের অনুসারীরা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে গেল? এমন কী মৌলিক পরিবর্তন হলো এই ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভেÑ যার ফলে এরা উগ্রবাদিতায় দীক্ষিত হতে বাধ্য হলো? মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ, মানবপ্রেমিক যিশু খ্রিস্টের চেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.) কোনো অংশেই কম মানবপ্রেমিক ছিলেন না। সেই হযরত মুহাম্মদের অনুসারীরা ও অনুগামীরা এমন করে জঙ্গি হয়ে উঠছে কেন বিষয়টি তলিয়ে দেখা আবশ্যক বলেই মনে হয়।
এক সময় আল-কায়েদা বিশ্বের শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন ছিল। এখন আর আল-কায়েদার নাম খুব একটা শোনা যায় না। বিশ্বের মানুষ আজ বুঝতে পারছে আল-কায়েদা ধর্মীয় কারণে সৃষ্টি হয়নি। আল-কায়েদাকে মার্কিনরা সৃষ্টি করেছিল মুসলমানদের শায়েস্তা করার জন্য এবং আল-কায়েদার পিঠে সওয়ার হয়ে মার্কিনরা কম খেলা খেলেনি। এই আল-কায়েদা দিয়েই তারা আফগানিস্তানকে ধ্বংস করেছে, সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে ঝুলানোর সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ববাসী যখন আল-কায়েদার মুখোশ আস্তে আস্তে উন্মোচন করতে শুরু করেছে তখন আবার অন্ধকার থেকে বের হতে শুরু করে আইএস (ইসলামিক স্টেট) নামের বিকট দানব। আইএস প্রতিষ্ঠার এক বছর আগের অর্থাৎ ২০১৩ সালের একটি আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। সেখানে দেখা গেছে রিপাবলিকান পার্টির সিনিয়র সিনেটর ম্যাককেইন-এর সঙ্গে আইএস নেতা খলিফা বাগদাদীর বৈঠক করতে। খলিফা বাগদাদী আসলে ইহুদি। খলিফা বাগদাদীর সঙ্গে আরও ছিলেন মুহাম্মদ নূর নামে আরেক আইএস নেতা। এই আইএস-এর সঙ্গে আছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হটলাইন। মোসাদই সৃষ্টি করেছে আইএস নামের তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন। বিশ্বের আরেক আলোচিত জঙ্গি সংগঠন হলো ‘বোকোহারাম’। এদের হত্যাযজ্ঞ ও তা-বলীলা দেখে বিশ্ববাসী আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত। বোকোহারাম জঙ্গিরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার পাশাপাশি ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রয় করতে বাধ্য করছে। ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ এক প্রতিবেদনে বলেছে, আইএস ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা পশ্চিমাদের চেয়ে মুসলমানদেরই বেশি হত্যা করেছে।
একটি বিষয় লক্ষ করলে দেখা যায় যে, বিশ্বের কোনো জঙ্গি সম্প্রদায়ই স্বজাতিকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র হাতে নেয়নি। আমরা মধ্যযুগের ইতিহাসে দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধের কথা জানি। ক্রসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম নগরী লুণ্ঠন করেছিল, অসংখ্য মসজিদ সিনেগগ ধ্বংস করেছিল এবং নির্বিচারে অগণিত মুসলমান ও ইহুদিকে হত্যা করেছিল। তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পবিত্রতা না থাকলেও ১০৯৯ সালে ক্রসেডাররা ঠিকই জেরুজালেমে খ্রিস্টান রাজত্ব কায়েম করেছিল। আমরা ভারতবর্ষেও সনাতন ধর্মীয় জঙ্গি তৎপরদার বিকট রূপ দেখেছি। সেখানকার জঙ্গিরাও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আক্রমণ বা হত্যা করেনি যতটা করেছে মুসলমানদের। একমাত্র মুসলিম জঙ্গিরাই ব্যতিক্রম যাদের সৃষ্টি হয় কেবল মুসলিমদের হত্যা করার জন্যই। হাদিসে আছেÑ ‘এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই।’ এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে একজন মুসলমান ভাই আরেকজন মুসলমান ভাইকে হত্যা করে পাপ সঞ্চয় করবেÑ এটাও কি সম্ভব একজন সাচ্চা মুসলমানের পক্ষে? সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব যেই ইসলামের মূলকথা, সেই ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে বিলীন হলে কার লাভÑ এটা আজ ভেবে দেখা দরকার। আজকে যারা আইএস নামে খ্যাত তারা কি সত্যিই ইসলামপন্থী জঙ্গি, নাকি তাদের পিঠে সওয়ার হয়ে অন্য কেউ ফায়দা লুঠের চেষ্টা করছে, এটাও গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে হবে।
শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে আইএসের স্বীকৃত হামলার পরে ৩৫৯ জনের প্রাণহানির ঘটনায় বিশ্ব বিবেক যারপরনেই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, মর্মাহত। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ এই হামলার নিন্দা জানিয়েই শুধু ক্ষান্ত হয়নি, তারা একযোগে জঙ্গি তৎপরতার মূলোৎপাটনেও বদ্ধ পরিকর। আমরা চাই সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই পৃথিবী থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে জঙ্গিদের সর্বাত্মক পরাজয় অবলোকন করার জন্য।
বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র বিশেষ করে পুঁজিবাদী আমেরিকা পৃথিবীতে অনেক অঘটন ঘটিয়েছে। আজো তারা ছলে-বলে-কৌশলে দুনিয়াব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায় নিজেদের পুঁজির আয়তন বৃদ্ধির জন্য। শান্তিপূর্ণ পৃথিবীতে আজ তারা অশান্তির যুদ্ধ বাঁধানোর জন্য নানারকম পাঁয়তারা করছে। যুদ্ধ বাঁধলেই অস্ত্র বিক্রির সম্ভাবনা তৈরি হয়। সুতরাং অস্ত্র ব্যবসাই যাদের মুনাফা বৃদ্ধির প্রধান পথ, তারা অস্ত্র বিক্রির জন্য যেকোনো কৌশলই গ্রহণ করতে বাধ্য।
আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বে কখনোই শান্তি আসতে পারে না। আরব বসন্তের নামে পুরো আরব জাতিকে আমেরিকা ধ্বংস করে দিয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে আরব জাতির প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন। ইরাক, লিবিয়া, মিশর, সিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে এখন শুধু রক্ত আর বারুদের গন্ধই পাওয়া যায়। শিশুর হাসির বদলে সেসব রাষ্ট্রে শোনা যাচ্ছে শিশু-বৃদ্ধ-নারীর করুণ আহাজারি। মধ্যপ্রাচ্য ধ্বংস করে আমেরিকা এখন থাবা বিস্তার করতে চাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে। এই অঞ্চলে ঢোকার জন্য আমেরিকা বিলিয়ন-বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। আমাদের মনে রাখা দরকারÑ শত্রুর দান কখনোই গ্রহণ করতে নেই। পুঁজিবাদী আমেরিকা পৃথিবীর মানুষের জন্য চরম এক অশান্তির নাম। তাদের সঙ্গে সখ্য গড়লে মৃত্যুই হবে একমাত্র পরিণাম। দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার পদার্পণ কখনোই শুভ বার্তা বয়ে আনবে না। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাজ্ঞ নেতৃবৃন্দ এ কথাটা যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।
ইহুদিরাই এই সময়ের পৃথিবীতে মুসলমানদের প্রধান শত্রু মনে করা হয়। আইএস কেন ইহুদি-রাষ্ট্র ইসরাইলে কোনো হামলা করেনি বা করছে নাÑ এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই জাগছে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
৩০ এপ্রিল, ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 5 6 7 12
January 1st, 2018

