আজ মহান মে-দিবস। শ্রমিকশ্রেণির ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন। চিরদিনই শ্রমজীবী মানুষেরা শোষিত, বঞ্চিত এখনও তাদের শোষণ-বঞ্চনার কাহিনী শেষ হয়নি। পৃথিবী এগিয়ে গেছে। পুঁজিপতি আরো অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছে, কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের জীবন বাঁধা পড়ে আছে অভাব আর দারিদ্রের রশিতে। এই দৈন্যের রশি ছিঁড়তে হবে। এগিয়ে নিতে হবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির মিছিল। একদিন শ্রমিকের পক্ষে কথা বললেই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়, এ জন্য দরকার বিরামহীন লড়াই-সংগ্রাম। এই লড়াই সংগ্রামের রক্তাক্ত পথ বেয়েই আসবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি। শ্রমিক শ্রেণির সার্বিক মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত মে-দিবসের চেতনা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না। মহান মে-দিবস শ্রমজীবী মানুষের অনুপ্রেরণার দিন। এই দিনে শপথ নিয়েই দুনিয়ার সকল শ্রমজীবীকে অধিকার আদায়ে অগ্রণী হতে হবে।
পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রীদের যখন সোনালি দিন ছিল, তখন মে দিবস উদযাপিত হতো অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে। মস্কোর রেড স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আর আর্মির শোভাযাত্রা যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, সেদিনের মে দিবস আর আজকের মে দিবসে আঙ্গিকগত পার্থক্য থাকলেও চেতনাগত কোনো পার্থক্য নেই। মানুষের জীবনযাপন সুষ্ঠু-সুন্দর ও মানবিক করার জন্য মানুষের চেষ্টার কোনো বিরাম নেই। কীভাবে যাপিত জীবনকে অর্থবহ ও সার্থক করে তোলা যায় এই ভাবনা পৃথিবীর সব দেশের সব শ্রেণির মানুষের মাঝেই কমবেশি ক্রিয়াশীল। কিন্তু জীবনকে সুন্দর, সার্থক, অর্থবহ করার জন্য শুধু মানুষের চেষ্টাই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পরিবেশ ও পরিস্থিতির যোগসূত্র। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় কোনো সুন্দর স্বপ্ন বাস্তবায়ন। তবে এটাও ঠিক, মানুষই পারে তার শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনতে। অসমশক্তির সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে যুগে যুগে যারা পৃথিবীকে পরিবর্তিত করেছেন, তারা হলেন শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ। এই শ্রমজীবী মানুষের বুকে পা ফেলেই আসে নব উত্থান; শ্রমিকরাই তাদের দেহের শক্তি আর রক্তের বিনিময়ে তৈরি করে সভ্যতার সোনালি সরণি। নজরুলের ভাষায় :
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধুলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।
