List

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক-দর্শন

মোনায়েম সরকার
পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে অসংখ্য মতবাদের জন্ম দিয়েছেন প্রথিতযশা দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এদের কারো কারো রাজনৈতিক তত্ত¡ এখনো সমাদৃত। কিছু কালের ধূলিতে মলিন হয়ে যাচ্ছে। কিছু নতুন মতবাদ আবার পুরাতন মতবাদগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। নতুন-পুরাতনের আবর্তনেই এগিয়ে যায় আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবীতে যেদিন থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে রাজনীতি। তবে তার রূপ হয়তো আধুনিক যুগের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। কিন্তু একথা আমাদের মানতেই হবেÑ শিল্প, সাহিত্য, ধর্মীয় মতবাদের মতো রাজনীতিও মানুষকে অনুসরণ করেছে প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকেই।
সুদূর প্রাচীনকাল থেকে যদি আমরা মানুষের ইতিহাস অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখব মানবসমাজ কখনোই রাজনীতি মুক্ত ছিল না। সে সময়ের মানুষের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ আধুনিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে কিছু এলোমেলোই মনে হওয়ার কথা। কিন্তু এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সব সমাজই সময়োপযোগী চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েই বিকশিত হয়। ‘দাসপ্রথা’ যে সময় বিস্তার লাভ করে, সে সময়ের রাজনৈতিক তত্ত¡কে এখনকার রুচি দিয়ে বিচার করলে অনেক অসঙ্গতিই হয়তো চোখে পড়ে। তবু আমরা বলতে পারি নাÑ দাসপ্রথা অপ্রয়োজনীয় মানবাচার ছিল। অশিক্ষিত বর্বর মানুষদের শাসন করতে হলে যে সমস্ত আইন-কানুন প্রয়োগ করা দরকার, সে সময় হয়তো তা-ই ছিল। আজকের আধুনিক বিশ্বেও যে দাসপ্রথা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে তা নয়, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এখনো প্রকারান্তরে দাসপ্রথাই বহমান, তবে তার চেহারা বদলেছে, বদলে গেছে পরিপ্রেক্ষিত।
পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো ঊনিশ শতক। এই শতকেই জন্ম নেয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতবাদ। একটি হলো মহান জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কসের ‘সাম্যবাদ’, অন্যটি আব্রাহাম লিংকন কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত ‘গণতান্ত্রিক মতবাদ’। কার্ল মার্কস হাজার হাজার বছরের মানব জাতির ইতিহাস পাঠ করে শ্রেণিসংগ্রামের যে রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ করেছেন, তারই নির্যাসরূপে জন্ম নেয় ‘সাম্যবাদ’। প্লেটো ‘গণতন্ত্র’কে মূর্খের শাসন বললেও আব্রাহাম লিংকন প্রমাণ করে গেছেন ‘গণতন্ত্র’ ছাড়া আধুনিক পৃথিবীকে শাসন করা অসম্ভব। আজকের পৃথিবীতে সাধারণত তিন ধরনের রাজনৈতিক পদ্ধতি দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছেÑ পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।
একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্রও দুনিয়ার বেশ কিছু রাষ্ট্রে প্রচলিত আছে। কিন্তু এই দুটি রাজনৈতিক পদ্ধতি এখনকার যুগে যেকোনো মানুষই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে নারাজ। পুঁজিবাদী শোষণ প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে সমগ্র পৃথিবীতেই এখন ‘গণতন্ত্র’ জনপ্রিয় রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে নন্দিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রদানকালে আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ÔGovernment of the people, by the people, for the people.Õ আব্রাহাম লিংকন তাঁর গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় যা বলেছিলেন, এ মেনে চললেও পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সাম্যবাদের উচ্চাশা অবশ্য গণতান্ত্রিক মতবাদের চেয়ে উন্নত, কিন্তু পৃথিবীর মানুষকে সাম্যবাদের জন্য যে সুকঠিন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হওয়া দরকার, তা এখনো অনেক দূরের গন্তব্য বলেই মনে হচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়-পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘জাতির পিতা’। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তি সংগ্রামেরত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রাক্কালে (১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর) বঙ্গবন্ধুকে ‘বাংলাদেশের জনক’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেন। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি রাষ্ট্রই নেতৃত্বের মাধ্যমে জন্ম দেননি। পৃথিবীর শোষিত মানুষের জন্য তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক মতবাদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত এই রাজনৈতিক মতবাদের নাম ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক তত্ত¡ বাংলার মাটি থেকে উদ্ভ‚ত হলেও এই তত্তে¡র মধ্যে বৈশ্বিক আবেদন বর্তমান। শোষিত মানুষ পৃথিবীর সর্বত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষুধার্ত শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুই পৃথিবীর বুকে প্রথম ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ তত্তে¡র প্রবর্তন করেন। তিনি দেখেছিলেন, ‘দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্তÑ শোষক আর শোষিত’। তাই ‘শোষিতের পক্ষে’ দাঁড়িয়েছিলেন, এ বক্তব্যের দলিলস্বরূপ ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ স্মরণ করা যেতে পারে।
‘শোষিতের গণতন্ত্র’ মূলত সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সম্মিলিত রূপ। কেন বঙ্গবন্ধু আধুনিক যুগের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় দুটি রাজনৈতিক মতাদর্শকে একসূত্রে গেঁথে নতুন তত্ত¡ দাঁড় করালেন তা আমাদের একটু বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।