১০ জানুয়ারি ’৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ […]

January 1st, 2018

প্রিয়তম বাংলা ভাষা চিরজীবী হোক

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর […]

December 11th, 2017

Bangladesh Entering ‘NUCLEAR CLUB’

Nuclear power plans Building a nuclear power plant in Bangladesh was proposed in 1961. Since then a number of reports […]

December 5th, 2017

বাংলাদেশ ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়

ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মাত্র নয় মাস সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি এত তাজা প্রাণ আর […]

November 21st, 2017

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধি

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃত দিয়ে তিনি যে ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন, এ […]

November 21st, 2017

এককভাবে সরকার গঠন করতে মুজিব-আদর্শের সৈনিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ […]

November 1st, 2017

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু প-িত সম্মান পান সর্বত্রÑ এমন একটি কথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কথাটি মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে […]

November 1st, 2017

খালেদা জিয়ার অতীত-ভুলই বর্তমানে কান্নার কারণ

পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললেই এখন খালেদা জিয়ার অশ্রুসজল ছবি দেখা যায়। এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার […]

October 8th, 2017

Cold War Past & Present

Mikhail Gorbachev’s perestroika of a decent standard of living for all Soviet People was misunderstood. This is the man who […]

October 5th, 2017

স্ব-ভূমে সসম্মানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন হোক

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্বের ভৌগোলিক বলয়। একদিন যেসব জাতিগোষ্ঠী বীরদর্পে পৃথিবীকে শাসন করতো, আজ তারা অনেকে নিজের […]