অনেকে মনে করেন ১৮৮৬ সালের ১ মে’র পর থেকেই শ্রমিকদের অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। বিষয়টি কিন্তু তা নয়। ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে ৪ মে পর্যন্ত শিকাগো শহরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে শ্রমিকশ্রেণি রচনা করেছে মে দিবসের সংগ্রামী ইতিহাস। শ্রমিক সংগ্রামের ঐ কয়দিনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অন্তত ১০ জন শ্রমিক; গ্রেফতার হন শ্রমিক নেতা স্পাইস ও ফিলডেন। পরবর্তীতে হে মার্কেটের ঘটনার দায় চাপানো হয় স্পাইসসহ অন্যান্য শ্রমিক নেতার ওপর। এক সংক্ষিপ্ত ও প্রহসনমূলক বিচারে ফাঁসি হয়ে যায় শ্রমিক নেতা স্পাইস, পার্সনস, ফিলডেন, মাইকেল স্কোয়ার, জর্জ এঙ্গেলস ও অ্যাডলফ ফিসারের। ১৮৮৮ সালে আবারও ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়। সেই রক্তাক্ত ১ মে’তেই আন্দোলনের সূচনা হয়। বিশ্বের সব দেশে শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৮৯০ সালে। সেই থেকে মে দিবস শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মজদুরের দিন।
এক সময় মানুষ বনেজঙ্গলে, পাহাড়েপর্বতে বসবাস করত। সেই বনচর মানুষেরা স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করত। তাদের মধ্যে কোনো কলহ ছিল না, শোষণ ছিল না, উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো মানসিকতাও ছিল না। বনচারী মানুষের সেই জীবনকে সমাজতাত্ত্বিকরা নাম দিয়েছেন আদিম সাম্যবাদী সমাজ। সমাজ বিবর্তনের প্রয়োজনে আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তৈরি হয় দাসপ্রথা। দাসযুগে ব্যক্তি মানুষের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। দাসদের ছিল না স্বাধীন জীবনযাপন করার অধিকার। দাসবিদ্রোহের পর আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দাসরা কিছুটা মানবিক অধিকার ফিরে পেলেও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন পুরোপুরি হয় না। আবার শুরু হয় শোষিত মানুষের লড়াই। এই লড়াই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। এক সময় ভেঙে পড়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। জন্ম নেয় নতুন পুঁজিপতিদের যুগ। এই নব্য পুঁজিবাদী যুগে এসেও শ্রমিক শ্রেণি শোষিত হতে থাকে নব্য পুঁজিপতিদের দ্বারা। পুঁজিপতিদের শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে আবার বিদ্রোহ করে শ্রমিক শ্রেণি। তারা বুঝতে পারে ধনীরা শ্রমিকদের শোষণ করে ধনের পাহাড় গড়ছেÑ আর কৌশলে শ্রমিকদের শোষণ করে যাচ্ছে। মহান দার্শনিক কার্লমার্কস শ্রমিকদের এই ক্রমাগত লড়াই-সংগ্রামকেই বলেছেনÑ ‘পৃথিবীর ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস’। এ কথা এক অর্থে ঠিক। আবার অন্য অর্থে এটি মূলত সময়েরই দাবি।
আমার ছেলেবেলায় দেখেছি, আমাদের জমিতে এক সময় একজন দিনমজুর চার আনায় কাজ করত আজ সেই মজুরের বেতন কমপক্ষে ৫০০ টাকা। আগে যেখানে একজন পোশাক শ্রমিক কাজ করত ৩০০-৪০০ টাকায়, এখন তাকে শুরুতেই দিতে হয় ৮০০০ টাকার উপরে। এটাকে শ্রমিক শ্রেণির লড়াইয়ের ফসল বলব নাকি সময়ের প্রয়োজন বলব? এক সময় কাজ ছিল না কিন্তু প্রচুর কাজের মানুষ ছিল। আজ কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, শ্রমিকের চাহিদাও বাড়ছে; তাই সহজেই শ্রমিকরা মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি করে কাজে যোগদান করতে পারছে। এটাকে শ্রেণিসংগ্রাম না বলে, নতুন আর্থসামাজিক বিবর্তন বলাই সঙ্গত?
একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজনÑ এক সময় শ্রমিক আর মালিকের মধ্যে ছিল প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। আজ সেই দূরত্ব অনেকখানি কমে এসেছে। এখনও মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব আছে, তবে সেই দ্বন্দ্ব আগের মতো অতি প্রকট আর সাংঘর্ষিক নয়। এখন মালিকরাই তাদের পুঁজি ও কারখানার স্বার্থে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার। এটা নিঃসন্দেহে একটি পজেটিভ পদক্ষেপ।
মার্কস-অ্যাঙ্গেলস কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার লিখে যে বিপ্লবের সম্ভাবনাকে উসকে দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী কোথাও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধিত হয়নি। প্রথমে ফ্রান্সে সাম্যের নামে যে ফরাসি বিপ্লব হয়, সেই বিপ্লবের চরিত্রের সঙ্গে মার্কসবাদী বিপ্লবের তেমন মিল ছিল না। এরপরে শুরু রুশ বিপ্লব ও চীন বিপ্লব। রাশিয়ায় ও চীনে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছিল তা শ্রমিকের স্বার্থে যতটা না ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল পুঁজিবাদী শক্তি হ্রাস করার জন্য। তবে সমাজতন্ত্রীরা যে ধনবাদীদের শত্রু মনে করেছিল শোষক শ্রেণি হিসাবে, সে কথা এক অর্থে ঠিকই ছিল। বর্তমানে টেকনোলজি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকের শ্রম লাঘব হয়ে গেছে। এখন একজন শ্রমিক কায়িক শ্রমের বদলে যান্ত্রিক শ্রমেই বেশি সময় ব্যয় করছেন। এখন হোয়াইট কলার শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, এটা শ্রম বিভাজনেরই লক্ষণ।
বিশ্বে এখন এক শতাংশ ধনপতি মানুষের হাতে যত টাকা আছে, বাকি নিরানব্বই শতাংশ লোকের হাতে আছে তত টাকা। এই কমসংখ্যক মানুষের ধন যদি সুষম বণ্টন করা যেত, তাহলে মানুষের অভাব অনেকটাই লাঘব করা যেত। আজ আমেরিকা একক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে, তারা দেশে দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে তেলসম্পদ ও অস্ত্র বিক্রির জন্য। তালেবান, আল কায়দা থেকে আইএসÑ এসব তাদেরই সৃষ্টি। আজ তাদের দমানোর নামে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে লিপ্ত আমেরিকা। মানুষ মারার জন্য অস্ত্র তৈরি বন্ধ রেখে যদি আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে আমেরিকা মানুষের জীবন জীবিকা উন্নয়নে মনোযোগী হতো, মানুষের জন্য সুন্দর কিছু করত, তাহলে আরও সুন্দর হতো আমাদের পৃথিবী।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিকামী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবী ব্যাপী একটি সুন্দর মানবিক সমাজ গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। দেশে দেশে হানাহানি কমিয়ে, অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিরসন করে ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট হচ্ছে মানুষ। সংঘাতের পথ পরিহার করে, ক্ষমতার দম্ভ ভুলে গিয়ে, ধনবৈষম্য কমিয়ে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিগত দিনে দুই জার্মানির একত্রীকরণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে দুই কোরিয়ার সম্প্রীতির সম্ভাবনা বিশ্ববাসীর মনে দারুণ এক আশার সঞ্চার করেছে। এ যেন যুদ্ধবিমুখতা ও অস্ত্র পরিহার করে সুন্দর সমাজ গঠনেরই উদাহরণ।
আমি বারবার একটি কথা বলার চেষ্টা করছিÑ পৃথিবী এখন নতুন মানবিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। এই প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের আর শোষণ করার সুযোগ নেই। শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য পাওনা দিতেই হবে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি না পেলে পুঁজি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আজকের দিনে একজন শ্রমিক যেসব সুযোগ সুবিধা ও জীবনমান ভোগ করে, দাস যুগে তা মোটেই সম্ভব ছিল না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে কে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন জানি না, তবে আমার মনে হয় আজকের দিকে শ্রমিক শ্রেণি যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে সেখানে আসার জন্য সমাজতন্ত্রের একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। পৃথিবীতে যেদিন সমাজতন্ত্র সাম্যের গান ধরেছে, সেদিন থেকেই বদলে গেছে মানবজাতির বঞ্চনার ইতিহাস। আগের দিনে পুঁজিপতিদের কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু সমাজতন্ত্র এসে পুঁজিপতিদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, চোখ খুলে দিয়েছে পৃথিবীর বঞ্চিতদের। একজন মানুষ যখন জেগে ওঠে তখন কেউ তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। মে-দিবস শ্রমিকশ্রেণির জেগে ওঠার দিন। এই দিনই শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রক্ষাকবচ। মহান মে-দিবস সফল হোক।
২৯ এপ্রিল, ২০১৮
Leave a Reply