বঙ্গবন্ধু কৃষিভিত্তিক পরিবারের সন্তান হলেও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থায় বেড়ে উঠে তিনি শুধু শোষণ-বঞ্চনাই প্রত্যক্ষ করেননি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামাও মোকাবিলা করেছেন। তাঁর কলকাতার ছাত্রজীবন রাজনীতির সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। স্বঘোষিত নেতা হয়ে নয়, গণমানুষের হৃদয় জয় করেই তিনি নেতৃত্বের শীর্ষপদে আরোহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা মেনে চলার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক বণ্টন পদ্ধতিও ক্রিয়াশীল ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এ মাটিতে যারাই রাজনীতি করেছেন তারা প্রত্যেকেই একমুখী রাজনীতি করেছেন। যিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তিনি শুধু সমাজতান্ত্রিক আদর্শকেই লালন করেছেন। যিনি গণতন্ত্রের পক্ষাবলম্বী তিনি বেছে নিয়েছেন গণতন্ত্রের পথ, উগ্র ডানপন্থীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান একেবারেই ব্যতিক্রমী চরিত্র। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে আত্মস্থ করে জন্ম দিলেন নতুন তত্ত¡Ñ ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। মুসলিম প্রধান অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির ব্যর্থতার ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল, তাই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-আদর্শ গ্রহণ করলেন বটে, তবে পথ খুঁজে নিলেন গণতন্ত্রে। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের প্রথম পুরুষÑ যিনি মানুষকে জাগানোর কাজে ‘সমাজতন্ত্রের লাইন’ মেনে বক্তব্য দিতেন কিন্তু কর্মপদ্ধতিতে অনুসরণ করতেন গণতান্ত্রিক ধারা। বঙ্গবন্ধুর এই দ্বৈত পদ্ধতি সে সময়ের অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই বুঝতে পারেন নি। বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে বঙ্গবন্ধুও তাঁর স্বপ্নলোকের কথা কারো কাছে ব্যক্ত করেননি।
আজ বঙ্গবন্ধুর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ নিয়ে অনেকেই গবেষণা করছেন। অনেকেই ইতোমধ্যে ক্ষীণ-স্থ‚ল গ্রন্থ প্রকাশ করছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ নিয়ে যারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের অনেকের বক্তব্যই আমার কাছে এক কৌণিক মনে হয়। ‘বাকশাল’ আলোচনাই হয় দ্বিতীয় বিপ্লবের মূলকেন্দ্র। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে দুটি শব্দ ‘কৃষক’ ও ‘শ্রমিক’ যুক্ত করে তিনি ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ গঠন করেছিলেন। বাকশাল গঠন করে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগও বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন। বাকশাল আসলে কোনো একক দল ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের সকল দলকে এক ছাতার নিচে এনে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে তৈরি ‘জাতীয় দল’। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি তো ‘প্রথম বিপ্লব’ সংঘটিত করে সফল হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘প্রথম বিপ্লবের’ স্বরূপ ব্যাখ্যা না-করে যারা দ্বিতীয় বিপ্লবের সূত্র আবিষ্কার করছেনÑ তাঁদের অনুসন্ধান সম্পূর্ণ হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। এ পর্যন্ত আমি যত গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছি তার অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক। আমার পঠন-পাঠনে বঙ্গবন্ধুকে আমি যেভাবে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল তাঁর ‘প্রথম বিপ্লব’। বঙ্গবন্ধু জানতেন এদেশের মানুষ ‘বিপ্লব’ বললে তখন অন্য অর্থে নিতো, তাই তিনি ‘সংগ্রাম’ বলেছেন, ‘বিপ্লব’ বলেননি। ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ লাইন দুটি সেই ইঙ্গিতই দেয়। বিপ্লব কিভাবে সংঘটিত হয়Ñ তা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন মানুষকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতে পারলে মানুষ এমনিতেই তার অধিকার ফিরে পেতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মানুষের চেতনার জায়গা একদিনেই গড়ে তোলা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও ধৈর্য। সে-সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই বঙ্গবন্ধু ‘বিপ্লবে’র ছক এঁকেছিলেন। যদিও তিনি কৌশলগত কারণে ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে উহ্য রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করতে চাইÑ
আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বছর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি জানি, এদের সাথে মানুষ থাকতে পারে না। আমি ইম্পেশেন্ট হই না। আমি এডভেঞ্চারিস্ট নই। আমি খোদাকে হাজের-নাজের জেনে কাজ করি। চুপি চুপি, আস্তে আস্তে মুভ করি। সব কিছু নিয়ে। [উৎস : শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর শতভাষণ, পৃ. ৪৮১]
বিশ্বের অন্যান্য মানবতাবাদী নেতার মতো বঙ্গবন্ধুও একটি মানবিক বিশ্বব্যবস্থা ও সুষমবন্টন নীতিমালা আকাক্সক্ষা করেছিলেন। এই দুটি আকাক্সক্ষাকে বাস্তব সম্মতভাবে রূপ দিতেই তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে সমন্বয় করেছিলেন। সমাজতন্ত্র চলার পথে অনেক জায়গাতেই হোঁচট খেয়েছে এবং এখনো খাচ্ছে।
একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বের গোলযোগের মধ্যে পড়ে অনেক জায়গাতেই সমাজতন্ত্র ঠিক মতো মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা নয়, বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছেন। দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিস্থিতি বিবেচনা না-করে যারা পাঠ্য বইয়ের ‘থিউরি’কে হুবহু প্রয়োগ করতে চেয়েছেন, তারাই সর্বনাশ করেছেন সমাজতন্ত্রের। বঙ্গবন্ধু ‘কেতাবি সমাজতন্ত্র’ সর্বাংশে গ্রহণ না-করে তিনি একে নিজের দেশের রুচি অনুযায়ী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যা সে-সময়ের অনেকেই বুঝতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিজের মতামত একটু শুনে নেওয়া যাকÑ
কোনো জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোনো ‘ইজম’ চলে না। এ দেশেÑ কোনো দেশে চলে না। আমার মাটির সাথে, আমার মানুষের সাথে, আমার কালচারের সাথে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে, আমার ইতিহাসের সাথে যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে। কারণ, আমার এখানে মানুষের কালচার কি, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কি, তা না জানলে হয় না। ফান্ডামেন্টালি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্তিক অর্থনীতি করতে চাই। বাট দি সিস্টেম ইজ আওয়ার্স। উই ডু নট লাইক টু ইমপোর্ট ইট ফ্রম এনিহোয়ার ইন দি ওয়ার্ল্ড। [উৎস : শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর শতভাষণ, পৃ. ৪৮২-৪৮৩]
পৃথিবীর যত দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেসব দেশের বিপ্লবপূর্ব ও বিপ্লবপরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সম্যক অবগত ছিলেন। একটি বিপ্লব কেন ব্যর্থ হয়, তা তিনি জানতেন। তিনি দেখেছিলেন, রুশ বিপ্লবের সময় ২ কোটি লোক নিহত হয়েছিলেন। একই ঘটনা চীনেও ঘটেছিল। চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে প্রায় ৩ কোটি মানুষ হত্যা করেছিল। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ না করলেও এসবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বঙ্গবন্ধুর ভালো করেই জানা ছিল। তাই তিনি স্বাধীনতার-উত্তর গৃহযুদ্ধ চাননি। বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় কখনোই কোনো আন্দোলন ব্যর্থ হতে দেন নাই। কর্মী-সাধারণের মনোবল ভেঙে যেতে পারে এ রকম কোনো ব্যর্থ আন্দোলনের দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাসে নেই। মানুষের মনের খবর জেনেই বঙ্গবন্ধু তার সুনির্দিষ্ট পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন।
রাজনীতি-সচেতন অনেক বিজ্ঞ মানুষই হরহামেশা বলেন, স্বাধীনতার পরেই বঙ্গবন্ধুর ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ডাক দেওয়া উচিত ছিল। তখন তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ কর্মসূচি ঘোষণা করলে ‘পঁচাত্তর ট্র্যাজেডি’ হয়তো নাও ঘটতে পারতো।’ আমি এই কথার সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করি। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু যা করেছেন সে সময়ের প্রেক্ষাপটে ওটাই ছিল সর্বোত্তম, মোক্ষম কাজ। ১৯৭২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেই যদি বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ডাক দিতেন তাহলে তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত শ্মশান বাংলাকে পুনর্গঠিত করতে পারতেন না, কিছুতেই তিনি গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন না বাংলাদেশের মানুষকে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারা জানিÑ সে সময় দেশের পরিস্থিতি কী ভয়াবহ ছিল। বঙ্গবন্ধু তড়িঘড়ি করে ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ডাক দিলে সেটা হতো আরো সর্বনাশের কারণ। তিনি জানতেন তিনি কী করবেন। তাই দেশের মানুষের প্রতি আস্থা রেখে তিনি স্বাভাবিক পরিস্থিতির অপেক্ষা করছিলেন। কেননা অনুক‚ল পরিস্থিতি ছাড়া কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধু সুযোগ পেলেই শোসিতের গণতন্ত্রের কথা বলতেন। তিনি ধীরে ধীরে মানুষের কানে তাঁর মনের কথা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। এ কথার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর নিম্নোক্ত ভাষণেÑ
আমি একদিন তো বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব যে, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশীদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়Ñ শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়Ñ বহুদিনের কথা আমাদের, এবং সে জন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে। [উৎস : শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর শতভাষণ, পৃ. ৪৪৯]
বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ মুলত নিপীড়িত কৃষক-শ্রমিক জনতার কল্যাণমুখী গণতন্ত্রেরই পূর্ণ রূপায়ণ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক নিয়মতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীনভাবে রাষ্ট্র শাসন করবে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়। যারা শোষিতের বেদনাকে দীর্ঘায়িত করে পুঁজিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারাই ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বিকৃত করার চেষ্টা করে। একদিন এদেশের মানুষ শোষিতের গণতন্ত্রকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিবেÑ সেদিনই হবে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের মহাবিজয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য রচিত নয়, এটা পৃথিবীর শোষিত মানুষের মুক্তির ইশতেহার। মানবিক বিশ্বব্যবস্থা কায়েম করতে হলে আমাদের শোষিতের গণতন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে মানুষের এ পথেই এগিয়ে যাওয়া দরকার। আজকের কল্যাণমুখী মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে হলে মানবিক বিশ্বব্যবস্থা (Humane world order) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মানুষ এগিয়ে যাবে।
১০ মে, ২০২১
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  Posts

1 5 6 7 12
January 1st, 2018

১০ জানুয়ারি ’৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ […]

January 1st, 2018

প্রিয়তম বাংলা ভাষা চিরজীবী হোক

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর […]

December 11th, 2017

Bangladesh Entering ‘NUCLEAR CLUB’

Nuclear power plans Building a nuclear power plant in Bangladesh was proposed in 1961. Since then a number of reports […]

December 5th, 2017

বাংলাদেশ ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়

ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। মাত্র নয় মাস সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি এত তাজা প্রাণ আর […]

November 21st, 2017

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধি

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃত দিয়ে তিনি যে ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন, এ […]

November 21st, 2017

এককভাবে সরকার গঠন করতে মুজিব-আদর্শের সৈনিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ […]

November 1st, 2017

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবি

রাজা পূজিত হন স্বদেশে কিন্তু প-িত সম্মান পান সর্বত্রÑ এমন একটি কথা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কথাটি মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে […]

November 1st, 2017

খালেদা জিয়ার অতীত-ভুলই বর্তমানে কান্নার কারণ

পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললেই এখন খালেদা জিয়ার অশ্রুসজল ছবি দেখা যায়। এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার […]

October 8th, 2017

Cold War Past & Present

Mikhail Gorbachev’s perestroika of a decent standard of living for all Soviet People was misunderstood. This is the man who […]

October 5th, 2017

স্ব-ভূমে সসম্মানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন হোক

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্বের ভৌগোলিক বলয়। একদিন যেসব জাতিগোষ্ঠী বীরদর্পে পৃথিবীকে শাসন করতো, আজ তারা অনেকে নিজের […]